আরও একটি ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে দেশ। এই প্রেক্ষিতেই এবার মোদী সরকারের নীতি নিয়ে তীব্র আক্রমণে সিপিএম। দলের মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসির গত ১৩ ই মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বিজেপি সরকারের নীতির কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিল্প থেকে কর্মসংস্থান, সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েই সারাদেশে অতি আগ্রাসী জাতীয়তবাদের চাষ শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। লক্ষ্য একটাই, যেন তেন প্রকারে ফের ক্ষমতায় ফেরা।
পিপলস ডেমোক্রেসির এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, আসন্ন ভোটে পরীক্ষা কেবল ভারতবাসীর নয়, আসলে পরীক্ষায় বসবে ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও। মোদী সরকারের ৫ বছরের শাসন সংবিধানের মূল ধারক অর্থাৎ যে ভিত্তির উপর সংবিধান রচনা, তাকেই দুর্বল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে। সম্পাদকীয়তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বিজেপি এবারও জেতার অর্থ, একটি চূড়ান্ত আধিপত্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির দিকে আরও এক কদম এগিয়ে যাওয়া। লোকসভা নির্বাচন, একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, এমন একটা সময় ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন দেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এক ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এই সময় জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তার দিকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সম্পাদকীয়তে প্রতিটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশিত হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে সংকটের অর্থ হল সরাসরি কৃষকের জীবন-জীবিকা নির্বাহে তার প্রভাব। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের কৃষির যে চিত্র তুলে ধরেছে তা ভয়ঙ্কর বলে বর্ণনা করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে।
তারপরই এসেছে কর্মসংস্থান। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, যে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে স্টাডি, যা মোদী সরকার চেপে দিয়েছে, তাতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে গত সাড়ের চার দশকের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে কম, বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মোদী সরকারের আমলেই। সম্পাদকীয়তে সিএমআইই-র রিপোর্ট উল্লেখ করে মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।
দেশে ক্রুনি ক্যাপিটালিজমের রমরমার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যেখানে অনিল আম্বানী অনায়াসে রাফালের বরাত পেয়ে যান, বেসরকারিকরণের দিশায় হেঁটে তিরুবনন্তপুরম সহ দেশের ছটি বিমানবন্দরের বরাত চলে যায় আদানি গোষ্ঠীর হাতে।
মোদী সরকার অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বেসরকারিকরণের দাপটে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। দেশ আগে কখনও সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর উপর এমন আঘাত প্রত্যক্ষ করেনি। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আজ ভূলুন্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো যা প্রজাতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ, তা আজ আক্রান্ত। তার অবশ্যম্ভাবী ফল, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগের এমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা, বলে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, মানুষের নজর এই বিষয়ের দিকে ঘোরাতে হবে। আর এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে বিরোধীদেরই। মোদী সরকারের মানবতা বিরোধী চরিত্রকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার কাজটিকে বিরোধীদেরই করতে হবে।
কিন্তু মানুষের যখন জীবন-জীবিকা নিয়ে ভাবার সময় তখন কৌশলে তাদের চিন্তাভাবনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে মোদী সরকার বলে অভিযোগ সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে। সেখানে লেখা হয়েছে, চারদিকে এমন ব্যর্থতার জেরেই পুলওয়ামার জঙ্গি হামলার ঘটনার পর বিজেপি অত্যন্ত কৌশলে দেশবাসীকে অতি জাতীয়তাবাদের রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একমাত্র মোদীই দেশকে রক্ষা করতে পারেন, এমন ধারণা মানুষের মধ্যে তৈরি করাই বিজেপির লক্ষ্য বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ। সেখানে লেখা হয়েছে, মোদীর এই উচ্চকিত জাতীয়তাবাদের প্রচারকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে কর্পোরেট মিডিয়া। কিন্তু কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী বক্তব্য শুনে লক্ষ্য গুলিয়ে ফেললে চলবে না বলেও সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে। কৃষি থেকে মূল্যবৃদ্ধি, নারী সুরক্ষা থেকে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। মোদী সরকারের সমালোচনা করার অর্থ জাতীয় সুরক্ষা কিংবা সন্ত্রাসবাদকে এড়িয়ে যাওয়া নয়। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, বারবার মোদী সরকারের কাছে জবাব চাইতে হবে, কেন প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরও সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা কমছে না? কেন তারপরও পুলওয়ামার মত ঘটনা ঘটল? সর্বোপরি, কেন কাশ্মীরে কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর উপর ভরসা রেখে রাজনৈতিক সমাধানসূত্রকে আরও দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?
পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদকের পদে রয়েছেন সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বিকল্প নীতির সরকারের পক্ষেই সওয়াল করা হয়েছে যেখানে কোনও আপস ছাড়াই দেশের গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবে ক্ষমতাসীন সরকারই। মানুষের স্বার্থে সেটাই হবে মোদী সরকারের ডানপন্থী অর্থনৈতিক নীতি এবং প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক চেতনার যথার্থ বিকল্প। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলের মধ্যেও এই চরিত্র বিদ্যমান। এই দায়িত্ব সিপিএম এবং বামপন্থীদেরই নিতে হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
Comments are closed.