নির্ভয়া কাণ্ড: কীভাবে একসঙ্গে চার আসামীকে ফাঁসি এই প্রথমবার? জানাচ্ছেন তিহার জেলের প্রাক্তন মুখপাত্র ও আইনি পরামর্শদাতা

একসঙ্গে চার ফাঁসির জন্য প্রস্তুত তিহাড় জেল! নির্ভয়া কাণ্ডে চার আসামীর ফাঁসি হতে পারে যে কোনও সময়। কিন্তু কীভাবে তিহাড় জেলে চলছে এর প্রস্তুতি? কীভাবে একসঙ্গে চারজনের ফাঁসি কার্যকর হবে?

তিহাড় জেল
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বলে পরিচিত তিহাড় জেল ইতিহাসে এই প্রথমবার সাক্ষী হতে চলেছে একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া চারজনের ফাঁসি কার্যকর করার। পঞ্জাব সরকারের অধীনে থাকা এই জেলখানা ১৯৬৬ সালের পর দিল্লি সরকারের অধীনে চলে আসে। তিহাড় জেলে বর্তমান কয়েদি সংখ্যা ১০ হাজার ৫০০। ২০১২ সালে নির্ভয়া ধর্ষণ ও খুন কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হওয়া পবন গুপ্তা, মুকেশ সিংহ, অক্ষয় সিংহ ও বিনয় শর্মার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা এই জেলেই।

নির্ভয়া মামলা
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বছর তেইশের প্যারা মেডিক্যালের ছাত্রীকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয় দিল্লিতে। ওই নৃশংসতা সারা দেশকে স্তম্ভিত করে দেয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় ছয় আসামীর মধ্যে একজন নাবালক হওয়ায় জুভেনাইল কোর্টে বিচার হয় তার। তিন বছর পরেই তার মুক্তি হয়ে যায়। রাম সিংহ নামে অন্য এক আসামী তিহাড় জেলের মধ্যেই আত্মহত্যা করে। বাকি চার অপরাধী পবন গুপ্তা, মুকেশ সিংহ, অক্ষয় সিংহ ও বিনয় শর্মার ফাঁসির পরোয়ানা জারি হয়েছে।

ফাঁসি কার্যকরের জন্য কীভাবে তৈরি হচ্ছে তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ
আইনি জটিলতায় দু’বার পিছিয়ে গিয়েছে নির্ভয়া মামলার সাজাপ্রাপ্তদের ফাঁসি। তবে তিহাড় বা ভারতের অন্য কোনও জেলেই এর আগে একইসঙ্গে চার দোষীর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। অন্তত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তো নয়ই। এখনও পর্যন্ত একসঙ্গে দু’জনের ফাঁসি দেওয়ার নজির রয়েছে জেলে। এই প্রথম একসঙ্গে চারজনের ফাঁসি কার্যকর করতে কীভাবে তৈরি হচ্ছে তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ?
তিহাড় জেলের প্রাক্তন মুখপাত্র তথা আইনি পরামর্শদাতা সুনীল গুপ্তার সঙ্গে এই ফাঁসির প্রস্তুতি নিয়েই কথা বলেছে The Bengal Story। ১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সুনীল গুপ্তা বিভিন্ন সূত্র ধরে জানতে পেরেছেন, কীভাবে নির্ভয়া মামলায় চার দোষীর ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে।  Black Warrant বইয়ের (সাংবাদিক সুনেত্রা চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে এই বই লিখেছেন তিনি) লেখক সুনীল গুপ্তার কার্যকালে তিহাড় জেলে মোট পাঁচবার ফাঁসি কার্যকর হয়।

১) ১৯৮২ সালে রঙ্গা ও বিল্লার ফাঁসি (১৯৭৮ সালে একই পরিবারের সদস্যদের অপহরণ ও খুন মামলা)
২) ১৯৮৪ সালে মকবুল বাটের ফাঁসি (কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ও ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা মকবুল বাট)
৩) ১৯৮৫ সালে কর্তার ও উজাগর সিংহের ফাঁসি (নিজের স্ত্রীকে হত্যা করতে এক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের সুপারি কিলার নিয়োগ করার মামলা)
৪) ১৯৮৯ সালে সতবন্ত ও কেহর সিংহের ফাঁসি (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যা মামলা) এবং
৫) ২০১৩ সালে আফজল গুরুর ফাঁসি (২০০১ সালে সংসদ হামলায় দোষী সাব্যস্ত)

সুনীল গুপ্তা জানান, এর আগে চার দোষীর এক সঙ্গে ফাঁসি না হলেও, তার ব্যবস্থা করা তিহাড় জেলের পক্ষে তেমন কঠিন কিছু নয়। মূলতঃ দুটি জায়গায় এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে। প্রথমত, যে ডায়ামিটারের উপর এই ফাঁসি কার্যকর হবে তা আরও বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, যে পাটাতনের উপর এই ফাঁসি হবে তার প্রস্থ বাড়ানো। নির্ভয়া মামলার চার দোষীর ফাঁসি দেওয়ার জন্য এই কাজ ইতিমধ্যেই সেরে ফেলছে তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ।
দু’জনের ক্ষেত্রে ফাঁসির সময় পাটাতনের দু’দিকে দু’জনকে দাঁড় করানো হয়। চারজনের ফাঁসির সময় এক এক দিকে দু’জন করে দাঁড় করানো হবে। কিন্তু ফাঁসির সময় মূল কাজ লিভার টানা, তা একই থাকে। অর্থাৎ, পাটাতনের দু’দিকে দু’জন করে দাঁড় করিয়ে ফাঁসুড়েকে একবারই লিভার টানতে হবে। তাতেই পুরো পাটাতন সরে গিয়ে ফাঁসি কার্যকর হবে।

ফাঁসি সংক্রান্ত অস্বস্তিকর কিছু তথ্য
যাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে এবং যাঁরা সেই সময় উপস্থিত থাকছেন, দুই তরফের কাছেই ফাঁসি দেওয়ার সময়টা ভয়ঙ্কর এবং অস্বস্তিকর। কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী, ফাঁসির সময় ১০ জন কনস্টেবল, দু’জন হেড কনস্টেবল অথবা দু’জন কারারক্ষী উপস্থিত থাকেন। তা ছাড়া থাকেন একজন চিকিৎসক, যিনি ফাঁসির পর আসামীর মৃত্যু সুনিশ্চিত করবেন। একজন জমাদার থাকেন সংশ্লিষ্ট জায়গা পরিষ্কার করার জন্য।
সুনীল গুপ্তার কথায়, ফাঁসির আগে আসামীর ওজনের দেড় গুণের বেশি ওজনের বালির বস্তা ঝুলিয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তিহাড় জেলে এই প্রক্রিয়া একধিকবার হয়েছে। নির্ভয়া মামলায় চার দোষীর ফাঁসির জন্য উত্তরপ্রদেশের মেরঠ জেল থেকে তিহাড়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে ফাঁসুড়ে পবন জল্লাদকে। তিনিই এ সব পরীক্ষা করে নিয়েছেন। ফাঁসির দড়ি তৈরিতে বিভিন্ন ফাঁসুড়ের বিভিন্ন পদ্ধতি থাকে। দড়ির উপর মোম, মাখন কিংবা কলা ডলে মাখানো হয়। ফাঁসির দড়ির দৈর্ঘ্য নির্ভর করে কয়েদির ওজন ও উচ্চতার উপর। পাটাতন সরে যাওয়ার পর ১.৮ মিটার থেকে ২.৪ মিটারের মধ্যে ফাঁসির দড়ি ঝোলানো হয়।

সুনীল গুপ্তা জানাচ্ছেন, সাজাপ্রাপ্তদের ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি তথ্য নেওয়া হয় ফাঁসির আগে। সেই হিসেবে দড়ির দৈর্ঘ্য এবং কতটা উচ্চতায় ঝোলানো হবে সেই সব হিসেব কষা হয়। খেয়াল রাখতে হয়, কোনও অসুবিধে ও সমস্যা ছাড়া একবারেই যেন ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়। যদিও এই হিসেবনিকেশের বেশিরভাগটাই ফাঁসুড়ের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। এরপর দেহ পাঠানো হয় ময়না তদন্তের জন্য।

নির্ভয়া মামলার দোষীদের সঙ্গে সুনীল গুপ্তার কথা
সুনীল গুপ্তার বই  Black Warrant (সহ লেখক সুনেত্রা চৌধুরী, রলি বুকস থেকে প্রকাশিত) এ জেলে ফাঁসি সংক্রান্ত আরও বিশদ আলোচনা রয়েছে। নির্ভয়া মামলায় অভিযুক্ত চারজনের মধ্যে দুই দোষীর সঙ্গে গুপ্তার কথাবার্তার কথাও সেখানে উঠে এসেছে।
নির্ভয়া মামলায় ছয় আসামীর মধ্যে তিহাড় জেলের ভিতর রাম সিংহ আত্মহত্যা করছে। এক দোষী জুভেনাইল কোর্টে নিজেকে নাবালক প্রমাণ করে এখন মুক্ত। এক দোষী পবন গুপ্তা সুনীলকে জানায়, ওই গণধর্ষণে সে যুক্ত ছিল না।

Comments are closed.