যাদবপুর থেকে মেডিকেল কলেজে পড়ুয়াদের জয়ে দলের কী লাভ, প্রশ্ন সিপিএমের অন্দরে।

ছাত্রদের অনশন এবং আন্দোলনের সামনে পিছু হঠেছে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। পড়ুয়াদের দাবি মেনে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন বিল্ডিংয়ের হস্টেলেই পুরনো ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা হবে। এই লিখিত প্রতিশ্রুতির পর উঠেছে অনশন। কয়েকদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ুয়াদের আন্দোলনের সামনে কর্তৃপক্ষ পিছু হঠে এবং ভর্তিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা বহাল রাখে। দু’জায়গাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের পরাজয় হয়েছে বলে স্লোগান তুলেছে বিরোধীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বামপন্থীদের পেজ ফলো করলে মনে হবে, নতুন হস্টেলে ছাত্রদের থাকার বিষয়টাই রাজ্যের মানুষের একমাত্র মৌলিক সমস্যা ছিল। এখানে অবশ্য বিরোধী বলতে আমরা বুঝছি, সিপিএম এবং নকশালপন্থী কিছু সংগঠন, আর একটু বিস্তারিতভাবে বললে, সমাজের বাম কিংবা অতিবাম মনোভাবাপন্ন একটা কন্ঠস্বর।
যদিও দুঃখজনকভাবে সত্যি, মাঠে-ময়দানের দৈনন্দিন রাজনীতিতে আজ রাজ্যে বিরোধী দলের মর্যাদা খুইয়েছে সিপিএম এবং বামেরা। সম্প্রতিকালে একের পর এক নির্বাচনের ফল তো বটেই, রাজ্যের অধিকাংশ সাধারণ, গরিব, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া এবং গ্রামে বসবাসকারী মানুষের যে মনোভাব, তাতে রাজ্যে প্রকৃত বিরোধী শক্তি এখন বিজেপি। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার থেকে শুরু করে রায়গঞ্জ, মালদহ উত্তর, কৃষ্ণনগর হয়ে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম কিংবা বসিরহাটে গ্রামের পর গ্রামে তৃণমূল বিরোধী গরিব মানুষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার কিংবা সেমিনার না করেই যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তৃণমূলকে টাইট দিতে হলে বিজেপি করতে হবে। বিজেপির হাত শক্ত করতে হবে। তৃণমূল বিরোধী মানুষের এই মনোভাব বা ঝোঁকের কথা সিপিএম নেতারা যে এখনও একেবারেই বুঝতে পারছেন না তা নয়। যদিও দু’বছর আগে বিষয়টাকে তাঁরা উড়িয়ে দিতেন। এখন আর উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ্যে তো বটেই, মন থেকেও বিষয়টাকে মানতে পারছেন না।
কয়েক বছর ধরেই সিপিএমের অন্দরে বারবার প্রশ্ন উঠেছে, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বলার মতো এত ইস্যু থাকলেও, নিয়মমাফিক কিছু কর্মসূচি পালনে কেন আটকে থাকছে দল? কেন রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে তীব্র ধারাবাহিক আন্দোলনের চেহারা দেওয়া যাচ্ছে না? কেন একটা ইস্যু ছেড়ে কিছু দিনের মধ্যে অন্য ইস্যু ধরা হচ্ছে? কেন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এমন কোনও দাবি তুলে ধরা যাচ্ছে না, যা মেডিকেল কলেজের হস্টেল সমস্যা মিটিয়ে ফেলার মতো সহজে সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়? আর সরকার না মানলে কেন তা নিয়ে টানা নাছোড়বান্দা লড়াই চালানো যাচ্ছে না? ২০১৫ সালে কলকাতায় সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে বর্ধমানের এক নেতা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল আর রানি রাসমনি রোডে সমাবেশ, সবই তো হচ্ছে নিয়ম করে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এই কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করে কী হবে?’ তারপর নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কিন্তু তাও আটকে ছিল মেয়ো রোড থেকে রেড রোডের মধ্যে।
ছ’য়ের দশকের শেষে নন্দন পত্রিকার শারদ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন হরেকৃষ্ণ কোঙার। প্রবন্ধের নাম, ‘বিপ্লব সম্বন্ধে কয়েকটি মার্কসবাদী শিক্ষা’। সেখানে কৃষক আন্দোলনের নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার লিখেছেন, ‘…যে প্রস্তুতি আংশিক দাবি আদায়ের সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন ও যথেষ্ট তা মোটেই বিপ্লবের পক্ষে যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মজুরি, মহার্ঘ ভাতা, ছাঁটাই বন্ধ, উচ্ছেদ বন্ধ, খাস বা বেনামি জমির আন্দোলন, বন্দিমুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রভৃতির জন্য সংগ্রাম-সবই হল আংশিক দাবির সংগ্রাম। আংশিক দাবি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুইই হতে পারে। আংশিক দাবির সংগ্রাম অত্যন্ত তীব্র ও জঙ্গি হতে পারে। কিন্তু আংশিক দাবির সংগ্রাম রাষ্ট্রক্ষমতার সংগ্রাম নয়।’
এটা ঠিক আজ আর বিপ্লব হবে না। সিপিএমও তা মনে করে না। কিন্তু এটাও ঠিক, এই আংশিক দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে কিছু সাময়িক রিলিফ মিলতে পারে, সরকার বদল সম্ভব নয়। আর সম্ভব যে নয়, তা গ্রামের সাধারণ মানুষ আজ বুঝে গেছে। বুঝে গেছে বলেই, নতুন হস্টেলে থাকার জন্য ছাত্রদের অনশন, প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজে ভর্তির আন্দোলন কিংবা সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধির দাবিতে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করাকে সিপিএম এবং বামেরা যতই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘জয়’ প্রচার করুন না কেন, আজ গ্রামের মানুষের তাতে আর কিছু এসে-যাচ্ছে না। আশু এবং আংশিক দাবি নিয়ে সিপিএম এবং বামেদের প্রচার অভিযান আর পাঁচটা কর্মসূচি পালন হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। নিয়ম মাফিক বামেদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হচ্ছে। সমাবেশ হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে। নানান সময়ে আংশিক দাবির আন্দোলনে কিছু সাময়িক রিলিফও মিলছে। সরকার প্রয়োজন মতো কৌশল বদলে বদলে কোনও দাবি মানছেও। কখনও যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ ভট্টাচার্যকে অপসারণের মতো কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কখনও আবার স্বাস্থ্য সচিবকে অন্য দফতরে বদলি করছে। কিন্তু যে কর্মসূচি পালন বা বিচ্ছিন্ন শহরকেন্দ্রীক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এই দাবিগুলো কিছু ক্ষেত্রে আদায়ও হচ্ছে, তা সামগ্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষের কাছে সরকারকে উৎখাতের জন্য যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না।
আর এই কারণেই আজ উঠতে শুরু করেছে জেলায় জেলায় সিপিএমের নেতৃত্বের একটা বড় অংশের মধ্যে। দলের মধ্যে আলোচনায় বারবার উঠে আসছে এই কথা, দশ-বিশ দফা দাবি নিয়ে সাত বছর ধরে এত কর্মসূচি পালন করেও রাজ্যে বিরোধী দল হিসেবে দ্রুত উঠে এসেছে বিজেপি। এখনও খানিক সময় আছে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলার মিছিলে আটকে না থেকে, গ্রামের পর গ্রামে মাঠে নেমে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষকের বেঁচে থাকার মৌলিক সমস্যাকে তুলে ধরে লাগাতার আন্দোলন করতে না পারলে আগামী লোকসভা ভোটে কি এরাজ্যে আদৌ প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট? মেডিকেল কলেজ ইস্যু নিয়ে ‘ছাত্রদের জয়’ শিরোনামে মঙ্গলবার সিপিএমের দলীয় মুখপত্র গণশক্তিতে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই ‘জয়’ রাজ্যে সরকার বদলের জন্য যথেষ্ট নয়, তার জন্য পঞ্চাশ বছর আগে নন্দন শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হরেকৃষ্ণ কোঙারের লেখা স্মরণ করা জরুরি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.