একজনের কি দু’বার করোনা হতে পারে? শরীরে হার্ড ইমিউনিটি কীভাবে তৈরি হবে এই মারণ ভাইরাসের মোকাবিলায়?

করোনার বিরুদ্ধে মরিয়া লড়াইয়ে গোটা দুনিয়া। এরই মধ্যে চিন এবং জাপানের দুটি ঘটনা ভয়ংকর উদ্বেগ বাড়িয়েছে বিশেষজ্ঞদের। নির্দিষ্টভাবে দু’জনের হদিশ মিলিছে, যাঁরা দু’বার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তার মানে কি, একজন করোনা থেকে সেরে উঠলে, তাঁকে ফের আক্রমণ করতে পারে এই মারণ ভাইরাস? কীভাবে তার থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব?

 

হার্ড ইমিউনিটি (Herd Immunity) কী? 

আমরা প্রথমবার যখন কোনও সংক্রমণের শিকার হই (ফাঙ্গাল, ব্যাকটেরিয়াল কিংবা ভাইরাল), আমাদের শরীরে তার বিরুদ্ধে একটা ইমিউনিটি তৈরি হয়। ফের ওই সংক্রমণের শিকার হলেও এই ইমিউনিটি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য এই ইমিউনিটির স্থায়িত্ব খুব কম সময়ের জন্য হতে পারে। যেমন, কোনও ফ্লু ভাইরাস, যা প্রতি মরসুমেই নিজেকে পাল্টাতে পারে! মানে, আপনি দুর্গা পুজোর সময় সেই ফ্লুতে আক্রান্ত হলে, আবার শীতেও একই ফ্লু-র শিকার হতে পারেন।
অন্যদিকে, আর একরকম ইমিউনিটি তৈরি হয় মানুষের শরীরে, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকে। যেমন, বেশিরভাগ মানুষ চিকেন পক্স (ভাইরাস) এর শিকার হন। কিন্তু একবার এই ভাইরাসের শিকার হলে শরীরে যে ইমিউনিটি তৈরি হয়, তাতে পরেরবার আর এই ভাইরাস আক্রমণের আশঙ্কা খুব একটা থাকে না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারও দু’বার চিকেন পক্স হয় না।
হার্ড ইমিউনিটির অনেকটা সেরকম। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রচুর সংখ্যক মানুষ যখন কোনও সংক্রমণের শিকার হন, তখন ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সেই রোগ প্রতিহত করলে, পরে একই সংক্রমণের আর তেমন প্রভাব পড়ে না। কারণ, ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের শরীরেই সেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গিয়েছে।

 

করোনা কি একই ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করতে পারে? 

করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কয়েকজন আক্রান্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আবার তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর এই কারণেই করোনা নিয়ে চিকিৎসক এবং গবেষকদের মধ্যে উদ্বেগ কমছে না। জাপানের ওসাকা এবং চিনের চেংড়ু শহরে এমনই দুটি কেস পাওয়া গিয়েছে, যা দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে গবেষকদের। এমন উদাহরণ হয়তো আরও অনেক জায়গায় রয়েছে, তা এখনই সামনে আসেনি।
একদল গবেষক বলছেন, করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও আবার ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন। যা দেখা গিয়েছে জাপানের ওসাকা এবং চিনের চেংড়ু শহরে। কারণ, দু’জনকেই বহুদিন পর্যবেক্ষণে রেখে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছিল। তারপরও তাঁরা ফের করোনায় আক্রান্ত হন। তাই এখনই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না, দ্বিতীয়বার কেউ করোনার আক্রান্ত হবেন না। গবেষকবা চিন্তিত, করোনার ক্ষেত্রে যদি মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি না হয়, তবে বিশ্বের সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে।

 

কীভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে? 

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, কোনও সংক্রমণের বিরুদ্ধে এই ইমিউনিটি তৈরি হয় দু’ভাবে। এক, প্রাকৃতিকভাবে এবং দুই, ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে।
কোনও সংক্রমণ যখন বিপুল সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করে, তখন ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে অথবা প্রাকৃতিকভাবে সেই সংক্রামক অসুখের বিরুদ্ধে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয়। ফলে পরে সেই অসুখের প্রাদুর্ভাব হলেও, তা মহামারির আকার নিয়ে পারে না। এটাই হার্ড ইমিউনিটি।
প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার কোনও ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি (যদিও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও তা সমস্ত মানুষকে দেওয়া যাবে তার কোনও কথা নেই। যদি ভ্যাকসিনের নির্দিষ্ট উপাদানে কারও অ্যালার্জি থাকে, তাতে সেই ভ্যাকসিন নাও কাজ করতে পারে। কোনও ভ্যাকসিন আবার নির্দিষ্ট বয়সের উর্ধ্বে প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া গর্ভবতী বা কোনও বিশেষ অসুখ থাকলেও অনেক ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না। যাঁদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না, সংশ্লিষ্ট সংক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা তাঁদের বেশি থাকে)। সেক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির একমাত্র রাস্তা, প্রাকৃতিকভাবে তা শরীরে তৈরি হওয়া।
এই জায়গাতেই করোনা নিয়ে বেশি চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। যতদিন না করোনার ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে, ততদিন কীভাবে এর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে, যা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবে? ব্রিটেনের চিফ সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজর জানাচ্ছেন, একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। তবেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যাবে।
গবেষক এবং চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে কত সময় লাগবে, তা এই মুহূর্তে নির্ভর করছে কত ভালোভাবে সেল্ফ আইসোলেশন এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রাখা হচ্ছে তার ওপর। চিকিৎসকরা একে বলছেন, ‘flattening the curve’। অর্থাৎ, করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেলেও, সেল্ফ আইসোলেশন এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রেখে আক্রান্তের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমাতে হবে। মানে, আক্রান্তের রেখচিত্রটা উঠতে দেওয়া যাবে না। কারণ, যত দীর্ঘ সময় ধরে সেল্ফ আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রাখা যাবে, তত অল্প মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবেন। ভাইরাসের পাদুর্ভাব থাকলেও, যত কম সংখ্যক মানুষ তাতে আক্রান্ত হবেন, ততই বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং প্রায় বছরখানেক কম-বেশি বজায় রাখা যায়, তবে একদিকে যেমন করোনার বিরুদ্ধে শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে, তেমনই বিজ্ঞানীরাও সময় পেয়ে যাবেন এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের।

Comments are closed.