লকডাউনে কারখানা বন্ধ। সম্বল সামান্য টাকা। এই পরিস্থিতিতে লকডাউন ওঠার আশা না দেখে বাড়ি ফেরার কথা ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কারখানা ও বাড়ির দূরত্ব যদি হয় ১৭০০ কিলোমিটার! যদি বন্ধ থাকে বাস-ট্রেন এবং সর্বোপরি আপনার বাড়ি যদি হয় অন্য কোনও রাজ্যে? কী করবেন? আপনি কী করবেন জানা নেই, কিন্তু জাজপুরের মহেশ জেনা করে দেখিয়েছেন।
মহারাষ্ট্র থেকে সাইকেল নিয়ে ১৭০০ কিলোমিটার উজিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন ওড়িশায় নিজের বাড়িতে। তবে গ্রামে ঢুকতে পারেননি। আপাতত বিজয়ীর হাসি নিয়ে বছর কুড়ির মহেশ ঠাঁই নিয়েছেন ওড়িশার জাজপুর জেলার আইসোলেশন সেন্টারে।
মহারাষ্ট্রের সাংলি মিরাজ এমআইডিসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় একটি লোহার কারখানায় অস্থায়ী ভিত্তিতে মাসিক ১৫ হাজার টাকার বেতনে কাজ করতেন জাজপুরের মহেশ জেনা। আচমকা লকডাউনে বাকিদের মতো তিনিও হকচকিয়ে যান। শ্রমিক মহল্লায় রটে যায় তিন মাস টানা চলবে লকডাউন। তাতে আরও শঙ্কিত হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। মহেশের হাতে তখন সম্বল মাত্র ৩ হাজার টাকা। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বেঁচে থাকতে গেলে দরকার মাসিক অন্তত ৬ হাজার টাকা। কারখানা বন্ধ থাকলে বেতনও হবে না। টাকার জোগাড় হবে কী করে, চিন্তায় পড়ে যান বছর কুড়ির মহেশ। শেষ পর্যন্ত ঠিক করেন বাড়ি ফিরবেন। সঙ্গী হবে সাইকেল। এই পরিকল্পনার কথা সহকর্মীদের জানাতেই রে-রে করে ওঠেন তাঁরা। এতটা দূরত্ব সাইকেলে পৌঁছনো যে কার্যত অসম্ভব। কিন্তু মহেশ বাড়ি ফিরবেনই।
পয়লা এপ্রিল ভোরবেলা সাইকেল নিয়ে মহারাষ্ট্র থেকে ওড়িশার উদ্দেশে রওনা দেন মহেশ। পিঠে ব্যাকপ্যাক। আর সাইকেলের সামনের হ্যান্ডেলে ঝোলানো গৃহস্থালীর টুকটাক সরঞ্জাম। শুরু হয় এক অভূতপূর্ব অ্যাডভেঞ্চার।
মহেশ জেনা জানিয়েছেন, তাঁর কাছে ম্যাপ ছিল না। তবে ট্রেনে যাতায়াতের সময় তিনি ওড়িশা থেকে মহারাষ্ট্রের মধ্যে পড়া বড় বড় স্টেশনগুলোর নাম জানতেন। সেই জ্ঞানকে শিরোধার্য করেই ৭ দিন টানা সাইকেল চালিয়ে ওড়িশার জাজপুর জেলায় পৌঁছে যান তিনি।
দৈনিক প্রায় ২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হতো। মহেশ জানান, প্রবল গরমে মাঝে মাঝে মনে হত এই বুঝি পড়ে যাবো। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছতেই হবে, একটা জেদ চেপে গিয়েছিল মনে। রাতে কোনও মন্দির কিংবা ধাবাতে সামান্য খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতাম। ভোরবেলা ফের শুরু সাইকেল যাত্রা। পথে বেশ কয়েকজন ট্রাক চালক তাঁকে লিফট দিতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু লকডাউনের মধ্যে চেকিংয়ে ধরা পড়লে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়ে যেতে পারে চালকদের, এই ভয়ে ট্রাকেও খুব বেশি দূর যেতে পারেননি মহেশ।
আটকে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের সীমায়। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা মহেশকে আটকান। জানতে চান কোথায় চলেছেন তিনি। পুরো কাহিনি শুনে হতবাক মহারাষ্ট্র পুলিশের কর্মীরা মহেশকে ওড়িশায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসেন। বলেন, সাবধানে বাড়ি ফিরে যেতে।
মহেশ সোলাপুর-হায়দরাবাদ-বিজয়ওয়াড়া-বিশাখাপত্তনম-শ্রীকাকুলাম রুট ধরে ওড়িশা সীমানার গঞ্জাম জেলায় পৌঁছোন। দৈনিক মোটামুটিভাবে ১৬ ঘণ্টা সাইকেলে চালাতেন। ৪ এপ্রিল পথে একজনের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে বাড়িতে ফোন করেছিলেন। বাড়ির লোকেরা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন বলে জানান মহেশ।
৭ এপ্রিল সন্ধেবেলা ওড়িশার জাজপুর জেলায় পৌঁছোন মহেশ। কিন্তু গ্রামে ঢুকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত জাজপুরের বিচিত্রপুর উপেন্দ্রকুমার হাইস্কুলের আইসোলেশন সেন্টারে ঠাঁই হয় সদ্য ১৭০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা তরুণের। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকার পর তাঁর একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করেছে মহেশের। বলছেন, এর চেয়ে সাইকেল চালানোই ভালো ছিল!
Comments are closed.