Lockdown: সারাদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই ছ’বছরের ছেলে আর বাবা এগিয়ে আসে! বলি, তোমরা এলে কেন, দূরে যাও

লেখা আমার পেশা নয়, এই প্রথমবার, ইচ্ছে হল…
সেদিন দুপুরে অফিসে সৌগতদা (সৌগত মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র এডিটর, সিএনএন নিউজ ১৮) বলল, ‘একটু বেরোচ্ছি, কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা দেখে আসি…’
আমি বললাম, ‘কেন খাবার নিয়ে আসনি?’
‘নারে, আজ আনা হয়নি…’
‘পাবে না, আর পেলেও বাইরের খাবার খেতে হবে না, যা আছে হয়ে যাবে……’
রুটি নিয়ে এসেছিলাম, আমাদের গাড়ির চালক বিজয়, সেও রুটি নিয়ে এসেছিল। আমাদের চারজনের হয়ে গেল। আমি, সৌগতদা, আশিস, আর অফিসের সিকিউরিটি। এই কয়েকদিন অফিসে আমরা এই কয়েকজন প্রাণী এবং এখনও পর্যন্ত অদৃশ্য শত্রুর হাতের বাইরে আছি। একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের (সিএনএন নিউজ ১৮) কলকাতায় আমাদের লোক সংখ্যা খুবই কম, তাও করোনার জন্য বাকিদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রোজ সকালে গাড়ির চালক বিজয় অফিস থেকে ক্যামেরা তুলে আমাকে ঠিক সাড়ে ৮ টায় নিতে আসে। তারপর সৌগতদাকে তুলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া! কখনও বা লাইভ, আবার কখনও মহানগরের ফাঁকা রাস্তায় জরুরি পরিষেবায় নিযুক্ত নির্ভীক সৈনিকদের রোজনামচার কাহিনি তুলে ধরা। আর একটা কাজ আছে, সময় সময় সরকারের সাথে জনগণের সেতু তৈরি করা। কাজ অনেক কমে গেছে, কিন্তু এটাই আমাদের এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরি কাজ।
লকডাউন শুরুর দিন ধর্মতলায় বাস স্ট্যান্ডে প্রচুর লোকের ভিড়, কিন্তু কেন? এগিয়ে দেখলাম, অনেক লোক বাইরে থেকে এসেছেন, বাড়ি যাবেন, কিন্তু বাস নেই। কেউ বসে আছেন, আবার কেউ বা সরকারি বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, কখন একটা বাস জরুরি ভিত্তিতে চলবে, তার অপেক্ষায়! কারও বাড়ি পুরুলিয়া, তো কারও বাড়ি মেদিনীপুর। শেষ পর্যন্ত থাকা হয়নি, আশা করি সবাই বাড়ি পৌঁছে গেছেন। এক সবজি বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হল, রোজ তিনি আসেন দু’ঘন্টা মোটর ভ্যান চালিয়ে এয়ারপোর্ট সংলগ্ন এলাকায়। দুপুরের পরে ফিরে যান, যাওয়ার সময় বাড়ির দরকারি জিনিস কিনে নিয়ে যান। আবার পরদিন ভোররাতে বেড়িয়ে সবজি কিনে এত দূর এসে বিক্রি করেন। রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পরল আমার উল্টোদিক দিয়ে আসা এক ভ্যান চালকের দিকে। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে যাচ্ছেন সাদা কাপড় পরে! গুরুদশাটাও কাটেনি। ভাবলাম, দশকর্মার জিনিস সব পেলেন তো কাজের জন্য! কাজে বেড়িয়েছেন, লোকজনকে গ্যাস পৌঁছে দিতে হবে তো। রুবির মোড়ে কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট আর সিভিক ভলান্টিয়ার গাড়ি থামিয়ে চেক করছেন। দাঁড়িয়ে গেলাম পেশাগত কারণে। আমাদের দেখে বললেন, মারধর করলে তো আবার আপনারা দেখিয়ে দেবেন। বললাম, না, না, আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আপনারা তো ভালোর জন্যই করছেন। হেসে একজন বললেন, কী বলব বলুন, সবারই নাকি ইমারজেন্সি আছে, এরকম করলে তো সবাইকেই ছেড়ে দিতে হয়। অকারণে কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এর মধ্যে একদিন একটা বেসরকারি হাসপাতালে গেলাম। সেখানে চিকিৎসক আর নার্সদের কথা তো নতুন করে আপনাদের বলার কিছু নেই, কিন্তু হাসপাতালের বাইরে এবং ভেতরে অসংখ্য কর্মীকে স্যালুট। যাঁরা ঘরে বসে না থেকে নিরাপত্তা এবং হাসপাতাল পরিষ্কার রাখার কাজের সঙ্গে যুক্ত। হাসপাতালের বাইরে পার্কিংয়ের জায়গায় দেখলাম, কিছু ফুল ফুটে আছে। আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা তত ভালো না, তবু ইচ্ছে হল একটু ফুলের ছবি তোলার।
রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হচ্ছে অনেক সহকর্মীর সঙ্গে। অনেকে N 95 মাস্ক পাননি। কাপড়ের মাস্কই ব্যবহার করছেন। কিন্তু হেসে হেসে বলছেন, ভালো আছিস ভাই! আমাদের বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। যেখানে প্রতিনিয়ত সহকর্মী বন্ধুরা একে অন্যেকে বলছেন, কীভাবে কাজের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আমার এই পেশায় প্রায় কুড়ি বছর হবে। অনেক খবর করতে হয়েছে, লালগড় থেকে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন, ফাইলিন আর হুদহুদ, সবই দেখেছি। দেখা যাচ্ছে না শুধু এবারের পরিস্থিতিটা, লড়াইটা তাই কঠিন। তাই বোধ হয় কারওর কোনও এক্সক্লুসিভ করার তাড়া নেই, একে অন্যকে শুধু সাবধানে থাকতে বলছি আমরা।
আমার অফিসের সামনে ক্যামাক স্ট্রিট আর পার্ক স্ট্রিট ক্রসিংয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট অয়নকে রোজই দেখি। রাস্তা ফাঁকা, কিন্তু মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
গত সপ্তাহে শুক্রবার নাখোদা মসজিদে গিয়েছিলাম। প্রায় দুশো বছরের পুরনো মসজিদ। গভর্নমেন্ট নোটিসে নামাজ বন্ধ আছে। এই প্রথমবার মসজিদের দরজা বন্ধ। ইমাম সাহেব মাইকে সবাইকে ঘরে বসে নামাজ পড়তে বলছেন, করোনার ভয়াবহতার কথা সবাইকে বোঝাচ্ছেন।
রাস্তায় বা কোনও না কোনও পাড়ার গলিতে চোখে পড়েছে কেউ প্যাকেটে করে চাল, ডাল বা সবজি নিয়ে পথের ভবঘুরেদের বিলি করছেন। কেউ বা টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো বা আগেও দিতেন, কিন্তু এখন তো এটার খুব প্রয়োজন, তাঁদেরকেও স্যালুট।
মনে হচ্ছে রাজনীতির রং যেন এক হয়ে গেছে। তাই যেন হয়, মানুষের জন্য রাজনীতি।
মা বলতেন ভালো হবি, মানুষ হবি, ভালো মানুষ হোস বাবা। আজ রাস্তায় অনেক মানুষ চোখে পড়ছে যাঁরা ভালো।
এখন রাতে এখন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছি। সৌগতদাকে নামিয়ে বাড়ি ফিরতে ৯ নটা সাড়ে ৯ টা বেজে যায়। অফিস এখন আর রাতের খবরে ১০ টা ২০ র গেস্ট লাইভ দিচ্ছে না। রোজ সকাল বিকেল হেলথ কন্ডিশন সফটওয়্যারে নিয়ম করে আপডেট করতে হচ্ছে।
রাতে ফেরার আগে বাড়িতে একবার নিয়ম করে ফোন করে নিই, কিছু লাগবে কিনা জানতে। পাড়ার মুদি দোকান থেকে নিয়ে আসবো তবে। সিগারেট ছেড়ে দিতে হবে। মুদির দোকানে এখনও পাওয়া যাচ্ছে, মনে মনে চাইছি যেন না পাওয়া যায়। তাহলে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ির কলিংবেল টিপতে হয় না, গাড়ির আওয়াজ পেলে গিন্নি দরজা খুলে দেয়। আরও দু’জন সামনে চলে আসে। একজন ছ’বছর, আর একজনের প্রায় আশি, ছেলে আর বাবা। আরে তোমরা এলে কেন? দূরে যাও, দূরে যাও। রোজকার মতো বাইরেই জামাকাপড় ছেড়ে ওগুলোকে ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে স্নান করে বেরিয়েই দেখি গরম চা রেডি। আহা, এখন আর গিন্নিকে ওটার জন্য বলতেই হয় না। আগে হলে, এই এখন আবার চা, এক্ষুনি খেতে দেব! যাক গে….
সত্যি বলছি, বাড়িতে ঢোকার সময় ভয় লাগে, তাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম না তো?
আমার মতো অনেকেই ভয় পায়, প্রিয়জনের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেই ভয়…
সারাদিন কতবার যে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি, না হলে সানিটাইজার ইউজ করি, তা গুণে বলতে পারব না। কারণ, খবর করতে গিয়ে আমি আমার পরিবারের আর সমাজের ক্ষতির কারণ হতে চাই না। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, আপনারা করেন তো? মুদির দোকান থেকে এসে হাত পরিষ্কার, জানি করেন, তবুও…
গভর্নমেন্ট বলছে, আপনি ঘরে থাকুন, আমরা আছি। স্বাস্থ্য কর্মীরা বলছেন, আপনি ঘরে থাকুন, বাইরে আমরা জেগে আছি। রাস্তার সাফাই কর্মীরা বলছেন, আপনি ঘরে থাকুন, বাইরে আমরা আপনার শহর আগের মতোই সাজিয়ে রাখবো। জরুরি পরিষেবার অসংখ্য কর্মী বলছেন, আমরা আছি তো!
সংবাদ কর্মীদের পক্ষ থেকে বলছি, কথা দিচ্ছি, আপনার কাছে শুধু আপনার শহর নয়, গোটা বিশ্বকে আপনার কাছে পৌঁছে দেব। কী ভাবছেন, আপনি তো চান বাইরে বেড়িয়ে রোজ আবার আগের মতই ট্রেনে রাজীব, বুবুন, বাপিদার সঙ্গে গল্প করতে করতে অফিস যেতে! আপনি তো চান, আবার কাজের জায়গায় সর্বজিৎ, সোহমদা, সুশোভনের সাথে দেখা হবে! আপনি তো চান, এই গ্রুপের কোনও এক পাগল তাঁর বাইকে করে নতুন কোনও জায়গা ঘুরে এসে আমাদের বলবে সেখানকার কথা! কিন্তু তার জন্য তো সবাইকে ভালো রাখতে হবে, আর তার জন্য এখন ঘরে থাকতে হবেই।
লড়াইটা শুধু ২১ দিনেই শেষ নয় বন্ধু, কারণ ২১ দিনে পুরো ভাইরাসটাকে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এই ২১ দিনে ভাইরাসটা যত লোকের মধ্যে ছড়াতো সেটাকে আটকে দেওয়া যাবে, তাতে আমাদের দেশকে চিন বা ইতালির মতো হয়ে যাওয়া থেকে আটকে দিতে পারবো। লড়াই আরও অনেক দূর যাবে, জিততে আমাদের হবেই বন্ধু। আরে ধুর, কে বললো আপনি কিছু করছেন না, আপনিই তো করছেন। মুদির দোকানে, ওষুধের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে একে অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন তো,আমি জানি রাখছেন। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে জরুরি কাজ, বাড়ি থেকে প্রয়োজন ছাড়া না বেড়িয়ে ভাইরাসটাকে নিজের কাছে ডেকে আনছেন না তো? সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের সতর্ক থাকতে বলছেন তো? জানি তো বলছেন, তা হলে? আমরা সবাই মিলেই পারব।
নাখোদা মসজিদের ইমামের মা‌ইকে বলা একটা কথা আমার কানে এখনও ভাসছে, ‘ইয়ে শায়দ জিন্দেগি কা পহেলা রেস হ্যায়, জিস মে রুক যায়ে তো, হাম জিৎ জায়েঙ্গে…….’

(অংশুমান রায়, ভিডিও জার্নালিস্ট, সিএনএন নিউজ ১৮)

Comments are closed.