লকডাউন শুরুর পর দেশের একটি দৃশ্য বহু মানুষের নজর কেড়েছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় সড়ক ধরে সার দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা। কারও মাথায় ভারি ব্যাগ, কেউ আবার কাঁধে নিয়েছেন শিশু। পিছনে লটবহর নিয়ে স্ত্রী। কেউ লাদাখ থেকে রওনা দিয়েছিলেন বিহারের সীতামারির উদ্দেশে, আবার কেউ বেঙ্গালুরু থেকে পায়ে হেঁটে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর রাজস্থান।
লকডাউন যখন শেষ সপ্তাহে প্রবেশ করল, তখন এই মানুষগুলোর জন্যই তা বয়ে আনল এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ILO বলছে, করোনাভাইরাস উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৪০ কোটি কর্মী ডুবে যেতে পারেন দারিদ্র্যের অন্ধকারে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (ILO) প্রকাশ করেছে ILO Monitor 2nd edition: COVID-19 and the world of work। যেখানে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতবড় বিপর্যয় দুনিয়া আর দেখেনি।
রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, ২০২০ সালে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে পৃথিবীতে কাজের সময় নষ্ট হবে ৬.৭ %। যা সাড়ে ১৯ কোটি কর্মীর কাজ হারানোর সমান। আর এই কোপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেমে আসবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উপরই।
সারা দুনিয়ায় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। তার মধ্যে বেশিরভাগই ভারত সহ অন্যান্য এশিয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশে। আর ভারতে মোট কর্মী সংখ্যার ৯০ শতাংশই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতিতে করোনার কোপ সবচেয়ে বেশি পড়তে চলেছে সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপরই। রিপোর্টে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে ভারতে অর্থাভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ পরিবার নিয়ে তলিয়ে যেতে পারেন দারিদ্র্যের অন্ধকারে।
অর্থাৎ একটা বিষয় পরিষ্কার, লকডাউনের শুরুতে শিশু কাঁধে মানুষের সারি জাতীয় সড়ক ধরে ভারতের গ্রামে গ্রামে, শহরে, নগরে নিজের বাড়িতে ফিরেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আর কাজে ফিরবেন না। যদিও কাজে না ফেরার কারণ ব্যক্তিগত নয়, বরং তা সামগ্রিক। লকডাউনের মধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা ঠিকা কর্মীদের ছাঁটাই শুরু করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ থাকায় সেই সম্ভাবনা আরও গাঢ় হচ্ছে।
এখানেই আসছে অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্র। যে ঠিকা শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে মুর্শিদাবাদ-জলপাইগুড়ির গ্রাম থেকে হরিয়ানা কিংবা রাজস্থানের কল-কারখানায় কাজ করতে যান, তাঁরা তা করেন অভাবের তাড়না থেকেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের জেরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আবার তাঁরা ফিরে এসেছেন গ্রামে এবং দিনের পর দিন কাজ ছেড়ে বসে থাকতে হচ্ছে কর্মস্থল থেকে হাজার কিলোমিটার দূরের বাড়িতে। সঞ্চিত অর্থে ক্রমেই টান পড়ছে। একসময় তা নিঃশেষ হবে। তখন বাংলা বা বিহারের গ্রামে বসে কেরলের হোটেলের রাঁধুনি বা গুরুগ্রামের গাড়ির অনুসারি শিল্পের ঠিকা শ্রমিক কিংবা মুম্বইয়ের নির্মাণ শ্রমিক কী করবেন? অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্র মেনে তাঁরা পরিবার নিয়ে নেমে যাবেন আরও দারিদ্রের অন্ধকারে। ILO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে এই সংখ্যাটা ৪০ কোটি।
স্বস্তির খবর নেই সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদেরও। রিপোর্ট বলছে, করোনাভাইরাসের সরাসরি প্রভাব পড়েছে যে সমস্ত সেক্টর বা পরিষেবাগুলোর উপর, তাতেও বিপুল ছাঁটাই হবে, বেতন কমবে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে কাজের সময়। ILO-এর রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে করোনা দ্বারা প্রভাবিত সংগঠিত ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করেন ১২৫ কোটি মানুষ।
তাহলে উপায় কী?
গোটা দুনিয়ার সমস্ত দেশকে এক হয়ে মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে মোকাবিলা করতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকে। বলছেন ILO-এর ডিরেক্টর জেনারেল গাই রাইডার। তাঁর মতে, মানব সভ্যতা এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। গত ৭৫ বছরে এমন অবস্থা দেখেনি দুনিয়া। এই অবস্থায় একটি মালা গাঁথার মতো করে সব দেশকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি দেশ ফেল করলেই সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়বে পুরো কাঠামো। এমন একটি সমাধান খুঁজতে হবে যাতে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষেরই উপশম হয়। মঙ্গলবার জানিয়েছেন গাই রাইডার।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে বাঁচানোর একমাত্র দাওয়াই হতে পারে গরিবের হাতে নগদের যোগান দেওয়া। তা করতে প্রয়োজনে নোট ছাপানোর পরামর্শ দিয়েছেন সদ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি। একমাত্র তাহলেই করোনা বাণের মোকাবিলায় সক্ষম হবে মানব জাতি। কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব? কী করবে সরকার, এখন এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
Comments are closed.