করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে কার্যত অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখে মানব সভ্যতা। ইউরোপের ইতালি থেকে আমেরিকা, স্পেন, ইরান থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, করোনা তঙ্কে দমবন্ধ অবস্থা গোটা বিশ্বের। দুনিয়াজুড়ে চলছে মৃত্যু মিছিল। আতঙ্কের রেশ এসে পৌঁছেছে ভারতেও।
ইতিমধ্যেই দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে হাজার। ভারতে অতি ধীরে হলেও ক্রমশ বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ভারতে করোনাভাইরাসের স্টেজ থ্রি কি শুরু হয়ে গিয়েছে, বা তা কত দূরে? ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক বলতে শুরু করেছেন, ভারত স্টেজ ৩ তে প্রবেশ করলে তা ভয়াবহ আকার নেবে। বহু মানুষ আক্রান্ত হবেন দেশজুড়ে।
সরকার বলছে, ভারত এখনও স্টেজ টুতেই আছে। কিন্তু COVID 19 এর জন্য গঠিত টাস্ক ফোর্স ইতিমধ্যেই জোরকদমে স্টেজ থ্রি মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যও। কিন্তু জানেন কি, কী এই স্টেজ থ্রি? মারণ ভাইরাসের স্টেজগুলোই বা কী কী?
করোনাভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত এবং শেষ আক্রান্তের মধ্যবর্তী সময়কে মোট ৪ ভাগে ভাগ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হল এক একটি স্টেজ বা পর্যায়। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের মোট ৪ টি পর্যায়।
স্টেজ ১
এই পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে রোগ ছড়ায় না। এই সময়ে যাঁরা আক্রান্ত হন, দেখা গিয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্ত দেশ সফর করেছেন।
ভারতের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিনের উহান কিংবা অন্য কোনও করোনা সংক্রামিত দেশ থেকে যাঁরা সদ্য দেশে ফিরেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় করোনা পাওয়া গিয়েছে।
স্টেজ ২
এই পর্যায়ে রোগ স্থানীয়ভাবে ছড়ানো শুরু হয়। আক্রান্ত দেশ সফর করে ফেরা ব্যক্তিদের শরীর থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্যদের মধ্যে। আক্রান্ত হন তাঁদের সংস্পর্ষে আসা মানুষ। এই সময় আক্রান্ত মানুষকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো অপেক্ষাকৃত সহজ।
স্টেজ ৩
এটা করোনাভাইরাসের এমন এক স্তর, যখন সংক্রমণের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সময় এমন মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, যাঁদের বিদেশ কিংবা করোনা আক্রান্ত কোনও দেশ ভ্রমণের সাম্প্রতিক ইতিহাস নেই। এই সময় সংক্রমণের হার থাকে সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, এই সময় সমাজে অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। কিন্তু তার উৎস থাকে অজানা। ফলে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
চিনে করোনাভাইরাসের স্টেজ ৩ হিসেবে ধরা হয় মোটামুটিভাবে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে। ১২ ফেব্রুয়ারি একদিনে চিনে ১৪ হাজার ১০৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। যা এখনও পর্যন্ত চিনে সর্বোচ্চ। সেই সময় থেকে চিন স্টেজ ৩ তে প্রবেশ করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সেদিন চিনে মৃত্যু হয় ১৪৬ জনের। এই পর্যায়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি চিনে মৃত্যু হয় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষের। সেদিন সর্বোচ্চ ১৫০ জন মারা যান। এখনও পর্যন্ত চিনে ৩,৩০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গোটা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ৩৯ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে।
স্টেজ ৪
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে একমাত্র চিন এই স্তরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এই সময় সংক্রমণ হাতের বাইরে চলে যায়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। আক্রান্ত হন লক্ষ মানুষ, জারি থাকে মৃত্যু মিছিল।
এখন প্রশ্ন হল, ভারত কি স্টেজ ৩ তে প্রবেশ করে ফেলেছে? সংক্রমণ কি স্থানীয় স্তরেও এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে তার উৎস পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
বিদেশ থেকে এই ভাইরাস দেহে বহন করে দেশে ফিরে আক্রান্ত হওয়া এবং আক্রান্তের থেকে এখানকার বাসিন্দার দেহে সংক্রমণ, দুইই ভারতে ঘটে গিয়েছে। কেন্দ্র জানাচ্ছে, ভারতে এখনও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপকভাবে হয়নি, ফলে টেকনিকালি দেশে এখনও স্টেজ ৩ শুরু হয়নি। কিন্তু গত দু’তিন দিনে কিছু ঘটনা থেকে আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় সরকার। বিশেষ করে এত বড় দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হলে বা স্টেজ ৩ তে প্রবেশ করলে কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে তা চিন্তায় ফেলেছে প্রশাসনকে।
সম্প্রতি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দৈনিক ১ হাজার নতুন কেস সামলাতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠানো গড়ে তোলা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও সমস্ত জেলায় বেসরকারি হাসপাতাল অধিগ্রহণ করে সেখানে পৃথকভাবে করোনা চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছেন। সর্বাত্মকভাবে টাস্ক ফোর্সের স্টেজ থ্রির জন্য প্রস্তুতি চলছে। সব মিলিয়ে ভারতে স্টেজ ৩ নিয়ে আশঙ্কা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে।
Comments are closed.