উচ্ছেদের মুখে ওড়িশার ৭০০ আদিবাসী পরিবার, আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পাঠাতে ডাবল লাইনের তীব্র বিরোধিতা
রউরকেল্লা স্টিল টাউনশিপ থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার বিসরা-বীরকেরা তালুকের বারহা বানস গ্রাম। আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আনতে এলাকায় দ্বিতীয় রেল লাইন পাতার তীব্র বিরোধিতায় সেই গ্রামের বাসিন্দারা। নতুন করে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় প্রায় ৭০০ পরিবার। কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের নাছোড় লড়াইয়ের সামনে নিরুত্তর রাষ্ট্র।
৩ সেপ্টেম্বর। দুপুরে মাঠে কাজ করছিলেন বছর ৪০ এর ডেমে ওরাম। কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁকে খবর দেয়, গ্রামে পুলিশ ঢুকেছে, লাইনের দিকে গেছে। গ্রামের পাশ দিয়েই রেল লাইন। স্টিল প্ল্যান্টের জিনিসপত্র এই লাইন দিয়েই যাতায়াত করে। কিন্তু পুলিশ কেন?
জানা যায়, ঝাড়খণ্ডে আদানির গোড্ডা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ওড়িশার ধামরা বন্দর থেকে কয়লা আনা হবে। সিঙ্গল লাইনে কাজ চলবে না, তাই চাই ডাবল লাইন। সেই জন্যই পুলিশ বাহিনী নিয়ে গ্রামে লাইন পাতার কাজ করতে এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেল। কিন্তু এলাকার বিপুল পরিমাণ জমি, যা ইতিমধ্যেই অধিগ্রহণ করে ফেলেছে সরকার, তার নথি কোথায়? কারা পেয়েছেন ক্ষতিপূরণ? কোন নিয়মে তা দেওয়া হয়েছে? কিছুই জানেন না আদিবাসীরা। শুধু বছরের পর বছর ধরে তাঁদের ঠাঁইচ্যুত হতে হয়েছে।
কিন্তু এবার আর না। ৩ সেপ্টেম্বর কাজ শুরুর আগেই ডেমের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা কর্মীদের ঘেরাও করে ফেলেন। দাবি করেন, অধিগ্রহণ কী নিয়মে হয়েছিল, তার ক্ষতিপূরণ কারা পেয়েছেন, তা নিয়ে সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ না করলে এবং স্থানীয়দের দাবি দাওয়া পূরণ না করা পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে। আশেপাশের ১২ টি গ্রামের ২০ হাজার বাসিন্দা লাইন পাতার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয়দের নিয়ে তৈরি করা আঞ্চলিক সুরক্ষা সমিতি।
অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনি থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজ এসে ভিড়বে ওড়িশার ধামরা পোর্টে। তারপর তা মালগাড়ি করে আনা হবে গোড্ডার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, অস্ট্রেলিয়ার কয়লা খনি কিংবা গোড্ডার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দুটোই গৌতম আদানির সংস্থার। গোড্ডায় তৈরি বিদ্যুৎ সরাসরি বিক্রি হবে বাংলাদেশে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তাঁদের বারবার বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু ন্যায্য ক্ষতিপূরণ তো দূর অস্ত, কিছুই পাননি। এই এলাকা দিয়ে যখন প্রথম রেল লাইন পাতা হয় তখন বহু মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল। তারপর থেকে উচ্ছেদের ট্র্যাডিশনে যেমন ছেদ পড়েনি, ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগও জোরালো হয়েছে।
আন্দোলনের নেতা ডেমে ওরাম বলছেন, সমস্ত নিয়ম কানুন ভেঙে আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এমনকী ওড়িশা সরকার এবং ন্যাশনাল কমিশন ফর শিডিউলড ট্রাইবসের রায়ও অমান্য করা হয়েছে। ডেমে ওরামের অভিযোগ, এই দুই রায়ে সাফ বলা আছে, জমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ একর জমি এবং রেলের কারণে উচ্ছেদ হতে হলে অতিরিক্ত হিসেবে রেলে একজনের চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত একজনকেও পাবেন না, যে ক্ষতিপূরণ বা চাকরি পেয়েছে। এ নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে পর্যন্ত সিন্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তাও উড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
ডেমে ওরামের অভিযোগ, আদানির শিল্প সংস্থার প্রয়োজনে তড়িঘড়ি লাইন পাতার কাজ করতে যাচ্ছে রেল। পুলিশ পাহারায় কর্মীরা আর্থ মুভার, যন্ত্রপাতি নিয়ে এলাকায় ঘুরছেন। এখন আমাদের বিরোধের সামনে সুবিধা করতে না পারলেও, বারবার ওরা ফিরে যাবে না। ডেমে ওরামের বক্তব্য, আদিবাসীদের দাবিদাওয়া না মিটলে কাজ করতে দেওয়া হবে না। তাতে যদি গুলি চলে? মরতে ভয় পাই না, সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন আদিবাসীদের নেতা ডেমে ওরাম।
জীবন যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে ডেমে ওরাম জানাচ্ছেন, এই ৪ হাজার একর এলাকার ১২ টি গ্রামের ২০ হাজার বাসিন্দা। তাঁদের প্রত্যেকের একই অভিজ্ঞতা। রাষ্ট্রের উন্নয়নের ঠেলায় প্রত্যেককে বারবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। কিন্তু মেলেনি কোনও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ।
পুলিশ ও রেলের তরফে প্রতিদিনই বাহিনী পাঠিয়ে গরিব গ্রামবাসীর উপর চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ ডেমের। বৃহস্পতিবার সকালেও তাঁর ঘরের সামনে পুলিশের আনাগোনা চলছে। আমরা কোনও কথা শুনতে রাজি নই। সরকার জানাক, এতদিন ধরে বারবার উচ্ছেদ হওয়ার কারণে আমাদের কী কী পাওয়ার কথা ছিল ও কী কী পাইনি। তারপর লাইন পাতা নিয়ে ভাবা যাবে। বলে দেন আদিবাসী আন্দোলনের নেতা ডেমে ওরাম।
Comments are closed.