অস্ট্রেলিয়াতে আদানিদের কয়লা খনির পরিবেশগত ছাড়পত্র ফের বাতিল করল কুইন্সল্যান্ড প্রশাসন, প্রকল্প বিশবাঁও জলে
পরিবেশ দূষণ এবং জীববৈচিত্রের ক্ষতির আশঙ্কা উড়িয়ে মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে প্রকল্প তৈরির বরাত পেয়েছে নরেন্দ্র মোদী ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির সংস্থা। কিন্তু ঠিক একই কারণে আটকে গেল অস্ট্রেলিয়ার ক্যুইন্সল্যান্ডে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্রিনফিল্ড কারমাইকেল কয়লা খনি। ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল ক্যুইন্সল্যান্ডের গ্যালিলি বেসিনে কারমাইকেল কয়লা খনি তৈরির বরাত পায়। কিন্তু তারপর এক দশক কাটতে চললেও, এক ইঞ্চিও এগোয়নি খনি তৈরির কাজ। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডেরাল গভর্নমেন্ট ফর ডেভলপমেন্টের কাছ থেকে ছাড়পত্রও পেয়েছে সংস্থা। কিন্তু ঠিক তার পরেই দেশে নির্বাচন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যত আদপেই বিশবাঁও জলে।
কিন্তু মূল সমস্যা অন্যত্র। অস্ট্রেলিয়ার এই অংশেই বাস কালো গলার ফিঞ্চ পাখির। বিরল প্রজাতির এই পাখির বংশবৃদ্ধিতে বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে কয়লা খনি, এমনটাই মনে করছে সে দেশের প্রশাসন এবং পরিবেশবিদরা। একটি কয়লা খনিকে ছাড়পত্র দিতে গিয়ে বিপন্ন প্রজাতির ফিঞ্চদের নিয়ে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে নারাজ অজি প্রশাসন। তাই ফেডেরাল গভর্নমেন্টের ছাড়পত্র এলেও, সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সরকার কোনওভাবেই ছাড়পত্র দিতে নারাজ আদানিকে।
মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে একরের পর একর এলাকা আদানিদের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার। পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা উড়িয়ে আদানির মতো সংস্থাকে বন-জঙ্গলের বরাত তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশবিদদের। এর ফলে সরাসরি বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে, চরম সঙ্কটে বিস্তীর্ণ এলাকার জীববৈচিত্র, দোসর হিসেবে রয়েছে ব্যাপক দূষণের ভ্রুকুটি। ঠিক একই পরিস্থিতি অস্ট্রেলিয়াতেও। পার্থক্য কেবল একটাই, ভারতে যেখানে বিপুল পরিমাণ বনভূমি বাণিজ্যিক স্বার্থে আদানিদের হাতে তুলে দিতে হাত কাঁপেনি সরকারের, সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবেশ দূষণমান পরীক্ষায় ফেল করে, আদানিদের প্রকল্পে তালা।
শুক্রবার দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবেশের কথা মাথায় রেখে যেখানে আরও বেশি পরিমাণে রিনিউয়েবল এনার্জি বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করা হচ্ছে বিভিন্ন উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে, সেখানে এমন বিপুলায়তন কয়লা খনি কেন তৈরি হবে, তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন আসন্ন, তাই এই প্রশ্নে লেগেছে রাজনীতির ছোঁয়া। ক্ষমতাসীন দল কিংবা বিরোধী, সকলেই একটা বিষয়ে একমত, তা হল পরিবেশ দূষিত করে এমন কোনও প্রকল্প অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তৈরির ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে ক্রমেই বাড়ছে পরিবেশ সচেতনতা। সেই প্রেক্ষিতে কারমাইকেল খনির বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়াজুড়েই জনমত তৈরি হয়েছে। কারমাইকেল খনি যে আদানি গ্রুপকে বাণিজ্যিক ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না, তা কর্ণধার গৌতম আদানিও সম্ভবত বুঝতে পারছেন, বলে জানাচ্ছে দ্য গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘২০১৫ সাল থেকে টাউন্সভিলের বাসিন্দারা প্রকল্প শিলান্যাসের একের পর এক ঘোষণাই কেবল শুনে গেলেন, ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সদর দফতর উদ্বোধন হল, বলা হল, প্রকল্পের ফিতে কাটতে নিজে আসবেন গৌতম আদানি। কিন্তু বৃষ্টির আশঙ্কায় আদানির আসা হয়নি। তারপর টাউন্সভিলে আবার সূর্য উঠেছে ঠিকই, তবে গৌতম আদানি আর ফিরে আসেননি।’
প্রতিক্রিয়ায় অস্ট্রেলিয়ায় আদানি গ্রুপের সিইও লুকাস ডো জানান, যদিও তাঁদের তরফে এই প্রকল্প পরিবেশ বান্ধব বলেই মনে করা হচ্ছে, তবে কুইন্সল্যান্ড প্রশাসনের আবেদনের ভিত্তিতে নতুন করে প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে একটি হিসেব তুলে ধরে, আদানির খনি প্রকল্পের অলাভজনক অবস্থা বোঝানো হয়েছে। বিশ্বের সেরা, নিউক্যাসেল খনির কয়লার বর্তমান দাম, টন প্রতি ৯০ মার্কিন ডলার। সেখানে কারমাইকেল খনিতে উৎপাদন শুরু হলে তার প্রারম্ভিক মূল্য হবে ১১০ মার্কিন ডলার প্রতি টন। পাশাপাশি কারমাইকেল খনিতে যে কয়লা উত্তোলন হবে, তা যথেষ্টই নিম্নমানের। ফলে বাণিজ্যিক লাভের সুযোগ যে নেই, তা জলের মত পরিষ্কার, বলে মনে করছে দ্য গার্ডিয়ান।
Comments are closed.