লকডাউন জারির পদ্ধতি নিয়ে যখন তুঙ্গ বিতর্কে ঘাম ঝরাচ্ছে শাসক-বিরোধী, তখন সামনে এল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত দু’মাস ধরে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজপথ যাত্রা নিয়ে উত্তাল করোনা বিধ্বস্ত ভারত, জানেন সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থার কথা? সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতে ৯২% পরিযায়ী শ্রমিকই লকডাউন চলাকালীন হাতে পাননি সামান্য মজুরিটুকুও। পাশের রাজ্য মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতি তুলনায় ভালো। বলিউড নগরীর রাজ্যে ৫৯% শ্রমিক মজুরি পাননি।
দেশের প্রধান দুই শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্যে শ্রমিকদের এহেন দুরাবস্থা উঠে এসেছে দ্য সেন্টার ফর লেবার রিসার্চ (CLRA), হ্যাবিট্যাট ফোরাম (Inhaf), মশাল এবং পুণের সাবিত্রীবাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজি বিভাগের সম্মিলিত উদ্যোগে। ২৩ এপ্রিল থেকে পয়লা মের মধ্যে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে দেশের দুই প্রধান শিল্পোন্নত রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত লাখো শ্রমিকদের দুর্দশার করুণ চিত্র।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, শিল্পায়নের মাপকাঠিতে এগিয়ে থাকা দুই রাজ্য মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের মধ্যে মোদী-অমিত শাহের রাজ্যের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। সেখানে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরও বেশি হাতে পাননি কোনওরকম মজুরি বা বেতন। তার মধ্যে আবার ৬১% শ্রমিক কর্মচারী লকডাউন শুরু হতেই মালিকপক্ষের মনোভাব রাতারাতি বদলে যেতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন।
মহারাষ্ট্রে শতকরা ৫৯ জন শ্রমিকের লকডাউন শুরু হতেই বেতন বন্ধ হয়ে যায়। ৩৩% শ্রমিক কর্মচারী সমীক্ষকদের জানিয়েছেন, লকডাউন ঘোষণা হতেই মালিকপক্ষের মনোভাব বদলে যায়। ১২% অভিযোগ, লকডাউনের সময় মালিক পক্ষের তরফে কোনও সহায়তা তাঁরা পাননি।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, মহারাষ্ট্রের ৪৭% পরিযায়ী শ্রমিকই বলছেন সরকারের কাছ থেকে কোনওরকম সহায়তা তাঁরা পাননি। গুজরাতে এই সংখ্যাটা ৩৫%। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, সরকার নয় বরং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মানুষের আরও কাছে পৌঁছতে সফল হয়েছে।
গুজরাতে কাজ করতে যাওয়া মোট পরিযায়ী শ্রমিকের ৩০% এবং মহারাষ্ট্রের ৫% শ্রমিক ইতিমধ্যেই গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু এখনও তা শেষ হয়নি। আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। সমীক্ষায় উঠে এসেছে গুজরাত থেকে এখনও ৭৬% এবং মহারাষ্ট্র থেকে ৪২% পরিযায়ী শ্রমিক যে কোনও উপায়ে ফিরতে চান নিজেদের গ্রামে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গ্রামের ঠিকানা উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা বাংলা।
কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ মানুষ সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত কেন? তাও উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। সেখানে দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকেরই রয়েছে আধার কার্ড। কিন্তু নেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কিংবা রেশন কার্ড। রেশন কার্ড ছাড়া মিলবে না রেশন।
মহারাষ্ট্রে কাজের সন্ধানে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৬০% নেই কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। তেমনই গুজরাতের পরিযায়ী শ্রমিকদের শতকরা ৫৪ জনের নেই ব্যাঙ্কের খাতা। মহারাষ্ট্রে কাজ করা পরিযায়ী শ্রমিকদের যেখানে মাত্র ৫৮% হাতে রয়েছে রেশন কার্ড, সেখানে গুজরাতে কাজ করা শ্রমিক কর্মচারীদের ৪৩% নেই রেশন কার্ড। উল্টোদিকে মহারাষ্ট্রে শতকরা ৯৫ জন এবং গুজরাতে শতকরা ৯৭ জন পরিযায়ী শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁদের আধার কার্ড আছে।
কিন্তু রেশন কার্ড না থাকলে সরকারি সহায়তা মিলবে কীভাবে? এই বাস্তবের ফাঁদেই ধরা পড়েছেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। না পাচ্ছেন সরকারি রেশন, না পারছেন বাড়ি ফিরতে। সমীক্ষকরা বলছেন, পরিস্থিতি এমনই চললে অশান্তি অনিবার্য। সরকার শুনছে কি?
Comments are closed.