বাচ্চাকে টিবি রোধের ভ্যাকসিন দিয়েছেন তো? এই ভ্যাকসিনই কি করোনা থেকে বাঁচাচ্ছে ভারতকে? গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য
চিনের উহান থেকে শুরু হয়ে করোনাভাইরাস থাবা বসিয়েছে বেশিরভাগ দেশে। কীভাবে রোধ করা যাবে এই মারণ ভাইরাসকে, তা এখনও অজানা। টিকাহীন অবস্থায় কোনও মতেই ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যু। এই খবর লেখা পর্যন্ত বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে ৭০ হাজারের বেশি মানুষের। আক্রান্ত প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ।
মানব সভ্যতা যখন থমকে দাঁড়িয়ে করোনা-ত্রাসের সামনে, তখন বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিক তৈরিতে। সেই গবেষণা চলাকালীনই সামনে এল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তা হল, টিবি বা যক্ষা রুখতে যে ভ্যাকসিনের ব্যবহার ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশেই বহুল প্রচলিত, সেই BCG (Bacillus Calmette–Guérin) ভ্যাকসিন কি গেম চেঞ্জার হতে চলেছে?
এই প্রশ্ন উঠছে, নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা NYIT এর একটি অপ্রকাশিত রিপোর্টকে ঘিরে। সেই রিপোর্টে আমেরিকা ও ইতালির উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে, যে সব দেশে জন্মের সময় শিশুদের BCG ভ্যাকসিন দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত, সেখানে করোনার প্রকোপে মৃত্যু হার তুলনামূলকভাবে কম।
NYIT এর বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর গঞ্জালো ওটাজুর নেতৃত্বে একদল গবেষক এ বিষয়ে গবেষণা করছেন। সেই গবেষণাতেই উঠে এসেছে এই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া তথ্য। তাঁরা বলছেন, যে সমস্ত দেশে BCG ভ্যাকসিন সর্বজনীন নীতি হিসেবে গৃহীত নয়, যেমন ইতালি, নেদারল্যান্ডস কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার সেই দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই বেশি, যেখানে শিশু জন্মের পরই বাধ্যতামূলকভাবে BCG ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
৬ এপ্রিল, সোমবার বেলা ১২ টার হিসেব অনুযায়ী, আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৩ লক্ষ ছোঁয়ার পথে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের। অন্যদিকে, ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়েছে ১ লক্ষ ২৮ হাজার। কেবলমাত্র ইতালিতেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের। একই অবস্থা নেদারল্যান্ডসেরও। সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। মৃতের সংখ্যা ১,৭৬৬।
NYIT এর গবেষণা রিপোর্টে উঠে এসেছে, করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে BCG ভ্যাকসিন গেম চেঞ্জার হতে পারে।
১৯৪৮ সালে BCG ভ্যাকসিনকে বাধ্যতামূলক করে ভারত সরকার। সেই সময় দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি টিবি আক্রান্তের বাস ছিল ভারতে। তারপরের বছরগুলোতে টিবিকে কবজা করা গেলেও বন্ধ করা হয়নি BCG ভ্যাকসিন প্রকল্প। ফলে জন্মের পর আজও প্রতিটি ভারতীয়কে BCG ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে অবশ্য ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এখনই উল্লাসে নারাজ। তাঁদের দাবি, প্রতিটি ছোট ছোট অগ্রগতিতেই অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। তাই এখনই এ নিয়ে বলার সময় আসেনি। এটুকুই কেবল বলা যায়, BCG ভ্যাকসিন করোনা মোকাবিলায় একটি রূপোলি রেখা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
পঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ অ্যাপ্লায়েড মেডিক্যাল সায়েন্সেসের সিনিয়র ডিন মনিকা গুলাটির বক্তব্য, সার্স ভাইরাসও মূলত করোনা ভাইরাস গোত্রেরই। তাই এক্ষেত্রে আশার আলো হল, করোনাভাইরাস মহামারি BCG ভ্যাকসিন চালু থাকা দেশে ততটা ব্যাপক আকার নিতে পারেনি।
এই মুহূর্তে COVID 19 মোকাবিলায় কোনও গ্রহণযোগ্য দাওয়াইয়ের অনুপস্থিতিতে আশার আলো জাগছে BCG ভ্যাকসিনকে ঘিরে। দেখা যাচ্ছে, যে দেশে BCG ভ্যাকসিন ব্যবস্থা যত পুরনো, সেখানে করোনায় মৃত্যুহার তত কম।
কী রকম?
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরানের কথা। ১৯৮৪ সাল থেকে সে দেশে BCG ভ্যাকসিন ব্যবস্থা চালু আছে। সেখানে করোনার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। ইরানে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষে করোনায় মৃত্যুহার ১৯.৭।
উল্টোদিকে, জাপানে এই ভ্যাকসিন সর্বজনীন করা হয় ১৯৪৭ সালে। সেখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। জাপানে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ০.২৮।
একইভাবে ব্রাজিলে এই ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করা হয় ১৯২০ সালে। সেখানে মৃত্যুহার আরও কম। পেলে, রোনাল্ডোর দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ০.০৫৫৭৩।
কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশে এই ভ্যাকসিন না দেওয়ার কারণ কী? রিপোর্টে বলা হয়েছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর বেশিরভাগেরই একটা সময় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক BCG ভ্যাকসিন ছিল। কিন্তু ১৯৬৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আস্তে আস্তে তা উঠে যায়। কারণ, সেই দেশগুলোতে টিবি রোগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বলে দাবি। গবেষণায় উঠে এসেছে, এক সময় বিশ্বের মোট ১৮০ টি দেশে BCG ভ্যাকসিনে চালু ছিল। ১৫৭ টি দেশ ইতিমধ্যেই সেই ব্যবস্থা চালু রাখছে বলে জানা গিয়েছে।
মনিকা গুলাটি বলছেন, ব্যাপারটা এরকম নয় যে BCG ভ্যাকসিনে করোনা সেরে যাবে। তবে রোগের প্রাবল্য কমাতে তা সাহায্য করছে, এটা আপাতত মনে হচ্ছে। তাহলে কি BCG ভ্যাকসিনই হয়ে উঠতে চলেছে করোনার ব্রহ্মাস্ত্র? নাওয়া খাওয়া ভুলে সেই পরীক্ষায় ব্যস্ত বিশ্বের বিজ্ঞানীরা।
Comments are closed.