Kolkata কনটেইনমেন্ট জোন: ২ টো বরো, ২১ ওয়ার্ড বেশি সংক্রমিত! পরিবার পিছু জনসংখ্যা এবং সাক্ষরতার সঙ্গে কী সম্পর্ক কোভিডের

দারিদ্র্যের সঙ্গে কোভিড ১৯ সংক্রমণের গোঁড়ায় তেমন কোনও সম্পর্ক ছিল না। ভারতে এই মারণ ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস থেকে স্পষ্ট, তার আমদানি হয়েছে বিদেশ থেকে। বিদেশে থাকা যে সব নাগরিক মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন, তাঁরাই এই ভাইরাসের বাহক। বিমানবন্দরে দেহের তাপমাত্রা স্ক্রিনিং-এর ব্য‌বস্থা করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে হয় দেরি হয়ে গিয়েছে, আর নয়তো তাপমাত্রার স্ক্রিন করে বাহকদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এঁরা এবং এঁদের পরিবারই মূলত সংক্রমিত হচ্ছিলেন এবং বলাই বাহুল্য‌, তাঁরা কেউ দরিদ্র নন।
দারিদ্র্যের সঙ্গে সংক্রমণের সম্পর্ক প্রকট হয়ে উঠল দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই সময় মুম্বইয়ের ধারাভি এবং কলকাতায় গরিব মানুষ অধ্য‌ুষিত ওয়ার্ডগুলি একের পর এক রেড জোনে পরিণত হতে শুরু করল। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ কেন, কীভাবে ছড়িয়েছে তা সরকারি বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, কিন্তু এই সব এলাকার সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে দারিদ্র্য ও কষ্টের জীবন-যাপনের যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে তা একেবারে স্পষ্ট।

সম্প্রতি কলকাতার কনটেইনমেন্ট জোন নিয়ে কিছু তথ্য‌ সরকার প্রকাশ করেছে। তা বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শহরের দরিদ্রতম অংশই কোভিড ১৯ সংক্রমণের প্রধান উৎস। কলকাতার কনটেইনমেন্ট এলাকার তালিকা অনুযায়ী, রোগ ধরা পড়ার নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ৬ নম্বর বরো, যা কি না বেলেঘাটার দক্ষিণপ্রান্ত থেকে পার্ক সার্কাস চার নম্বর ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। ট্যাংরা, তপসিয়া, পিলখানা এই অঞ্চলেরই ভিতর। কলকাতায় সবচেয়ে বেশি কোভিড ১৯ রোগী মিলেছে এই বরোর ৬০ নম্বর ওয়ার্ডে। এর পরই সংক্রমণের নিরিখে এগিয়ে আছে ৫ নম্বর বরো। রাজাবাজার, শিয়ালদা, কলেজ স্ট্রিট এই বরোর ভিতরে পড়ে।

কলকাতার কনটেইনমেন্ট জোনের তালিকা জানতে ক্লিক করুন, Kolkata

 

কিন্তু কেন এই অঞ্চলগুলিতে বেশি করোনা সংক্রমণ? 

সেনসাস রিপোর্টের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যাক। ৬০ নম্বর ওয়ার্ড বা লিন্টন পোস্ট অফিস সংলগ্ন ওয়ার্ডটিতে ২০১১ র সেনসাস অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৩৫,৭৩২। হাউসহোল্ড বা এক হাঁড়িতে খাওয়াদাওয়া করা পরিবারের সংখ্যা ৬,৭৫৫টি। অর্থাৎ, এই ওয়ার্ডে হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্যা ৫.২৮। সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশ। রাজাবাজার অঞ্চলের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডটিরও (এটি ৪ নম্বর বরোর ভিতরে) হিসেব নেওয়া যেতে পারে। এখানে পরিবার (হাউসহোল্ড) পিছু জনসংখ্যা ৫.২৭। রাজাবাজারের ৫ নম্বর বরোর ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড, অর্থাৎ বরফকল, খালপাড় অঞ্চলে পরিবার পিছু জনসংখ্যা ৫.৯৫ বা প্রায় ৬ বলা যায়। ২৮ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৭১.৪৭ এবং ৬১.১২ শতাংশ। অর্থাৎ, সাক্ষরতার নিরিখেও এই ওয়ার্ড দুটি কলকাতার মধ্য‌ে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া হিসেবে চিহ্নিত। দারিদ্র্য মাপার যে সব নিক্তিগুলিকে অর্থনীতিবিদরা মান্য‌তা দেন, তার মধ্য‌ে সাক্ষরতার হার অন্য‌তম। এছাড়াও পরিবার পিছু ঘরের সংখ্য‌া, পরিবারটি কোথা থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে, সেগুলিও মাপকাঠি হিসাবে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য‌। কিন্তু পাঠকদের কাছে বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য‌ আমরা হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌ার পাশাপাশি সাক্ষরতার হারও তুলে ধরতে চাইছি।
সংক্রমণের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ৬ নম্বর বরোর আরও দুটি ওয়ার্ডের হিসাবেও দেখা যাচ্ছে হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া বেশি এবং সাক্ষরতার হার কম। এই বরোর ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডটির মোট জনসংখ্য‌া ৩২,২৫৪। হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া ৫ র অল্প নীচে (৪.৭৫) হলেও সাক্ষরতার দিক দিয়ে পিছিয়ে (৭৮.২৬ শতাংশ)। ২০১১ এর জনগণনা অনুযায়ী কলকাতার সামগ্রিক সাক্ষরতার হার ৮৬.৩১ শতাংশ। ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডটির জনসংখ্য‌া ৩৬,২৩৫। এই ওয়ার্ডে হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া ৫.৪৩। সাক্ষরতার হার মাত্র ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ, সাক্ষরতার হারের দিক দিয়ে এই ওয়ার্ডটি কলকাতার একেবারে পিছনের সারিতে।
অন্য‌দিকে রেড জোন নয়, এমন ওয়ার্ডগুলির জনসংখ্যার হিসেব দেখা যাক। ৯১ নম্বর ওয়ার্ড বা কসবা, ঢাকুরিয়া অঞ্চলে পরিবার পিছু জনসংখ্যা ৩.৮। এই ওয়ার্ডের সাক্ষরতার হার ৮৫.৪ শতাংশ, যা কি না কলকাতার গড় সাক্ষরতার হারের কাছাকাছি। গড়িয়ায় ১১১ নম্বর ওয়ার্ডে পরিবার বা হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্যা ৩.৯। সাক্ষরতার হার কলকাতার গড় হারের চেয়ে বেশি, ৮৭.২১ শতাংশ। পাশের ব্রহ্মপুর ও বাঁশদ্রোণীর একাংশ নিয়ে গঠিত ১১২ নম্বর ওয়ার্ডটির জনসংখ্য‌া ৩২,৪০৪। হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া ৩.৮৭ এবং সাক্ষরতার হার কলকাতার গড়ের কাছে ৮৫.৮ শতাংশ। ১১৩ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ বাঁশদ্রোণী এলাকাও সে অর্থে কোভিড প্রভাব মুক্ত। সেখানে মোট জনসংখ্য‌া ৩৩,৪৭৫। হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া ৩.৯৩ এবং সাক্ষরতার হার ৮৫.৪৬ শতাংশ। উত্তর কলকাতার বাগবাজারের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে কোভিড সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা মাত্র ১। সেখানে পরিবার পিছু জনসংখ্যার অনুপাত ৪.৫। কিন্তু সাক্ষরতার হার ৮৩.০২ শতাংশ।
এই হিসেব থেকে বোঝা যাচ্ছে, পরিবার পিছু জনসংখ্যা ৫ এর বেশি এমন ওয়ার্ডগুলি কনটেইনমেন্ট জোনে পরিণত হয়েছে। যে সব বস্তি অঞ্চলে ঘর আর রাস্তার মধ্যে পার্থক্য‌ কম সেখানে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। জন-ঘণত্বের সঙ্গে পারিবারিক জনসংখ্যার ঘণত্ব গুলিয়ে ফেললে চলবে না। জন-ঘণত্বের হিসেব নিয়ে চললে সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে না। সমীক্ষার ভিত্তি করতে হবে হাউসহোল্ড বা এক হাঁড়িতে খাওয়াদাওয়া করা পরিবারের হিসাব ধরে। কারণ, সামাজিক দূরত্ব মেনে চললে জন-ঘণত্ব দিয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর হার সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা নাও যেতে পারে। কিন্তু পরিবারের মধ্যে যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়, বিপদ সেখানেই বেশি।
সেনসাস রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য‌ের হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া যেখানে ৪.৪৯, সেখানে কলকাতার হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া ৪.৩৮। অর্থাৎ, রাজ্য‌ের গড়পরতা হাউসহোল্ড সাইজের তুলনায় কলকাতায় তা কম। কিন্তু কলকাতার যে এলাকাগুলিকে প্রশাসন সংক্রমিত বা কনটেইনমেন্ট জোন হিসাবে চিহ্নিত করেছে, সেখানে কিন্তু হাউসহোল্ড পিছু জনসংখ্য‌া কলকাতার গড়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
এই তথ্য‌ বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে, পরিবার পিছু জনসংখ্যা ৫ এর বেশি এমন ওয়ার্ডগুলি দ্রুত চিহ্নিত করে সেখানে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, এমন সমস্ত মানুষের পরীক্ষা করলে কোভিড মুক্তির পথ মিলতে পারে।

তবে সবসময় যে পরীক্ষায় পর্যাপ্ত ফল পাওয়া যাবে তা না-ও হতে পারে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য‌ সংস্থার সংক্রমণ প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য‌ ডাঃ কে শ্রীনাথ রেড্ডি একটি প্রবন্ধে সমান জনসংখ্য‌ার দুটি দেশ বলিভিয়া ও বেলজিয়ামের মধ্য‌ে তুলনা করে দেখিয়েছেন, লাতিন আমেরিকার দেশটি অনেক কম পরীক্ষা করালেও সেখানে মারা গিয়েছেন মাত্র ৩৪ জন। অন্য‌দিকে, ইউরোপের দেশটি তুলনায় অনেক বেশি পরীক্ষা করালেও মৃত্য‌ুর সংখ্য‌া হাজার ছাড়িয়েছে। সংক্রমিতের সংখ্য‌াও বেশি। কেরালা ও মহারাষ্ট্রের তুলনা করেও একই ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছে। দেশের মধ্য‌ে কেরালাতেই একমাত্র করোনা গোত্রের অন্য‌তম ভাইরাসজনিত অসুখ সার্স ছড়িয়েছিল। সেই সময় কেরালার সরকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে এবং পরীক্ষা চালিয়ে সার্স রোগীদের চিহ্নিত করতে পেরেছিল। চিহ্নিত করে রোগীদের আলাদা করে দেওয়ার ফলে রাজ্য‌ে রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এগনোর ফলে সে রাজ্য‌ে বর্তমানে করোনা সংক্রমিতের সংখ্য‌া কমে এসেছে। কেরালায় মহারাষ্ট্রের চেয়ে অনেক কম পরীক্ষা হয়েছে। বেশি পরীক্ষা করা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রে রোগ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে সংক্রমিত এখনও সর্বাধিক, মৃত্য‌ুর সংখ্য‌াও বেড়েই চলেছে।

Comments are closed.