চিনের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে পাকিস্তান, আরএসএস-এর মুখপত্রে উদ্বেগ প্রকাশ

বেশ কিছু বছর ধরেই পাক-চিন ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরস্পরকে ‘সব মরশুমের বন্ধু’ বলেও দাবি করে এই দুই দেশ। কূটনীতিবিদদের মতে, পাক-চিন এই ঘনিষ্ঠতার অন্যতম উদ্দেশ্য ভারতকে চাপে রাখা। এবার এই মর্মেই সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আরএসএসের ইংরেজি মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’এ। যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে পাকিস্তান কি চিনের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশে পরিণত হয়েছে?

কী আছে অর্গানাইজারের এই বিশেষ প্রতিবেদনে?

‘অর্গানাইজার’এর প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই পাক-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ডশিপ’ (সব মরশুমের বন্ধুত্ব), এই নীতির উপর ভিত্তি করে এগোচ্ছে। বিভিন্ন সময় দুই পাকিস্তান এবং চিনের কূটনীতিকরা জানিয়েছেন বা দু’দেশের পক্ষ থেকে বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের সম্পর্ক ‘পর্বতের থেকে বেশি উচ্চতাপ্রাপ্ত, মধুর থেকে বেশি মিষ্ট, সমুদ্রের থেকেও গভীর এবং ইস্পাতের থেকেও মজবুত।’ প্রতিবেদনের দাবি, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, অর্থনৈতিক বা সামরিকভাবে যখনই প্রয়োজন পড়েছে বা রাজনৈতিক সংকটে বা কূটনৈতিকভাবে পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন এসেছে, চিন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে। পারমাণবিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা লক্ষনীয়।
আরএসএস মুখপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে এই বৃহত্তর কৌশলগত সমঝোতা মূলত দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রথমত, পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতকে নিয়ে এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে দুই দেশেরই সুবিধা হয়। দ্বিতীয়ত, চিন এটা ভালো মতো জানে বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে কৌশলগতভাবেই তাদের পাকিস্তানকে হাতে রাখতে হবে। সম্প্রতি পাক-চিন এই সম্পর্ক অন্য মাত্রা পেয়েছে, নয়া উচ্চতায় পৌঁছেছে ২০১৩ সালের মে মাসে ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিসি) প্রকল্পের ঘোষণা হওয়ার পর থেকে। যদিও এই প্রকল্পের কাজ এমন কিছু অংশের মধ্যে দিয়ে যাবে যার ফলে এই অঞ্চলের স্থানীয় পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়তে পারে, এটা জানার পরও দুই দেশ এই প্রকল্পে সম্মতি দিয়েছে।
২০১৩ সালে যখন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী চিন সফরে যান তখন দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৮ টি চুক্তির মাধ্যমে এই প্রকল্পের কর্মসূচি শুরু হয়। পরে ২০১৫ সালে চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং পাকিস্তানে গেলে দুই দেশের মধ্যে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের আরও ৫১ টি চুক্তি হয়। মূলত পরিকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত এই চুক্তিগুলি প্রস্তাবিত সিপিসি’র পুরোটা জুড়েই অবস্থিত। কোনও বিদেশি সাহায্যের নিরিখে দেখলে এই চুক্তির মাধ্যমে চিনের থেকে পাকিস্তান যে সাহায্য পাচ্ছে সেটিই এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জঙ্গি হানা) পর থেকে আমেরিকার তরফে পাকিস্তানকে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছে, এই চুক্তির মাধ্যমে চিন পাকিস্তানকে তার দ্বিগুণেরও বেশি সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে!
এই প্রকল্প প্রস্তাবিত যে পথে যাচ্ছে এবং যে বিপুল অর্থ এর জন্য বিনিয়োগ করা হচ্ছে তা এই অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলির কৌশলগত অবস্থান ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের ওপর ভালো প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র ব্যবসা ও অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে চিন পাকিস্তানে এই প্রকল্প গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে তা ভাবলে ভুল হবে। এর কারণ আরও গভীরে। পাকিস্তানের নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পকে গেম চেঞ্জার বলে দাবি করছে। তাই প্রকল্প এলাকায় বিক্ষোভ এবং আভ্যন্তরীণ বিরোধ সত্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর পাক নেতৃত্ব।
উল্লেখযোগ্যভাবে ২০০৬ সালে পাকিস্তান চিনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর দুই দেশের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের মধ্যে পাকিস্তানই সবথেকে বেশি চিনা পণ্য আমদানি করে থাকে। বিভিন্ন পাক সংবাদপত্রেও দাবি করা হচ্ছে, এই প্রকল্প পাকিস্তনের অর্থনীতির প্রায় সবকটি ক্ষেত্রকে ও পাকিস্তান সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী হতে চিন সাহায্য করলে কিছু বলার নেই, কিন্তু বিপুল দেনা চাপিয়ে ধীরে ধীরে চিন পাকিস্তানের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠলে তা ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।

Comments are closed.