মাদুরো সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত জারি আমেরিকারঃ ভেনেজুয়েলায় ব্ল্যাক আউট, দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা, নামল সেনা

৪৮ ঘণ্টার ব্ল্যাক আউটের পর ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। একদিকে নিকোলাস মাদুরো, অন্যদিকে বিরোধী নেতা জুয়ান গুয়াইডোর সমর্থকেরা শনিবার থেকেই পথে নেমে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার। ভেনেজুয়েলার বেশিরভাগ অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় দেশের দক্ষিণাংশের গুরি হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট থেকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার আচমকাই বসে যায় পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি। রাতারাতি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে দেশের ২৩ টি প্রদেশ। এই প্রেক্ষিতেই আমেরিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ। ট্রাম্প প্রশাসনের কলকাঠি নাড়ার জন্যই ব্ল্যাক আউটের শিকার ভেনেজুয়েলা, দাবি করেন লোপেজ। কিন্তু সরকারের এই দাবি মানতে চায়নি বিরোধী নেতা তথা মার্কিন মদতপুষ্ট জুয়ান গুয়াইডোর অনুগামীরা। তাদের অভিযোগ ছিল, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই ব্ল্যাক আউটের কারণ। আমেরিকার এতে কোনও হাত নেই। এই দাবিতে মাদুরো সরকারের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করেন গুয়াইডোর অনুগামীরা। কারাকাসের সভা থেকে জুয়ান গুয়াইডো ঘোষণা করে দেন, মাদুরো সরকারকে উৎখাত করার খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা। পাল্টা শনিবার থেকে মার্কিন বিরোধী অবস্থান আরও কঠোর করে পথে নামেন মাদুরোর অনুগামীরাও।
এদিকে টানা ৪৮ ঘণ্টার ব্ল্যাক আউটের জেরে কার্যত ভেঙে পড়েছে গোটা ভেনেজুয়েলার স্বাস্থ্য পরিষেবা। কারাকাসের প্রসূতি চিকিৎসা কেন্দ্রে বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে পরিষেবা। মাঝে জেনারেটার চালিয়ে কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
২৪ বছরের মারিয়া জারাতে নিজের সাত মাসের ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন জোস ম্যানুয়েল ডি লস রিয়োস হাসপাতালে। তখনই অন্ধকার হয়ে যায় সারাদেশ। ‘ওয়েটিং লাউঞ্জ থেকে ভিতরে ঢোকার সময় হঠাৎই সব অন্ধকার হয়ে গেল। চারদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল কারণ কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। আমি ছেলেকে নিয়ে একটি কোণে দাঁড়িয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেও যখন জেনারেটর চলল না তখন বুঝতে পারলাম এটা সাধারণ কোনও ব্যাপার না।’ বলছিলেন ছেলে কোলে মারিয়া।
এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটির খবর পাওয়া গিয়েছে সেই কারাকাস থেকেই। হাসপাতালে একটি অস্ত্রোপচার চলাকালীন ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটে। তারপর জেনারেটর চালানো হয়, কিন্তু জেনারেটরও একটা নির্দিষ্ট সময় পর বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ বিদ্যুৎ সরবরাহ তখনও শুরু না হওয়ায় মাঝপথেই থেমে যায় ৩৪ বছরের যুবকের হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার। অপারেশন থিয়েটারেই মৃত্যু হয় তাঁর।
তবে শুধু স্বাস্থ্যই নয়, ব্ল্যাক আউটের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্যান্য জরুরি ক্ষেত্রগুলিও। দেশের ব্যাঙ্কিং পুরোপুরি বিপর্যস্ত।
সাধারণ মানুষের সমর্থনে তৈরি নিকোলাস মাদুরো সরকারকে পদ থেকে হঠাতে তৎপর হয়েছে আমেরিকা। তাকে সমর্থন দিয়েছে পশ্চিমী দেশগুলোর কয়েকটি। বিরোধী নেতা জুয়ান গুয়াইডোর সঙ্গে রয়েছে সরাসরি মার্কিন সমর্থন। তিনি ভেনেজুয়েলায় সরকার ফেলার চেষ্টা করছেন বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। মাদুরোপন্থীদের বক্তব্য, এভাবে বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিয়ে সরকারের উপর পরোক্ষে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে আমেরিকা। অন্যদিকে বিরোধী গুয়াইডোর দাবি, স্রেফ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই গুরি হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্টের আজ এই অবস্থা। সরকারকেই ব্ল্যাক আউটের দায় নিতে হবে।
তবে সারা বিশ্বেই মার্কিন গেমপ্ল্যানের বিরোধিতা করে মাদুরোর প্রতি সমর্থন ক্রমেই বাড়ছে বলে দাবি মাদুরোপন্থীদের। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস মাদুরোর সমর্থনে ট্যুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভীতুর মত এই সমস্ত জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ হোক’।
এদিন মাদুরোর অনুগামীরাও পথে নামেন। আমেরিকা বিরোধী পোস্টারে-ব্যানারে ছয়লাপ ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাস। ২২ বছরের গবেষক অস্কার ওরামাসের অভিযোগ, আমেরিকা একটি দেশকে অশান্ত করতে ব্ল্যাক আউটের আশ্রয় নিল আর ক্ষমতায় বসার লোভে সেই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হল এই দেশেরই একটি অংশ থেকে। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? তাঁর দাবি, বিদ্যুতের অভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় নেবে কে? প্রশ্ন সদ্য যুবক অস্কারের। এভাবে সরকার ফেলা যাবে না বরং তা আরও শক্তিশালী হবে, মন্তব্য আন্দোলনরত পড়ুয়া অস্কারের।
এই গোটা ঘটনা চলাকালীন নিকোলাস মাদুরোর কোনও বক্তব্য শোনা যায়নি। শনিবার মাদুরোপন্থীদের সবচেয়ে বড় জনসভায় প্রথমবার মুখ খোলেন নিকোলাস। নাম না করে আমেরিকাকে তীব্র আক্রমণ শানান তিনি। তাৎপর্যপূর্ণভাবে তিনি বলেন, ‘পর্দার ঠিক পিছনে কে স্ক্রিপ্ট হাতে দাঁড়িয়ে, তা বুঝতে পারছি। আমাদের লড়াই পর্দার ওই নেপথ্যচারীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিগত দু’দশক ধরেই তো যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আবারও একটা যুদ্ধ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলে, লড়েই তার জবাব দেব এবং বরাবরের মতোই এবারও আমরাই জিতব।’

Comments are closed.