১৯৮১ সাল থেকে তিহাড় জেলের সঙ্গে যোগ সুনীল গুপ্তার। প্রথমে জেল সুপার তারপর পদোন্নতি পেয়ে শেষপর্যন্ত জেলের মুখপাত্র ও আইনি পরমর্শদাতা। তিহাড়ে কাজ করার সময় সুনীল গুপ্তার সঙ্গে বহুবার কথা হয়েছে নির্ভয়া কাণ্ডের অন্যতম দুই অপরাধী রাম সিংহ ও মুকেশ সিংহের। রাম সিংহ জেলেই আত্মহত্যা করেন। নির্ভয়া কাণ্ডের এক অপরাধী নাবালক অপরাধীর বিচার চলে জুভেনাইল কোর্টে, মুকেশ সিংহ সহ বাকি ৪ অপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত, এখন অপেক্ষা দিনক্ষণের। তিহাড় জেলের প্রাক্তন সুপার সুনীল গুপ্ত লিখেছেন মুকেশ সিংহের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বৃত্তান্ত এবং মৃত্যুদণ্ড নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত।
—————————————————————————————————————————————
তিহাড়ে ১৯৮১ থেকে এক টানা সাড়ে তিন দশক কাজ করতে গিয়ে ৮ জন অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি। আমি তখনও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলাম, আজও তাই আছি। কিন্তু কেন আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করছি? প্রথমত, আমার বিশ্বাস জেলখানা তৈরি হয়েছে অপরাধপ্রবণ মনকে বদলের জন্য এবং দোষীর মানসিকতা বদলানো রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু একজন দোষীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, রাষ্ট্রও তো একই অপরাধে দুষ্ট হয়ে পড়ছে। তাহলে রাষ্ট্রের অপরাধের সঙ্গে দোষীর অপরাধের পার্থক্য কোথায় হল?
এছাড়া ধার্মিক বিষয়ের কথা বলতে গেলে আমরা বলতেই পারি, জীবন দেওয়ার অধিকার না থাকলে জীবন নেওয়ার অধিকার কীভাবে পাওয়া যায়?
কেউ কেউ তর্ক জুড়তে পারেন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা খুনের অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া উচিত। কিন্তু বহু আইনজীবী এটা নিয়ে তর্ক জুড়ে দেন যে মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা খুনের ঘটনা কমাতে সাহায্য করে এমনটা প্রমাণিত নয়। আমারও বক্তব্য এটাই। পাশাপাশি আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন, ফাঁসি হয় তাদেরই যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে একটু দুর্বল কিংবা প্রান্তিক স্তরের মানুষ। বড়লোকেদের কখনও এসব হয় শুনেছেন?
এবার অপরাধের ধরনে আসি। সাধারণত বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, নির্ভয়া কাণ্ডের চেয়েও খারাপ ঘটনা কি দেশে ঘটেনি? আমি জানি এটার জন্য আমাকে অনেক আক্রমণের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু আমি এখনই অন্তত এমন দুটো ঘটনার কথা বলতে পারি, যা ধারে ও ভারে নির্ভয়ার অত্যন্ত নক্কারজনক অপরাধের চেয়েও এগিয়ে।
২০০৬ সালের নিঠারি খুন মামলা- বলা হয় এই মামলায় ৩০ জনেরও বেশি নাবালিকা ও তরুণীকে যৌন হেনস্থা এবং তারপর খুন করা হয়েছিল। তারপর মৃতদেহগুলোকে পিস পিস করে কেটে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। যার বাড়িতে গোটা ঘটনা ঘটে সেই মনিন্দর সিংহ পান্ধেরকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত কিন্তু মনিন্দরের বাড়ির কাজের লোক সুরিন্দর কোলিকে প্রায় সবকটা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কোলির মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ পরে বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কোলি এখনও সেই মামলা লড়ে যাচ্ছেন।
১৯৯৫ সালের নয়না মার্ডার কেস। তাঁর স্বামী সুশীল শর্মাকে গ্রেফতার করা হয় খুন এবং তারপর প্রমাণ লোপাটে একটি রেস্টুরেন্টের তন্দুরের ভিতর স্ত্রীয়ের লাশ ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগে। তন্দুর খুন মামলা নামেও এই ঘটনার কথা অনেকে জানেন। নিম্ন আদালত সুনীল শর্মাকে খুনে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের নির্দেশই বহাল রাখে। সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়।
আমি নির্ভয়ার মায়ের বেদনা বুঝি। কিন্তু এটা বুঝেও একটা কথা বলতে চাই, তিনি তাঁর মেয়ের গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার দোষীদের শোধরানোর একটা অন্তত সুযোগ দিতে পারতেন। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত কোনও একটি মামলায় ৪ তরুণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এমন নজির নেই। রায়দানের সময়ও দোষীর বয়সকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই মামলায় এমন হয়েছে বলে মনে হয় না। নির্ভয়া কাণ্ডে দোষী তরুণদের সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। তাদের শোধরানোর একটা সুযোগ অন্তত দেওয়া যেত বলে মনে করি।
তিহাড়ে যখন কাজ করতাম, তখন শুধুই যে রাম সিংহের, যে পরে জেলের মধ্যেই আত্মঘাতী হয়, সঙ্গেই কথা বলেছিলাম তা নয়। ওর ভাই মুকেশের সঙ্গেও কথা হতো। মুকেশ আমাকে বলেছিল, সে ধর্ষণে যুক্ত ছিল না। ওর দাদা রাম সিংহ বাস চালাচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়েছিল মুকেশ। পরে দাদা রাম সিংহ যখন তরুণীকে ধর্ষণ করতে যায়, তখন বাসের স্টিয়ারিং ধরেছিল মুকেশ সিংহ। মুকেশ আমাকে বলেছিল, ওরা সবাই মদে আচ্ছন্ন ছিল। তাই সেইসময় দাদার কথা না শুনলে আমাকে মার খেতে হত।
এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলব দুর্ভাগ্যজনক। আর সবচাইতে বড় কথা হল, মুকেশ এখন সেটা প্রমাণও করতে পারবে না। এবার দোষী সাব্যস্তদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। এই গোটা ঘটনা থেকে আমরা এটাই পেলাম। যদি একটি ধর্ষণের ঘটনা কোনও মহিলা কিংবা তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রে অমেরামতযোগ্য প্রভাব ফেলে এবং তাদের মানসিক শান্তি ও স্বাভাবিক জীবন চিরকালের জন্য নষ্ট করে দেয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রেও কি একই জিনিস হয় না? ভাবুন তো যাদের পরিবারের কারও ফাঁসি হচ্ছে কিংবা হয়ে গিয়েছে, তাদের অবস্থা। সেই পরিবারের মহিলাদের অবস্থাও কি নির্যাতিতার পরিবারের মতোই হয় না? তাঁরা কি চাইবেন না, তাদের পরিবারের দোষী ব্যক্তিটিও শোধরানোর একটা অন্তত সুযোগ পাক?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
২৮ জানুয়ারি এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশ হয় thebengalstory.com/english, মূল ইংরেজি প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Mukesh Singh told me that he wasn’t involved in Nirbhaya’s gangrape; he was driving the bus following brother Ram Singh’s instruction
Comments are closed.