তথ্যপ্রযুক্তির খাসতালুক সল্টলেক সেক্টর ফাইভ। এখানে কান পাতলে নানা বিচিত্র শব্দ ভেসে আসে। তার মধ্যে অনেকগুলোই Abbreviation। তেমনই একটা শব্দ হল “TGIF”। যার অর্থ Thank God Its Friday। অর্থাৎ, সারা সপ্তাহের হাড়ভাঙা খাটুনি আর মাথাভাঙা টেনশনের পর দু’দিনের বিরতি!
যদিও তার মধ্যেও অনেকে কাজ করেন। ই-মেল রিপ্লাই করেন। হোয়াটসঅ্যাপে ঝড় তোলেন। তেমনই ফুরফুরে মেজাজটাও উপভোগ করেন অনেকে। অফিস না যাওয়ার আনন্দটা শুষে নেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পরিবারের সাথে ডিনার আর নিজের সাথে লাল জল নিয়ে উইকেন্ড নিমেষে ভ্যানিশ হয়ে যায়। চলে আসে রোববার সন্ধ্যের বিষাদ ঘন মুহূর্ত। সেই মন খারাপ করা ফিলিং। পরদিন সোমবার। আবার অফিস। আবার ক্লায়েন্ট কল। আবার টার্গেটের পেছনে দৌড়োনো।
এসবের মধ্যেই মন মাঝে মাঝে চায় একটা লম্বা ছুটি। একটা মুক্তি। কোত্থাও যাওয়া নয়। স্রেফ বাড়িতে বসে খাবো আর ঘুমাবো। এই নিয়ে প্রচুর মিম ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যেত। আর সেটাই বোধহয় বিধাতা পুরুষ সবার অলক্ষ্যে পড়ে হেসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন। তথাস্তু।
জানুয়ারির শেষভাগে চায়নায় কোরোনা সংক্রমণ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হল। এর সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে গবেষণা হল। ফেব্রুয়ারি মাসে সে রোগ পদার্পন করল ভারতে। লোকে বললো সাবধান হতে। কিন্তু সে তোয়াক্কা কে করে? অবশেষে মার্চ মাসে তা ভয়াবহ আকার নিল, যার ফলে হল দেশজোড়া ২১ দিনের লকডাউন। অর্থাৎ, আমরা গৃহবন্দি হলাম।
বহুদিনের আকাঙ্খিত স্রেফ বাড়িতে বসে থাকার মনস্কামনা পূরণ হলো কিছুটা, না কিছুটা নয়…অনেকটা মূল্য দিয়ে।
প্রথম দু’দিন কেটে গেল অনয়াসে। হাজার হলেও ব্যাপারটা নতুন। একটা নভেলটি ভ্যালু আছে। নিজেদের একটু স্বতন্ত্র লাগছিল। এমন তো আগে কখনও হয়নি।
কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে বোঝা গেল যে গৃহবন্দি জিনিসটা মোটেই আরামদায়ক নয়।
একেকটা মিনিট যেন ঘণ্টার সমান, সময় কাটানোই দায়। শুধু চার দেয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্যকে.. সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে।
সরকার জানিয়ে দিল “খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী।”
অফিস তো থেমে থাকলে হবে না। অতএব ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সকাল ৯ টায় যেখানে বাড়ি থেকে বেরোতাম সেখানে এখন ৯ টায় ব্রেকফাস্ট সেরে বারমুডার ওপর কলারওয়ালা ফর্মাল শার্ট পরে ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপ রেখে শুরু হয় দিনের কাজ। এমনিতে বারমুডার ওপর স্যান্ডো গেঞ্জি পরলেও কোনও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু ওই ক্লায়েন্ট কল। তাঁরা মাঝে মাঝে ভিডিওতে কথা বলতে চায়। তাই ফর্মাল শার্ট। আর ল্যাপটপের মাথায় ছোট্ট ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল কখনওই কোমরের থেকে নামে না বলে বারমুডা পরেই কাজ চলে যায়।
কাজ একবার শুরু হলে হুহু করে সময় কাটে। এই সময়টা হাতের লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার সময়। অফিসে থাকলে অনেক ম্যানেজার জুনিয়রদের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারে না। কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোমে সেই বিশ্বাসটুকু করতেই হয়। আর সেখানেই বোঝা যায় কোন জুনিয়রের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সম্ভবনা। সেটা কিন্তু একটা বড় পাওয়া।
ক্লায়েন্টরাও সব বাড়িতে। অফিসের দিন ফোন করলে শুধু কাজের কথাটুকুই হয়। কুশল বিনিময়ের জন্য বরাদ্দ থাকে এক লাইন। কারণ, তিনিও ব্যস্ত, আর আমিও ব্যস্ত। এখন কিন্তু ফোন করলে আরও অনেক কথা হয়। নানা ধরনের গল্প হয়। তাতে নিজেদের মধ্যে শুধু বন্ডিং স্ট্রং হয় তা নয়, নতুন কাজেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
অফিস চলে রাত ৮ টা অবধি প্রায়। মাঝে আধ ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক। অফিসে থাকলে অনেক বেশিবার উঠতে হয়। মিটিংয়ের জন্য কনফারেন্স রুমে। লম্বা কল চললে কল রুম। নানা ডিপার্টমেন্টে দৌড়াদৌড়ি, নানা কাজে। আর ঘন ঘন ক্লায়েন্ট অফিসে যাতায়াত।
বাড়িতে সে সবের বালাই নেই। টানা বসে কাজ, যেটা শরীরে পক্ষে মোটেই ভালো নয়। কিন্তু নির্বিঘ্নে কাজ। আর এই বাড়ি থেকে কাজ করতে করতে বেরিয়ে আসে এমন কিছু তথ্য বা উপলব্ধি , এমন কিছু জিনিস, যেটা লকডাউন না হলে হয়তো বুঝতে আরো সময় লেগে যেত। যাঁরা হিসেব মত কোম্পানিতে জুনিয়র, তারা কখন যে বড় হয়ে গেছে সেটা ধরতে পারা ছিল দুষ্কর। অনেক ম্যানেজারের মধ্যে একটা পিতৃসুলভ ব্যাপার থাকে। মিথ্যে একটা ভাবনায় আচ্ছন্ন রাখে নিজেকে। এই ভেবে যে, আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের সব ব্যাপারে নাক গলানোটা খুব জরুরি। তবেই ভাল কাজ হবে। ভয় থাকে যে নিজে না দেখলে ভুল না করে ফেলে।
লকডাউনে যখন সেই ম্যানেজাররা বাড়ি বসে কাজ করে, যখন টিম মেম্বারের সাথে সাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। সাক্ষাতের একমাত্র সূত্র ভিডিও কল, সেখানে নিজের নাক গলানোটা অজান্তেই কমে আসে আর হঠাৎ এই উপলব্ধি হয়, তাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো। ওরা ওদের দায়িত্ব বুঝে ভালোই কাজ করছে আর সেটা এনে দেয় চরম পরিতৃপ্তি। সেটা এই লকডাউন না হলে বোঝা সম্ভব ছিল না।
বাড়িতে কাজ করলে অসুবিধায় যাঁরা পড়েন, তাঁরা হলেন বাড়ির লোক। আমাদের এই দেশে নিজেস্ব স্টাডি রুমের বিশেষ চল নেই। তাই একটা ঘর আমার জন্যই বরাদ্দ থাকে।
এর মধ্যে মাঝে মাঝে মনটা হুহু করে ওঠে অফিসের আমার টেবিল, সেই নীল চেয়ারটার জন্য। কতদিন হয়ে গেল ওদের দেখিনি। অফিসের সাথে ওদের সঙ্গেও যে একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে সেটা হঠাৎ বুঝতে পারি।
এখন আর শুক্রবারের সন্ধ্যে তেমন ভালো লাগে না। পরের দু’দিন ছুটি ভাবলেই আঁতকে উঠি। সময় কী করে কাটবে? আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। যত উদ্ভট বাজে টেনশন এসে ভিড় করে, যা আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন। নিজেকে প্রবোধ দিই যে, আমি যুক্তিবাদি আর তাই এ সব চিন্তা মাথায় আনবো না। কিন্তু এই মন বড়ই বেহায়া। দু’তিনবার হাঁচি হলেই ভয় হয়, এটা কোনও রোগের পূর্বাভাস নয় তো! অমনি দৌড়ে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে আসি।
চট করে একবার চেক করি, ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা কত বাড়লো। এই দুশ্চিন্তার আগুনে ধুনো দেবার জন্য আছে হোয়াটসঅ্যাপে ফরওয়ার্ড করা পোস্ট বা ফেসবুক আপডেট। যার কোনও অথেন্টিসিটি নেই, কিন্তু কিছু মানুষ এগুলোই শেয়ার করে আনন্দ পান। কী করা যাবে!
অতএব ভাবতে শুরু করি, আমি আর কী করতে পারি, আর ঠিক তখনই মনে পড়ে আমিও একসময় গান করতাম। রীতিমতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে।
পুরনো বাক্স খুলে ঝুল ঝেড়ে বের করলাম সেই হারমোনিয়াম। না, কিছুই ভুলিনি। সব মনে আছে। দু’তিনবার সরগম বাজিয়ে গাইলাম “সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক, বেশ তো।” মেয়ে তো উত্তেজিত। বাবা গান গাইছে। সাথে সাথে সে তার মায়ের ফোনে রেকর্ড করে ফেলল সেই মুহূর্ত। ভাবলাম এতদিন এ বিদ্যাকে বড়ই উপেক্ষা করেছি। লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কত কিছুকে আমি অবজ্ঞার সাথে ভুলে থেকেছি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে।
লেখালিখিটা আমার আগেও চলত। এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। ফেসবুকে একটা সাহিত্যের পেজ আছে আমার। অল্প কথায় গল্প। https://www.facebook.com/ SantanuMukhopadhyaya/
এখানে আমি নিয়মিত গল্প আর পদ্য পোস্ট করি। সেই পেজ মাঝে মাঝে অনাহারে ভুগতো। কারণ, আমার নিয়ম করে পোস্ট করা হত না। এখন নিয়ম করে পোস্ট করি আর সেগুলো বেশ ভাইরালও হয়। মনে আরও বল আসে। লকডাউনে লেখার সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
আমাদের যৌথ পরিবার। ঠিক যৌথ পরিবার কথাটা বলা ভুল, কারণ একই বাড়িতে থাকলেও খাওয়াটা আলাদা। তবে সেটা নামমাত্রই আলাদা। কাকার ঘরে কিছু উপাদেয় রান্না হয়েছে, আর আমি তার ভাগ পাবো না, এ অসম্ভব। তেমনই আমাদের বাড়িতেও কিছু স্পেশাল রান্না হলে বাটি পৌঁছে যায় কাকার ঘরে ।
আমাদের চার তলা বাড়ি। চারটে ফ্লোর বাবারা চার ভাই বানিয়ে নিয়েছেন। নিয়মিত তাঁদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও এখন সেটা একটু বেশি। সারাদিন অফিসের কাজ সাঙ্গ করে ব্যাচেলর মেজকাকার সাথে কুশল বিনিময় শেষে ছোটকাকার ঘরে রাত ১০ টার কফিটা আমার জন্য বরাদ্দ। ডিনার শেষে সেজকাকার ঘরে ভাইয়ের সাথে আড্ডা মাঝরাত পর্যন্ত।
মাঝে মাঝে সন্ধের সময় চলে তাসের 29 খেলা বা ক্যারম। আমি আর ভাই বনাম কাকিমা আর মা। যৌথ পরিবারের এই সুবিধাটা আমি এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। এ ছাড়াও বউ আর ভাই বউয়ের আবদারে কখনও চলে নিছক আড্ডা। বিবাহিত বোনেরা যোগ দেয় হোয়াটসঅ্যাপে। যৌথ পরিবার পূর্ণতা লাভ করে।
বন্ধুদের ছাড়া আমার এক মুহুর্ত চলে না। ভগবান অনেক আশীর্বাদ বর্ষণ করে আমায় বন্ধু ভাগ্য দিয়েছেন। এমন বন্ধু সচারচর পাওয়া যায় না। তাদের সাথে এখন নিয়মিত আড্ডা জমে সন্ধেবেলা ভিডিও কলে। কখনও পাড়ার বন্ধুদের সাথে, তো কখনও স্কুলের বন্ধুদের সাথে, তো কখনও আমার নাটকের দলের সাথে। সময় অজান্তেই কেটে যায়।
এর মধ্যে সময় বার করতে হয় নিজের জন্য। যখন আপন মনে গান গাই। ছাদে একলা পায়চারি করি। আর নতুন কোনও সৃষ্টির জাল বুনি। এর মধ্যে চিন্তা করি আমার প্রফেশনাল কাজ, অর্থাৎ মার্কেটিং নিয়ে। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। এমন শেখার সুযোগ বার বার আসে না।
একসময় প্রচুর বই পড়তাম। সে অভ্যেস এখনও আছে কিন্তু চোখের অসুবিধার জন্য বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। তবে প্রচুর অডিও স্টোরি শুনি।
সময়টা বড্ড গোলমেলে। আমি টিভি খুব কম দেখি। তাই মিডিয়ার প্রচার করা কোনও টেনশন আমায় সেভাবে স্পর্শ করে না। নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রেখে চিন্তা মুক্ত থাকার চেষ্টা চালাই।
এর মধ্যেই হঠাৎ কখন মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। এই যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি, সেখানে কত মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। দিন মজুরদের কী অবস্থা, তার কতটুকুই বা জানি। জানলেও কতটা উপলব্ধি করি। যাঁদের শরীরে এই রোগ দানা বেঁধেছে কেমন আছেন তাঁরা? কেমন আছে তাঁদের পরিবার? যে ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মী নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সেবা করে চলেছেন তাঁদেরই বা কী মানসিক অবস্থা? কবে শেষ হবে এই দুঃসময়? কী অর্থনৈতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? এ সব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্ন দেখি সব মেঘ কেটে গেছে । নতুন সূর্য উঠেছে। করোনা বিদায় নিয়েছে কিন্তু তার মন্দ দিনের ভালোটুকু রেখে গেছে। নির্মল পরিবেশ, যৌথ পরিবারের বন্ধন, নতুন করে লড়ে বাঁচতে শেখা বা নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দটুকু রয়ে গেছে। সেই আনন্দের রেশে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি সকাল হয়ে গেছে। আর তখনই ভাবি, ঠাকুমা বলতেন ভোরের স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হয়।
যদিও তার মধ্যেও অনেকে কাজ করেন। ই-মেল রিপ্লাই করেন। হোয়াটসঅ্যাপে ঝড় তোলেন। তেমনই ফুরফুরে মেজাজটাও উপভোগ করেন অনেকে। অফিস না যাওয়ার আনন্দটা শুষে নেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পরিবারের সাথে ডিনার আর নিজের সাথে লাল জল নিয়ে উইকেন্ড নিমেষে ভ্যানিশ হয়ে যায়। চলে আসে রোববার সন্ধ্যের বিষাদ ঘন মুহূর্ত। সেই মন খারাপ করা ফিলিং। পরদিন সোমবার। আবার অফিস। আবার ক্লায়েন্ট কল। আবার টার্গেটের পেছনে দৌড়োনো।
এসবের মধ্যেই মন মাঝে মাঝে চায় একটা লম্বা ছুটি। একটা মুক্তি। কোত্থাও যাওয়া নয়। স্রেফ বাড়িতে বসে খাবো আর ঘুমাবো। এই নিয়ে প্রচুর মিম ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যেত। আর সেটাই বোধহয় বিধাতা পুরুষ সবার অলক্ষ্যে পড়ে হেসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন। তথাস্তু।
জানুয়ারির শেষভাগে চায়নায় কোরোনা সংক্রমণ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হল। এর সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে গবেষণা হল। ফেব্রুয়ারি মাসে সে রোগ পদার্পন করল ভারতে। লোকে বললো সাবধান হতে। কিন্তু সে তোয়াক্কা কে করে? অবশেষে মার্চ মাসে তা ভয়াবহ আকার নিল, যার ফলে হল দেশজোড়া ২১ দিনের লকডাউন। অর্থাৎ, আমরা গৃহবন্দি হলাম।
বহুদিনের আকাঙ্খিত স্রেফ বাড়িতে বসে থাকার মনস্কামনা পূরণ হলো কিছুটা, না কিছুটা নয়…অনেকটা মূল্য দিয়ে।
প্রথম দু’দিন কেটে গেল অনয়াসে। হাজার হলেও ব্যাপারটা নতুন। একটা নভেলটি ভ্যালু আছে। নিজেদের একটু স্বতন্ত্র লাগছিল। এমন তো আগে কখনও হয়নি।
কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে বোঝা গেল যে গৃহবন্দি জিনিসটা মোটেই আরামদায়ক নয়।
একেকটা মিনিট যেন ঘণ্টার সমান, সময় কাটানোই দায়। শুধু চার দেয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্যকে.. সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে।
সরকার জানিয়ে দিল “খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী।”
অফিস তো থেমে থাকলে হবে না। অতএব ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সকাল ৯ টায় যেখানে বাড়ি থেকে বেরোতাম সেখানে এখন ৯ টায় ব্রেকফাস্ট সেরে বারমুডার ওপর কলারওয়ালা ফর্মাল শার্ট পরে ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপ রেখে শুরু হয় দিনের কাজ। এমনিতে বারমুডার ওপর স্যান্ডো গেঞ্জি পরলেও কোনও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু ওই ক্লায়েন্ট কল। তাঁরা মাঝে মাঝে ভিডিওতে কথা বলতে চায়। তাই ফর্মাল শার্ট। আর ল্যাপটপের মাথায় ছোট্ট ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল কখনওই কোমরের থেকে নামে না বলে বারমুডা পরেই কাজ চলে যায়।
কাজ একবার শুরু হলে হুহু করে সময় কাটে। এই সময়টা হাতের লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার সময়। অফিসে থাকলে অনেক ম্যানেজার জুনিয়রদের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারে না। কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোমে সেই বিশ্বাসটুকু করতেই হয়। আর সেখানেই বোঝা যায় কোন জুনিয়রের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সম্ভবনা। সেটা কিন্তু একটা বড় পাওয়া।
ক্লায়েন্টরাও সব বাড়িতে। অফিসের দিন ফোন করলে শুধু কাজের কথাটুকুই হয়। কুশল বিনিময়ের জন্য বরাদ্দ থাকে এক লাইন। কারণ, তিনিও ব্যস্ত, আর আমিও ব্যস্ত। এখন কিন্তু ফোন করলে আরও অনেক কথা হয়। নানা ধরনের গল্প হয়। তাতে নিজেদের মধ্যে শুধু বন্ডিং স্ট্রং হয় তা নয়, নতুন কাজেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
অফিস চলে রাত ৮ টা অবধি প্রায়। মাঝে আধ ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক। অফিসে থাকলে অনেক বেশিবার উঠতে হয়। মিটিংয়ের জন্য কনফারেন্স রুমে। লম্বা কল চললে কল রুম। নানা ডিপার্টমেন্টে দৌড়াদৌড়ি, নানা কাজে। আর ঘন ঘন ক্লায়েন্ট অফিসে যাতায়াত।
বাড়িতে সে সবের বালাই নেই। টানা বসে কাজ, যেটা শরীরে পক্ষে মোটেই ভালো নয়। কিন্তু নির্বিঘ্নে কাজ। আর এই বাড়ি থেকে কাজ করতে করতে বেরিয়ে আসে এমন কিছু তথ্য বা উপলব্ধি , এমন কিছু জিনিস, যেটা লকডাউন না হলে হয়তো বুঝতে আরো সময় লেগে যেত। যাঁরা হিসেব মত কোম্পানিতে জুনিয়র, তারা কখন যে বড় হয়ে গেছে সেটা ধরতে পারা ছিল দুষ্কর। অনেক ম্যানেজারের মধ্যে একটা পিতৃসুলভ ব্যাপার থাকে। মিথ্যে একটা ভাবনায় আচ্ছন্ন রাখে নিজেকে। এই ভেবে যে, আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের সব ব্যাপারে নাক গলানোটা খুব জরুরি। তবেই ভাল কাজ হবে। ভয় থাকে যে নিজে না দেখলে ভুল না করে ফেলে।
লকডাউনে যখন সেই ম্যানেজাররা বাড়ি বসে কাজ করে, যখন টিম মেম্বারের সাথে সাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। সাক্ষাতের একমাত্র সূত্র ভিডিও কল, সেখানে নিজের নাক গলানোটা অজান্তেই কমে আসে আর হঠাৎ এই উপলব্ধি হয়, তাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো। ওরা ওদের দায়িত্ব বুঝে ভালোই কাজ করছে আর সেটা এনে দেয় চরম পরিতৃপ্তি। সেটা এই লকডাউন না হলে বোঝা সম্ভব ছিল না।
বাড়িতে কাজ করলে অসুবিধায় যাঁরা পড়েন, তাঁরা হলেন বাড়ির লোক। আমাদের এই দেশে নিজেস্ব স্টাডি রুমের বিশেষ চল নেই। তাই একটা ঘর আমার জন্যই বরাদ্দ থাকে।
এর মধ্যে মাঝে মাঝে মনটা হুহু করে ওঠে অফিসের আমার টেবিল, সেই নীল চেয়ারটার জন্য। কতদিন হয়ে গেল ওদের দেখিনি। অফিসের সাথে ওদের সঙ্গেও যে একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে সেটা হঠাৎ বুঝতে পারি।
এখন আর শুক্রবারের সন্ধ্যে তেমন ভালো লাগে না। পরের দু’দিন ছুটি ভাবলেই আঁতকে উঠি। সময় কী করে কাটবে? আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। যত উদ্ভট বাজে টেনশন এসে ভিড় করে, যা আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন। নিজেকে প্রবোধ দিই যে, আমি যুক্তিবাদি আর তাই এ সব চিন্তা মাথায় আনবো না। কিন্তু এই মন বড়ই বেহায়া। দু’তিনবার হাঁচি হলেই ভয় হয়, এটা কোনও রোগের পূর্বাভাস নয় তো! অমনি দৌড়ে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে আসি।
চট করে একবার চেক করি, ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা কত বাড়লো। এই দুশ্চিন্তার আগুনে ধুনো দেবার জন্য আছে হোয়াটসঅ্যাপে ফরওয়ার্ড করা পোস্ট বা ফেসবুক আপডেট। যার কোনও অথেন্টিসিটি নেই, কিন্তু কিছু মানুষ এগুলোই শেয়ার করে আনন্দ পান। কী করা যাবে!
অতএব ভাবতে শুরু করি, আমি আর কী করতে পারি, আর ঠিক তখনই মনে পড়ে আমিও একসময় গান করতাম। রীতিমতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে।
পুরনো বাক্স খুলে ঝুল ঝেড়ে বের করলাম সেই হারমোনিয়াম। না, কিছুই ভুলিনি। সব মনে আছে। দু’তিনবার সরগম বাজিয়ে গাইলাম “সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক, বেশ তো।” মেয়ে তো উত্তেজিত। বাবা গান গাইছে। সাথে সাথে সে তার মায়ের ফোনে রেকর্ড করে ফেলল সেই মুহূর্ত। ভাবলাম এতদিন এ বিদ্যাকে বড়ই উপেক্ষা করেছি। লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কত কিছুকে আমি অবজ্ঞার সাথে ভুলে থেকেছি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে।
লেখালিখিটা আমার আগেও চলত। এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। ফেসবুকে একটা সাহিত্যের পেজ আছে আমার। অল্প কথায় গল্প। https://www.facebook.com/
এখানে আমি নিয়মিত গল্প আর পদ্য পোস্ট করি। সেই পেজ মাঝে মাঝে অনাহারে ভুগতো। কারণ, আমার নিয়ম করে পোস্ট করা হত না। এখন নিয়ম করে পোস্ট করি আর সেগুলো বেশ ভাইরালও হয়। মনে আরও বল আসে। লকডাউনে লেখার সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
আমাদের যৌথ পরিবার। ঠিক যৌথ পরিবার কথাটা বলা ভুল, কারণ একই বাড়িতে থাকলেও খাওয়াটা আলাদা। তবে সেটা নামমাত্রই আলাদা। কাকার ঘরে কিছু উপাদেয় রান্না হয়েছে, আর আমি তার ভাগ পাবো না, এ অসম্ভব। তেমনই আমাদের বাড়িতেও কিছু স্পেশাল রান্না হলে বাটি পৌঁছে যায় কাকার ঘরে ।
আমাদের চার তলা বাড়ি। চারটে ফ্লোর বাবারা চার ভাই বানিয়ে নিয়েছেন। নিয়মিত তাঁদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও এখন সেটা একটু বেশি। সারাদিন অফিসের কাজ সাঙ্গ করে ব্যাচেলর মেজকাকার সাথে কুশল বিনিময় শেষে ছোটকাকার ঘরে রাত ১০ টার কফিটা আমার জন্য বরাদ্দ। ডিনার শেষে সেজকাকার ঘরে ভাইয়ের সাথে আড্ডা মাঝরাত পর্যন্ত।
মাঝে মাঝে সন্ধের সময় চলে তাসের 29 খেলা বা ক্যারম। আমি আর ভাই বনাম কাকিমা আর মা। যৌথ পরিবারের এই সুবিধাটা আমি এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। এ ছাড়াও বউ আর ভাই বউয়ের আবদারে কখনও চলে নিছক আড্ডা। বিবাহিত বোনেরা যোগ দেয় হোয়াটসঅ্যাপে। যৌথ পরিবার পূর্ণতা লাভ করে।
বন্ধুদের ছাড়া আমার এক মুহুর্ত চলে না। ভগবান অনেক আশীর্বাদ বর্ষণ করে আমায় বন্ধু ভাগ্য দিয়েছেন। এমন বন্ধু সচারচর পাওয়া যায় না। তাদের সাথে এখন নিয়মিত আড্ডা জমে সন্ধেবেলা ভিডিও কলে। কখনও পাড়ার বন্ধুদের সাথে, তো কখনও স্কুলের বন্ধুদের সাথে, তো কখনও আমার নাটকের দলের সাথে। সময় অজান্তেই কেটে যায়।
এর মধ্যে সময় বার করতে হয় নিজের জন্য। যখন আপন মনে গান গাই। ছাদে একলা পায়চারি করি। আর নতুন কোনও সৃষ্টির জাল বুনি। এর মধ্যে চিন্তা করি আমার প্রফেশনাল কাজ, অর্থাৎ মার্কেটিং নিয়ে। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। এমন শেখার সুযোগ বার বার আসে না।
একসময় প্রচুর বই পড়তাম। সে অভ্যেস এখনও আছে কিন্তু চোখের অসুবিধার জন্য বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। তবে প্রচুর অডিও স্টোরি শুনি।
সময়টা বড্ড গোলমেলে। আমি টিভি খুব কম দেখি। তাই মিডিয়ার প্রচার করা কোনও টেনশন আমায় সেভাবে স্পর্শ করে না। নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রেখে চিন্তা মুক্ত থাকার চেষ্টা চালাই।
এর মধ্যেই হঠাৎ কখন মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। এই যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি, সেখানে কত মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। দিন মজুরদের কী অবস্থা, তার কতটুকুই বা জানি। জানলেও কতটা উপলব্ধি করি। যাঁদের শরীরে এই রোগ দানা বেঁধেছে কেমন আছেন তাঁরা? কেমন আছে তাঁদের পরিবার? যে ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মী নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সেবা করে চলেছেন তাঁদেরই বা কী মানসিক অবস্থা? কবে শেষ হবে এই দুঃসময়? কী অর্থনৈতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? এ সব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্ন দেখি সব মেঘ কেটে গেছে । নতুন সূর্য উঠেছে। করোনা বিদায় নিয়েছে কিন্তু তার মন্দ দিনের ভালোটুকু রেখে গেছে। নির্মল পরিবেশ, যৌথ পরিবারের বন্ধন, নতুন করে লড়ে বাঁচতে শেখা বা নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দটুকু রয়ে গেছে। সেই আনন্দের রেশে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি সকাল হয়ে গেছে। আর তখনই ভাবি, ঠাকুমা বলতেন ভোরের স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হয়।
Related Posts
(শান্তনু মুখার্জি একটি তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার মার্কেটিং কনসালটেন্ট)
Comments are closed.