লকডাউনে বিপুল কর্মহানি, দারিদ্র্যের এক নয়া শ্রেণির উদ্ভব, ক্ষতিগ্রস্ত ৯৫.৩% দারিদ্র্যসীমার নীচের বস্তিবাসী, বলছে সমীক্ষা
২৫ মার্চ থেকে দেশব্যাপী লকডাউনের জেরে ভারতে তৈরি হয়েছে দারিদ্র্যের এক নয়া শ্রেণি। দেশের ১২ টি শহরে চালানো সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষেরই অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতির ফলে এই নতুন শ্রেণির উদ্ভব। সরকারি সংস্থার করা সমীক্ষা বলছে এই নয়া শ্রেণির ৯৫.৩ শতাংশই জানিয়েছেন, তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
লকডাউন ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে একক স্বনির্ভর ব্যবসা এবং সাধারণ শ্রমজীবীদের উপরও। সমীক্ষা বলছে, ৯৮.৯ শতাংশ একক স্বনির্ভর ব্যবসা অর্থাৎ হকার কিংবা বাজারে পণ্য বিক্রয়কারীর আয়ের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে লকডাউন। আবার সাধারণ শ্রমজীবী বা দিনমজুরদের ৯৭.৬ শতাংশ বলছেন তাঁদের আয়েও প্রভাব পড়েছে।
দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাসের লকডাউনে সাধারণ মানুষের রুজি রোজগার প্রশ্নের মুখে। এই অবস্থায় ভারতের শহরাঞ্চলের বস্তিবাসী মানুষের হাল কেমন? তা জানতে একটি সমীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন ও আবাসন মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্বান অ্যাফেয়ার্স (NIUA)। সাহায্য করে চেন্নাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিসন।
সেই সমীক্ষা বলছে, করোনা আর লকডাউনের জোড়া ফলায় দারিদ্র্যের এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। দেশের ১২ টি শহরে এই ‘নতুন শ্রেণি’ তৈরি হয়েছে লকডাউনে কাজ এবং আয় হারিয়ে, বলছে সমীক্ষা রিপোর্ট। যেখানে ৯৩.৫ শতাংশ ‘নতুন দরিদ্র’ পরিবার জানিয়েছে, এই লকডাউনের ফলে তাদের আয়ের মূল উৎস ভয়ঙ্করভাবে প্রভাবিত হয়েছে বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
করোনা ও লকডাউনের প্রভাবে দেশের বস্তিবাসী মানুষের জীবন ও জীবিকা কতখানি প্রভাবিত হয়েছে তা বোঝার জন্য কলকাতা, অনন্তনাগ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, গুয়াহাটি, হায়দরাবাদ, ইন্দোর, জয়পুর, কাঞ্চিপুরম, মুম্বই এবং শ্রীনগরে সমীক্ষা চালায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্বান অ্যাফেয়ার্স।
গত ২৪ এপ্রিল থেকে ৭ মে ফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে এই ১২ টি শহরের ১ হাজার ১৫৭ টি পরিবারের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়, জানতে চাওয়া হয় তাদের সংসারের হাল। কী কী তথ্য উঠে এল তাতে?
৮৫.৩ শতাংশ পরিবার কর্মহীন
সরকারি সমীক্ষা বলছে, ১২ টি শহরের ৮৫.৩ শতাংশ বস্তিবাসী পরিবার কাজ হারানোর কথা জানিয়েছে। দারিদ্র্য সীমার নীচে থাকা ৯১.৪ শতাংশ পরিবারের কর্তা বা কর্ত্রী কাজ খুইয়েছেন এই লকডাউনের মধ্যেই। গরিব এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত অবস্থায় থাকা ৮৬.২ শতাংশ পরিবার বলেছে তাদের কর্মহীন হয়ে পড়ার কথা। গরিব নয়, এমন ৭৫.৩ শতাংশ পরিবার আয়ের অভাবে ভুগছে, জানাচ্ছে রিপোর্ট।
সমীক্ষায় প্রকাশ, অনন্তনাগ বা জয়পুরের মতো ভারতের ছোট শহরে বসবাসকারী পরিবার তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই লকডাউনে। কাজ হারিয়েছেন বহু পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। এদিকে দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার মতো বড় শহরে ছাঁটাই তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এখনও বেতন আটকে আছে।
সমীক্ষা জানাচ্ছে, সংসারের আয় কমে আসায় বাড়ছে গার্হস্থ্য হিংসা। ৪০ শতাংশ বস্তিবাসী পরিবার জানিয়েছে, লকডাউনের পর বাড়িতে গোলমাল, হিংসা বেড়ে গিয়েছে।
দারিদ্র্যের নয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা আশু প্রয়োজন
সংশ্লিষ্ট সমীক্ষার প্রধান লেখক তথা NIUA এর অধ্যাপক দেবলীনা কুণ্ডু The Print নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, এই নতুন শ্রেণির গরিবের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত এই পরিবারগুলির সমস্যা দূর করার জন্য খাবার ও নগদ টাকা, দুইয়েরই ভীষণ প্রয়োজন। পাশাপাশি, এই পরিবারগুলির স্বাস্থ্যপরীক্ষাও জরুরি বলে জানাচ্ছেন অধ্যাপক কুণ্ডু।
কীভাবে বাঁচছেন ‘নয়া’ দরিদ্র্ররা?
এক কথায় ধার দেনা করে। সরকারি সমীক্ষা বলছে, গত ২৪ মার্চ প্রথম দফার লকডাউন থেকে ২৯.৬ শতাংশ পরিবার প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করা অর্থ দিয়ে সংসার চালাচ্ছে। ২৭.৩ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভাঙিয়ে খরচ চালাচ্ছে। যদিও সেই সম্বল অনেকেরই শেষ। ১৯.২ শতাংশ পরিবার পুরো সহায়সম্বলহীন পড়েছে। তারা বাধ্য হয়ে অন্যান্য সূত্র থেকে সাহায্যের দিকে তাকিয়ে। গরিব নয়, এমন ৩৪.৪ শতাংশ বস্তবাসী পরিবারের সংসার চলছে সঞ্চয়ের টাকার উপর ভর করে।
কেন্দ্রের তরফে ঘোষিত অতিরিক্ত রেশনের ফলে উপকৃত হয়েছে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৬৩ শতাংশ পরিবার। যদিও মাত্র ৪০.১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, কেন্দ্র বা রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা সরাসরি নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পেয়েছে।
Comments are closed.