মানুষের শারীরিক ও মামসিক সুস্থতার জন্য ঘুম অত্যন্ত জরুরি। ঠিকঠাক ঘুমের অভাবে হতে পারে মারাত্মক অসুখ যা কখনও কখনও নিতে পারে প্রাণঘাতী রূপ।
সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট প্রফেসর শঙ্কু বলতেন, আমরা জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই, যা পুরোপুরি অপচয়। বাস্তবে বহু বিখ্যাত মানুষের কম ঘুমের অভ্যেস থাকলেও গল্পের পাতায় বিস্ময়কর জ্ঞানের অধিকারী প্রফেসর শঙ্কু এই একটি ব্যাপারে পুরোপুরি ঠিক ছিলেন না। শরীর, বয়স অনুযায়ী এক একজন মানুষের ঘুমের প্রয়োজন এক এক রকম।
পর্যাপ্ত ঘুম শরীরে আনে প্রশান্তি, বাড়ায় কর্মস্পৃহা। আবার পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে হতে পারে মারাত্মক অসুখ। আবার অতিরিক্ত ঘুমেও শরীরের উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি।
স্লিপ ডিসঅর্ডার (Sleep Disorder)
Insomnia, ঘুমনোর সময় অস্বস্তি, ঘুমানোর ছন্দের পরিবর্তন, বা ঘুমের সময় বাধা সৃষ্টি ইত্যাদি পরিস্থিতি sleep disorder -এর সাথে সম্পর্কিত। স্লিপ ডিসঅর্ডারের ফলে দিনের বেলা ঘুম পাওয়া ও রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে না পারার প্রবণতা দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে এই গুরুতর পরিস্থিতিতে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। আর বর্তমান জীবনযাত্রায় মানুষ ঘুমের ব্যাপারে খুব অমনোযোগী। কারণ অথবা অকারণে অনেকেই রাত জেগে কাটান। কিন্তু জানেন না অনিয়মিত ঘুমের কারণে মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
স্লিপ ডিসঅর্ডারের লক্ষণ ও উপসর্গ (Common Symptoms of Sleep Disorder)
স্লিপ ডিসঅর্ডার কিছু কারণের উপর নির্ভর করে। আর এর উপসর্গও বহু। তবে নিদিষ্ট কিছু সাধারণ উপসর্গ হল, ঘুম আসার সময় অসুবিধা সৃষ্টি বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং পুনরায় ঘুমোতে অসুবিধা, উদ্বেগ, বিরক্তিবোধ, অবসাদ ইত্যাদি
এক্সপ্লোডিং হেড সিন্ড্রোম
গভীর ঘুমের মধ্যে হঠাৎ অস্বাভাবিক জোরে কোন শব্দে জেগে উঠেছেন কখনও? অনেকেরই এই সমস্যা রয়েছে৷ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন সত্যিই কোথাও শব্দ হয়েছে৷ আসলে একেবারেই তা নয়৷ এটি ঘুম সংক্রান্ত একটি রোগ৷ নাম এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম৷ খুব অদ্ভুত এই রোগটি বেশি ঘুমোনোর কারণে হয়ে থাকে৷
স্লিপ প্যারালিসিস
ঘুমের সময় স্বপ্নে অদ্ভুত কিছু থেকে বাঁচার চেষ্টায় হাত-পা, শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করেন অনেকে। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও অঙ্গ নাড়াতে পারেন না৷ এই সমস্যায় কম বেশি সকলেই পড়েন৷ অনিয়মিত ঘুমের সময় বা অনিদ্রাজনিত কারণে এই রোগ দেখা যায়৷
প্যারাসমনিয়া
এটি হল ঘুম সম্পর্কিত রোগ যা মানুষকে ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক কাজ করতে বাধ্য করে৷ এই রোগের কারণে অনেকে অপরাধ পর্যন্ত করতে পারেন৷ ঘুমের ঘোরে গাড়ি চালানো, হত্যা, শিশুনির্যাতন এবং ধর্ষণ এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ৷ মানসিক চাপ বা অনিদ্রার সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে এই ধরনের রোগ দেখা যায়৷
এবার দেখে নেওয়া যাক, ঘুমের অভাবে মারাত্মক কী কী অসুখ হতে পারে৷
চিন্তাশক্তি হ্রাস
অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন? কখন ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলছেন বুঝতে পারছেন না? তাহলে হতে পারে, আপনি প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুমোচ্ছেন। প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুম আমাদের কর্মক্ষমতা, সামাজিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটায়। ঘুমের স্বল্পতা আমাদের সারাদিনের ক্লান্তিভাব, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ নিয়ন্ত্রণে ও অহেতুক উদ্বেগের জন্য দায়ী।
চেহারায় বয়স্ক ভাব ও ত্বকের সাবলীল সৌন্দর্য নষ্ট
ধারাবাহিকভাবে ঘুমের অভাব হলে ত্বকের জেল্লা কমে যায়, অকালে চেহারায় ফোটে বয়সের ছাপ। কারণ ঘুমের সময় শরীর তার মৃত কোষগুলোকে সরিয়ে নতুন কোষের সংস্থাপন করে, তাদের পুষ্টির জোগান দেয়। সঠিক পরিমাণ ঘুম শরীরের ৬০ শতাংশ ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণে সাহায্য করে। কম ঘুম শরীরে গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণও কমিয়ে দেয় ও শরীর ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে।
ওবেসিটি
বেশি ঘুমোলে ওজন বাড়ে, তা অনেকেই জানেন। তাই অনেকেরই ধারণা যে, কম ঘুম হলে নিশ্চয়ই ওজন কমে? কিন্তু তা ঠিক নয়। ঘুমের অভাব আমাদের খিদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। আকর্ষণ বাড়ায় হাই ফ্যাট খাবারের প্রতি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা দিনে ছয় ঘণ্টা বা তার কম ঘুমোন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা যারা দিনে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমোয় তাদের থেকে ৩০ শতাংশ বেশি।
ডিপ্রেশন
অপর্যাপ্ত ঘুম বা ঘুমের কোন সমস্যা ডিপ্রেশনের একটি আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা বলছে, হতাশাগ্রস্ত মানুষ ছয় ঘণ্টার কম ঘুমোন। আর সেটা ডিপ্রেশনকে যেমন আরও পোক্ত করে, তেমনি ইনসমনিয়ার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইনসমনিয়ার চিকিৎসা করলে ডিপ্রেশন ভালো হয়ে যায় এবং বিপরীতে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করালে insomnia ভালো হয়ে যায়।
অনিয়মিত ঘুমের কারণে আরও যে যে রোগের আশঙ্কা বাড়ে:
হার্টের সমস্যা বৃদ্ধি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়া, হজমের সমস্যা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসুখ হতে পারে শুধুমাত্র ঘুমের অভাব কিংবা অনিয়মিত ঘুমের কারণেই।
ঘুমের সমস্যা সমাধানে কী করবেন (How to Fix Common Sleep Problems?)
প্রতিদিন অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন। তবে ঘুম না আসা যদি রুটিন হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়া ঠিকঠাক ঘুমের জন্য যা করতে পারেন, সেগুলি হল-
ঘুমানোর আগে মদ্যপান ও গুরুপাক আহার নয়,
ঘুমোতে যাওয়ার আগে গুরুপাক আহার, চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।
প্রকৃতপক্ষে ভালো ঘুমের প্রক্রিয়া শুরু হয় বিছানায় যাওয়া সময়ের অনেক আগেই। তাই ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত ৬ ঘণ্টা আগে কফি জাতীয় বা ক্যাফিন আছে এমন কোনও পানীয় পান করবেন না।
কাজেই ভালো করে ঘুমতে হলে বিকেলের পর থেকে চা, কফি এবং কোক-পেপসির মতো ‘ফিজি ড্রিংকস’ একেবারে বাদ রাখার কথা ভাবুন।
খালিপেট কিংবা ভরপেটে ঘুম নয়
ভরপেট খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমোতে যাবেন না। আবার কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াও মোটেই ঠিক নয়। তাই রাতে পরিমিত পরিমাণ খাবার খান। যদি পারেন, তাহলে ঘুমের অন্তত দু’ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেয়ে নিন।
অ্যালকোহল বাদ
আপনাকে ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করতে পারে মদ। কিন্তু আপনার সেই ঘুম খুব গভীর হবে না। যাকে বলে ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ বা ‘আরইএম স্লিপ’, তা মানুষের স্মৃতি ও শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অগভীর ঘুমে তার ক্ষতি হয়। তাছাড়া মদ্যপানের ফলে শরীরে বেশি প্রস্রাব তৈরি হয়, তাই রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গলা শুকিয়ে গিয়ে মাঝপথে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ঘুমের আগে রিল্যাক্স করার জন্য কিছু করুন
বিছানায় যাওয়ার আগে এমন একটা কিছু করুন যা আপনার দেহ ও মনকে চাপমুক্ত করবে। এটা হতে পারে গান শোনা, বই পড়া কিংবা ছবি আঁকা। নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রতিদিন ঘুমের আগে এমন কিছু করুন যাতে টেনশন ফ্রি থাকতে পারেন।
ঘুমনোর আগে নাতিশীতোষ্ণ জলে স্নান করতে পারেন, মেডিটেশন বা ধ্যান করতে পারেন। ঘুমের আগে ডায়েরি লেখা, বই পড়া, বা আলো কমিয়ে দিয়ে গান শুনতে পারেন। তবে ঘুমের আগে এমন গান শুনতে হবে যাতে মনের সব চাপ দূর হয়ে গিয়ে একটা শিথিল ভাব আসে।
ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি
ঘুমের সমস্যা থাকলে ঘরে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তাই রুটিন করে প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমোতে যান। যে ঘর অন্ধকার, অতিরিক্ত গরম নয়, জিনিসপত্রে ভরা নয়, তেমন ঘর বেছে নিন। বেডরুমে আসবাবপত্র যত সীমিত হয় তত ভালো। কারণ এতে ঘুমের আগে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে না।
ঘুমের আধ ঘণ্টা আগে থেকে টিভি, স্মার্টফোন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
যদি আপনি রেডিওয় কিছু শোনেন তাহলে স্লিপ টাইমার ব্যবহার করুন যাতে এটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।
Comments are closed.