নির্দিষ্টভাবে দিন, তারিখ মনে নেই। খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেত, কিন্ত তাতে ঘটনার গুরুত্ব বাড়ত কিংবা কমতো না। তাই আর দিন, তারিখের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার দরকার আছে বলে মনে হল না।
ঘটনাটা মনে পড়ল, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট থেকে পঞ্চায়েত সমিতিতে সেলিম লস্করের প্রার্থী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সামান্য হাল-হকিকতেরও খবর রাখা সমস্ত পুরনো লোকই জানেন, সেলিম লস্করকে অনায়াসে মগরাহাটের মুখ্যমন্ত্রী বলা যায়। মেন রোড থেকে কম-বেশি একশ মিটার দূরে বাড়ি। মেন রোড থেকে সেলিম লস্করের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার একাধিক জায়গায় সিসি টিভি লাগানো। সঙ্গে সব সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী। সেলিম লস্কর মগরাহাটে একটা ব্যাপার। এবার তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী। তাঁর এই প্রার্থী হওয়ার জন্যই মনে পড়ে গেল প্রায় এক যুগ আগের একটা ঘটনা।
২০০৭ সাল। জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ নন্দীগ্রামে আন্দোলন শুরু হয়েছে। তারপর আস্তে-আস্তে মুক্তাঞ্চল হল নন্দীগ্রাম। এল ১৪ মার্চ। পুলিশি অভিযান, ১৪ জনের মৃত্যু। নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে সারা রাজ্য উত্তাল। কয়েক মাস বাদেই হলদিয়া পুরসভায় ভোট। হলদিয়ার মুখ্যমন্ত্রী তখন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ। সামান্য একটা পুরসভা হলে কী হবে, রাজ্য রাজনীতিতে তখন হলদিয়া পুরসভা ভোটের গুরুত্বই আলাদা। একে শিল্পাঞ্চল, তায় আবার নন্দীগ্রামে শিল্প করতে গিয়ে ধাক্কা খাওয়া সিপিএম হলদি নদীর অন্য পারে হলদিয়ায় কেমন রেজাল্ট করে, তা নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে তখন জোর চর্চা। হলদিয়া পুরসভা জিতলে সিপিএম বলতে পারবে, নন্দীগ্রামে ‘শিল্প বিরোধী’ আন্দোলনের কোনও প্রভাব হলদিয়ায় পড়েনি। তাই ২০০৭ সালে হলদিয়া পুরসভা ভোটটাকে শুধু লক্ষ্মণ শেঠ কিংবা তাঁর স্ত্রী এবং পুরসভার চেয়ারপার্সন তমালিকা পণ্ডা শেঠ বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়, মুজফফর আহমেদ ভবনের কাছেও সেটা ছিল প্রেস্টিজ ফাইট। সেই হলদিয়া পুরসভায় ভোট হল এবং কার্যত অনায়াসে জিতল সিপিএম।
তার বেশ কিছুদিন পরের কথা। একদিন সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা হবে। বাড়িতে বসে আছি। হঠাৎ মোবাইল বাজল। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক সিআইডি অফিসারের ফোন। এত সকালে তো কখনও ফোন আসে না।
‘শোনো, সেলিম লস্কর অ্যারেস্ট হয়েছে। এখনই খবর করে দাও।’ ফোনে উত্তেজিত গলা ওই অফিসারের।
‘কে সেলিম লস্কর?’ নামই শুনিনি কোনও দিন। পালটা প্রশ্ন করলাম।
‘সেলিম লস্করের নাম শোনওনি? আরে মহগরাহাটের নাম করা ক্রিমিনাল। প্রচুর কেস ওর নামে। কাল রাতে হলদিয়ার সরকারি গেস্ট হাউস থেকে ধরেছি। হলদিয়ায় পুরসভার ভোট করতে গেছিল। ওখানেই একটা গেস্ট হাউসে শাগরেদদের নিয়ে ডেরা বেঁধেছিল। আমরা রেইড করে ধরেছি। এই মাত্র ভবানীভবনে নিয়ে এলাম।’
এতখানি শুনে বুঝলাম ব্যাপারটার গুরুত্ব। তৃণমূল অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করছিল, বাইরের দুষ্কৃতী এনে হলদিয়ায় ভোট করাচ্ছে সিপিএম। এই দুষ্কৃতীদের নন্দীগ্রাম দখল করতে পাঠানো হচ্ছে। এবার বুঝলাম ব্যাপারটা কী। তার মানে তো বিরোধীদের অভিযোগ ঠিকই। কিছুক্ষণ বাদেই খবর করলাম, ‘দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুখ্যাত দুষ্কৃতী সেলিম লস্কর গ্রেফতার। ভোট করাতে গিয়েছিল হলদিয়ায়। সেখানে সরকারি গেস্ট হাউসে ছিল শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেখান থেকেই সিআইডি গ্রেফতার করেছে ইত্যাদি।’
খবর করার মিনিট পনেরোর মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক সিপিএম বিধায়কের ফোন।
‘সেলিম লস্কর অ্যারেস্ট হয়েছে বলে কোনও খবর করছ তোমরা?’
বললাম, হ্যাঁ।
পরে শুনেছিলাম, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিপিএম নেতা এবং রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই সময় চিনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি খবর পান, সেলিম লস্কর অ্যারেস্ট হয়েছে। তা কনফার্ম করতে বলেন ওই বিধায়ককে, যিনি আমাকে ফোন করেছিলেন।
এমনই প্রভাব দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম জমানায় ছিল সেলিম লস্করের। এই অ্যারেস্টের জল এত দূর গড়িয়েছিল যে, সেই সময় সিআইডির এডিজি ভূপিন্দর সিংহকে পর্যন্ত ফোন করে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা।
মাঝখানে দশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। সেলিম লস্কর এবার তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী। ভাবছিলাম, কোন শুদ্ধকরণ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে, কোন অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করে তিনি এবার প্রার্থী হলেন? নাকি এসব আমার ভুল ভাবনা, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতির পরম্পরাই বহন করছেন মগরাহাটের সেলিম লস্কর!