স্বাধীনোত্তর ভারতে ব্যক্তি স্বাধীনতা অবরোধের যদি প্রথম নিদর্শন হয় জরুরি অবস্থা তবে দ্বিতীয় পর্ব এখন চলছে। এই পর্বটি অধিকতর দীর্ঘ কারণ এই পর্ব একটি নির্বাচিত শাসক দল ও তার সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা অনুযায়ী রুটিন মেনে চলছে। তদুপরি এই পর্বের একটি সামাজিক সম্মতির লক্ষণ আছে যা অধিকতর উদ্বেগজনক। এই সম্মতিও একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে তা গড়ে উঠেছে।
১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর একটি হঠকারী ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত যা তিনি আরোপ করেছিলেন সংবিধানের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে। এই সিদ্ধান্ত ছিল ততকালীন দেশীয় রাজনীতিতে ইন্দিরার বিরোধীদের শায়েস্তা করার কৌশল। দলের মধ্যে কিছু ভিন্ন মত থাকলেও ইন্দিরা এসবকে আমল দেননি। জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল সংবিধান মেনে কিন্তু সঞ্জয় গান্ধীর যুব বাহিনীর দাপটে সেদিন প্রতিস্পর্ধী কোন স্বর তোলা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সংবাদত্রের স্বাধীনতা চূর্ণ হয়েছিল। বিশিষ্ট সাংবাদিকদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছিলেন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তের মতো সাংবাদিকদের আটক করা হয়েছিল। সংবাদপত্রের পাতায় সম্পাদকীয় কলাম ফাঁকা রাখতে হতো নয়তো শাসককে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে আনতে হতো। নির্বিচারে বিরোধী কন্ঠরোধ করা হয়েছিল। সংখ্যালঘুরাও বিপর্যস্ত বোধ করছিলেন।
এই সবেরই ফল ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের বিপর্যয়। কিন্তু বিষয়টিকে এত সহজভাবে দেখলে হবে না। ইন্দিরা জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তাঁর একক শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সশস্ত্র নকশাল আন্দোলন, অন্যদিকে সারা দেশজুড়ে মূলত পুরোনো কংগ্রেসিদের নেতৃত্বে ইন্দিরা বিরোধী আন্দোলন। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর ইন্দিরার জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে সেই সময়েই তিনি কতগুলো ভুল করে বসলেন। রাজন্য ভাতা বিলোপ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মতো জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিলেও স্বাধীণতা যোদ্ধা যেসব প্রবীণ কংগ্রেসী ছিলেন তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিলেন না। শুধু প্রশাসনকেই বশংবদ করলেন না তার সাথে চাইলেন বিচার ব্যবস্থাও সরকারের প্রতি কমিটেড হবে। সামান্য বিচ্যুতিও সহ্য করার মতো সহিষ্ণুতাও জওহরলাল কন্যার ছিল না। ১৯৭৩ সালে কেশবনন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি জানিয়ে দিল যে সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করা যাবে না। ওই বিচারের ক্ষেত্রে যে সাংবিধানিক বেঞ্চ হয়েছিল তাতে সরকারের হয়ে যে কজন বিচারপতি বলেছিলেন তাঁদেরই একজন কিছু জুনিয়র হলেও তাঁকেই প্রধান বিচারপতি করে দিলেন ইন্দিরা। ১৯৭৬ সালে সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করলেন যে রাষ্ট্রপতির আর বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকাই রইল না।
এসবের বিরুদ্ধে পুরোনো কংগ্রেসি এবং যুব সম্প্রদায়ের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন যা স্বাধীনোত্তর ভারতে একটি মাইল ফলক। জয়প্রকাশ একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী, অন্যদিকে ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ইন্দিরা বিরোধী। তিনি সমস্ত ইন্দিরা বিরোধী সংগঠন ও দলকেই একজোট করতে পেরেছিলেন। এমনকী সঙ্ঘ পরিবারকেও নিয়ে এসেছিলেন নিজের ছাতার তলায়। জনসঙ্ঘ মিশে গেল জনতা পার্টিতে। ফলত ইন্দিরা একইভাবে কিছুটা পারিবারিক শক্তি ও অবিন্যস্ত দল নিয়ে সামলে উঠতে পারলেন না। পরাস্ত হলেন।
২০১৯ এ নরেন্দ্র মোদি কি পরাস্ত হবেন? অথচ দেখুন, তাঁর জমানার সাথে জরুরি অবস্থার কি অনবদ্য মিল। দল বা আদর্শকেও নিজের মতো করে করায়ত্ত করেছেন মোদি। পুরোনো যেসব নেতা, যেমন আদবানি বা মূরলীমনোহর, বিজেপির জনভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের কার্যত অপমান করে বসিয়ে দিয়েছেন মোদি। অন্য মতের দলীয় সতীর্থদেরও কোণঠাসা করে ফেলেছেন। বিচারবিভাগকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্বাধীণতার পর এই প্রথম সুপ্রিম কোর্টের এতজন বিচারপতি একসাথে প্রতিবাদ করেছেন। বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুরহস্য সম্পর্কে আমরা অন্ধকারে। একক সিদ্ধান্তে বিমুদ্রাকরণের মতো একটি ভ্রান্ত ঘোষণা করেছিলেন মোদি। এর ফলে অগণিত সাধারণ মানুষের তুমুল হয়রানি শুধু হয়নি, একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতাও ভূলুন্ঠিত হয়েছিল। সংখ্যালঘুরা নতুন করে বিপর্যস্ত বোধ করছেন। জরুরি অবস্থার সময়ে যে সঙ্ঘীরা ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছিলেন তাঁরাই আজ সবাইকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে সেই স্বাধীনতা হরণ করছেন। জরুরি অবস্থার সময়ে কালা কানুন জারি করে গ্রেফতার করা হত। আর এখন ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা। গৌরী লঙ্কেশকে মারার পর কোন উল্লেখযোগ্য বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী রাখলেন না। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি বিরোধীদের সাপ, কুকুর ইত্যাদির সাথে তুলনা করছেন। মনোভাব ফ্যাসিস্ততুল্য এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু বিরুদ্ধে সেরকম একত্রিত লড়াই কোথায়? বামপন্থীরা এখনও মূল শত্রু চিহ্নিত করে উঠতে পারেননি। ফলে তাঁরা কী ভূমিকা নেবেন তা নিশ্চিত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করছেন সবাইকে একজোট করতে। কিন্তু তৃতীয় ফ্রন্টের মতো কিছু করলে বিজেপিই লাভবান হবে। কেননা চন্দ্র বাবু নাইডু, রামবিলাস পাসোয়ানদের মতো ব্যক্তিদের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সমস্ত দলগুলিকে আগে নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে সংগঠিত আন্দোলনে নামাতে হবে তবেই জনচিত্তে আলোড়ন উঠবে।
জয়প্রকাশকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্য চালাতে হত না। সারাদেশে দৌড়ে বাড়ানোর সময় তিনি পেতেন। মমতা চেষ্টা করছেন সবাইকে একজোট করার। কিন্তু তিনি মুখ্যমন্ত্রী। বহু প্রশাসনিক দায় দায়িত্ব বহন করতে হয়। সেসব কাটিয়ে এই ঐতিহাসিক কালপর্বে তিনি কতটা সফল হতে পারেন সেটাই দেখার।