বহু মানুষ অভুক্ত অবস্থায় দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবতে পারেন, তাঁদের সুরক্ষিত রাখতেই হবে: অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি, রঘুরাম রাজন
সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লকডাউন এবং এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দরিদ্র জনসংখ্যার অবস্থা নিয়ে লিখেছেন ৩ ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং রঘুরাম রাজন। বাতলে দিয়েছেন কী উপায়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর পেটেও খাবার পৌঁছতে পারে সরকার।
টাকা হোক কিংবা খাদ্য, বড় আকারের সরকারি কোনও হস্তান্তরের বিষয় এলেই ভারতে আমরা বরাবর বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি সেই প্রক্রিয়া ভুল হাতে পড়ল কি না তা নিয়ে। করদাতাদের টাকা লুঠে এভাবে অনেককেই বড়লোক হতে দেখেছি। তবে তাও বলব, সরকার পরিচালিত হোটেল এবং লাক্সারি ক্রজের চেয়ে এটা ঢের ভালো। আসলে এমন একটা সময়, যখন মহামারির জেরে বিশ্ব অর্থনীতি অভূতপূর্ব এক সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, দেশে দেশে চলছে লকডাউন, তখন হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে, এটা ভেবে চুপ করে বসে থাকা আরও বড় ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে।
ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে, লকডাউন এখনও কিছু সময় চলবে। হয় তা সামগ্রিক লকডাউনের চেহারা নেবে কিংবা স্থানীয়ভাবে চলবে। এখন এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ, বিরাট সংখ্যক মানুষ আরও দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবেন, অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটবে তাঁদের। আর এই দুঃখজনক ঘটনাই ডেকে আনবে লকডাউন অমান্য করার মতো মানসিকতা। যে সমস্ত মানুষের পেটে ভাত নেই, তাঁদের হারানোর আর কিই বা আছে। এই পরিস্থিতিতে একটা কথা সেই মানুষগুলোকে বোঝানোর দায় কিন্তু আমাদের উপরই বর্তায়, যে সমাজ তাঁদের কথা চিন্তা করে এবং তাঁদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে সক্ষম।
তাহলে কী করতে হবে?
উত্তর দিচ্ছেন নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন।
ত্রয়ী লিখছেন, এটা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান আমাদের হাতেই মজুত। এবছর মার্চের হিসেব অনুযায়ী, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদামে ৭৭ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। অন্যান্য বছর এই সময় এত পরিমাণ শস্য থাকে না এবং বর্তমানে মজুত শস্যের পরিমাণ ভাণ্ডারের বাফার স্টক নর্মসের ৩ গুণেরও বেশি। রবি শস্য আসার সময় চলে এল, ফলে সেই ভাণ্ডার আরও ফুলেফেঁপে উঠবে বলাই বাহুল্য। করোনা মহামারির মতো জাতীয় বিপর্যয়ের সময় সেই মজুত ভাণ্ডার থেকে কিছুটা খাদ্য বিলিয়ে দেওয়াই অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে কোনও বিচক্ষণ সরকার সেই কাজ করবে।
অবশ্য সরকার মজুত শস্য ব্যবহারের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সদিচ্ছা দেখিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে প্রতি মাসে ৫ কেজি করে রেশন দেওয়া হচ্ছে। আগামী ৩ মাস তা চলবে। কিন্তু ৩ মাস যথেষ্ট নয়। লকডাউন যদি এখন শেষও হয়ে যায়, তাও অর্থনীতির ছন্দে ফিরতে সময় লাগবে। এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল, গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের বিরাট অংশ রেশন ব্যবস্থার বাইরে। এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং রঘুরাম রাজন।
তাঁরা বলছেন, ছোট্ট রাজ্য ঝাড়খণ্ডের কথা। সেখানে রেশন কার্ডের জন্য ৭ লক্ষ আবেদন পড়ে আছে। স্বভাবতই এই ৭ লক্ষ লোক রেশন দোকান থেকে সরকারি রেশন তুলতে পারবেন না। ৩ অর্থনীতিবিদ বলছেন, কঠোর আইন ভালো কিন্তু সঙ্কটের মুহূর্তে কাঠিন্য বজায় রাখলে বিপদ বাড়বে। এই সময় সবচেয়ে দরকার যেটা তা হল, সাময়িক রেশন কার্ড ইস্যু করা, অন্তত ৬ মাসের জন্য হলেও। কারণ রেশন কার্ড নেই, এমন জনসংখ্যাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায়।
এই প্রক্রিয়ার নানাবিধ তাৎপর্য রয়েছে।
প্রথমত, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে একজনও যেন অভুক্ত না থাকে। পাশাপাশি প্রয়োজন পাবলিক ক্যান্টিন। পরিযায়ী শ্রমিক এবং অন্যান্য মানুষ সেখানে খাওয়া পাবেন। এছাড়া যে সমস্ত বাচ্চারা এখন ঘরবন্দি, তাঁদের জন্য স্কুল মিল বা মিড ডে মিল বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। অবশ্য বেশ কয়েকটি রাজ্য এটা করা শুরুও করে দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। কার পেটে ভাত পড়েনি খুঁজতে প্রয়োজনে স্থানীয় এনজিওকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ এই এনজিওগুলোর কাছে থাকে এলাকায় সবচেয়ে দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্যের খোঁজখবর। লিখছেন দুই নোবেলজয়ী এবং আরবিআইয়ের প্রাক্তন গভর্নর।
দ্বিতীয়ত, পেটের খিদে একটি অন্যতম চিন্তা ঠিকই কিন্তু আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়াও কম বড় সমস্যা না। যদি ধরে নেওয়া যায়, যে খাবার পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। তাহলেও একটি চিন্তা যায় না, তা হল এই খাবার যাঁরা উৎপাদন করছেন, সেই কৃষকদের হাতে বীজ-সার কেনার মতো যথেষ্ট টাকা আছে তো? দোকানদারদের ভাবতে হবে কীভাবে দোকান আবার মালপত্র দিয়ে সাজিয়ে তুলবেন। অনেকেই চিন্তিত কীভাবে তাঁরা আগে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করবেন। সমাজ এবং সমাজের অংশ হিসেবে আমাদের এই দুশ্চিন্তাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় আছে কি?
সরকার খানিকটা হলেও সমস্যাটা বুঝতে পারছে বলে মনে হয়। বিশেষ কিছু শ্রেণিকে নগদ হস্তান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ খুবই কম এবং এর সুবিধা পেতে চলেছে খুবই সামান্য অংশের মানুষ। কেবলমাত্র কৃষকদের এই আওতায় রাখা হয়েছে। ৩ অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ভূমিহীন খেতমজুরদের বাদ দেওয়া হল? বিশেষ করে যেখানে ১০০ দিনের কাজ লকডাউনের জেরে কার্যত বন্ধ। এবং অতি অবশ্যই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে শহুরে গরিবদের দিকে।
এই পর্যায়ে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা সিনিয়র কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের পরামর্শকে প্রথম সঠিক ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেন, ব্যানার্জি, রাজন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, ১০০ দিনের কাজ, জনধন অ্যাকাউন্ট কিংবা উজ্জ্বলা যোজনা যে একশো শতাংশ সঠিক, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন গবেষণা দেখিয়েছে, এর মাধ্যমে সবচেয়ে গরিব মানুষের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না। তাই একজনকেও অভুক্ত না রাখার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান বহাল রাখতে হবে। যাতে প্রকৃত অর্থেই প্রত্যেকটি পেটে ভাত যোগানো সম্ভব হয়। এখন আমাদের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী কয়েকমাসে রাজকোষ সংস্থান আরও বাড়ানোর দাবি জোরদার হবে। এই সময় আমাদের খুব বিবেচনা করে খরচ করতে হবে। কিন্তু তা বলে সত্যিকারের প্রয়োজন যাঁর, সেই গরিব, প্রান্তিক মানুষের জন্য খরচ করা কমিয়ে দিলে করোনাভাইরাসকে হারানোর খেলায় আমরাই হারিয়ে যাব।
Comments are closed.