গোটা বিশ্ব যখন হন্যে হয়ে করোনা টিকার সন্ধান করছে, ঠিক তখনই রাশিয়া জানিয়ে দিল তাদের ভ্যাকসিন প্রস্তুত। লেনিনের দেশের এই স্পুটনিক ৫ নিয়ে এখন পক্ষে বিপক্ষে আড়াআড়ি ফাটল। কেউ বলছেন রাশিয়ার ভ্যাকসিন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়, আবার কেউ স্পুটনিক ৫ এই বিশ্বাস রাখছেন।
এখন প্রশ্ন হল, কেন রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহের বাতাবরণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভ্লাদিমির পুতিন যে মহানাটকীয় কায়দায় ভ্যাকসিনের আবরণ উন্মোচন করেছেন, তাতে বিজ্ঞান কম, রাজনীতি বেশি। কেন এ কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে পিছন দিকে, ঠান্ডা যুদ্ধের আমলে।
১৯৫০ সাল। সুপার পাওয়ার কে তা নিয়ে আমেরিকা, সোভিয়েতের তুল্যমূল্য লড়াই তুঙ্গে। আলপিন টু এলিফ্যান্ট, একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রশ্নে, কোনও দেশই সুযোগ ছাড়ছে না। প্রতিযোগিতা ক্রমেই রেষারেষির আকার নিয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞান তখনও স্রেফ বইয়ের পাতায়। কিন্তু আমেরিকা ও রাশিয়া, দু’দেশেই মহাকাশ গবেষণা এগোচ্ছে ঝড়ের গতিতে। যদিও মহাকাশযান পাঠিয়ে অন্তরীক্ষ পরিদর্শন তখনও ভাবনার বাইরে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর রকেট সায়েন্টিস্ট সের্গেই কোরোলেভের তৈরি করা স্পুটনিক মহাকাশে পাঠায় সোভিয়েত। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম মহাকাশযান। কিন্তু সোভিয়েতের সেই প্রক্রিয়া মাঝপথেই ফেল করে। একই বছর ৩ নভেম্বর রাশিয়া মহাকাশে পাঠায় স্পুটনিক ২। তাতে ছিল কুকুর লাইকা, যার মৃত্যু হয়। যান্ত্রিক গোলমালে ১৬২ দিন মহাকাশ প্রদক্ষিণ করে স্পুটনিক ২। পরপর দু’বার ধাক্কা খেয়েও হতাশ হননি সের্গেই কোরোলেভ। ১৯৫৮ সালের মে এবং ১৯৬০ সালের মে মাসে পরপর স্পুটনিক ৩ ও ৪ মহাকাশে পাঠায় মস্কো। কিন্তু সাফল্য তখনও অধরা। ১৯ অগাস্ট, ১৯৬০, মস্কো মহাকাশে পাঠায় স্পুটনিক ৫। তাতে ছিল বেলকা ও স্ট্রেলকা নামের দুটি কুকুর, বেশ কিছু ইঁদুর, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং মানুষের আকৃতির ম্যানিক্যুইন ইভান ইভানোভিচ। সেদিন মানব সভ্যতায় নয়া ইতিহাস লেখা হয়। স্পুটনিক ৫ প্রথম মহাকাশযান, যা প্রাণী বহন করে অন্তরীক্ষ প্রদক্ষিণ করার পর আবার সম্পূর্ণ নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। আমেরিকা যখন গবেষণাগারের চার দেওয়ালের ভিতরেই মহাকাশ গবেষণা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে, তখন প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত রকেট পাঠিয়ে আবার সফলভাবে ফিরিয়েও আনছে। তৈরি হয় স্পুটনিক মোমেন্ট শব্দবন্ধ। বস্তুত এর পরপরই রকেট নিয়ে মহাকাশে উড়ে যান ইউরি গ্যাগারিন।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সোভিয়েতই যে আসল সুপার পাওয়ার, স্পুটনিক ৫ তাতে সিলমোহর দিয়েছে বলে মনে করে মস্কো। সেই থেকে স্পুটনিক ৫ নামটি রাশিয়ার বড় প্রিয়। ১৯৬০ এর ৬ দশক পর ফের সেই প্রিয় জিনিস দিয়েই নামকরণ করা হল রাশিয়ান ভ্যাকসিনের। উদ্দেশ্যটা খুব স্পষ্ট, আমেরিকা সহ গোটা বিশ্বের সামনে নতুন করে রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির। আর ঠিক এই কারণেই রাশিয়ার করোনা টিকায় যত না বিজ্ঞান তার চেয়েও বেশি করে রাজনীতি ভরা আছে বলে মনে করছে ইউরোপ-আমেরিকা।
কিন্তু বাকি বিশ্বের এমন অভিযোগের কারণ কী? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের দেখতে হবে কোন পথে স্পুটনিক ৫ ভ্যাকসিন ট্রায়াল পর্ব পেরিয়ে প্রকাশ্যে এল। গেমালায়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর এপিডেমিওলজি অ্যান্ড বায়োলজির ডাক্তার আলেকজান্ডার গিনসবার্গের টিম রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দফতরের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেছে স্পুটনিক ৫ ভ্যাকসিন। এই টিকার ক্ষেত্রে স্টেজ ওয়ান প্রয়োগ করা হয়েছিল পশুর উপর। জুন মাসে ফেজ টুতে ৩৮ জন সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান মানুষের শরীরে ট্রায়াল চালানো হয়। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু তারপরই বদলে যায় পুরো প্রক্রিয়া। প্রচলিত বিজ্ঞান অনুযায়ী স্টেজ থ্রি ট্রায়াল চালানোর কথা বহু মানুষের উপর। যাতে কার্যকারিতা স্পষ্ট হয়। কিন্তু রাশিয়ায় এই পদ্ধতি একটু অন্যরকম। কীরকম সেই পদ্ধতি? জানা যাচ্ছে, থার্ড ফেজ ট্রায়ালের জন্য গেমালায়া বেছে নিয়েছিল রাশিয়ার ৩৮ জন ধনী, সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যকে। তাঁদের উপর প্রয়োগ করা হয় স্পুটনিক ৫। এই পর্যায়েই পুতিনের মেয়ের শরীরেও ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। থার্ড ফেজের পরীক্ষা সফল হয়েছে বুঝে, দুনিয়ার সামনে পর্দা উন্মোচন করা হয় প্রথম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের।
এখন প্রশ্ন হল, ৩৮ জন ধনীর শরীরে প্রয়োগ করে সাফল্য কীভাবে সর্বজনীন সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে? ক্রেমলিন বলছে নিরাপদ না হলে কোনও প্রভাবশালী কি এই টিকা নিতে রাজি হতেন? পাল্টা আমেরিকার প্রশ্ন, এই টিকা যে সম্পূর্ণ নিরাপদ তা জানা যাচ্ছে কীভাবে? রাশিয়া কি গোপনে বহু মানুষের উপর ট্রায়াল চালিয়েছে? প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্নের আবহে একটা জিনিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সম্পদের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা নাগরিকদের উপর কেন টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করল রাশিয়া? এর উত্তর লুকিয়ে অতীতের ইতিহাসে। অনেকে বলছেন, এটা আসলে বাকি দুনিয়ার বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলা রাশিয়ার বিজ্ঞান গবেষণার মূল পার্থক্য। সোভিয়েত মনে করত ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সময় যে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান মানুষ বেছে নেওয়া হয়, তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ কার্যক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগ হবে অসুস্থদের শরীরেও। তৃতীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের শরীরে টিকা প্রয়োগ হলে তার ফল সত্যের অনেক কাছাকাছি পাওয়ার সম্ভাবনা। তাই থার্ড ফেজে সাধারণ ধনীদের বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ধনীরাই কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতেও লুকিয়ে লাল পতাকার ছায়া। যে টিকা গোটা জনসংখ্যার প্রাণ বাঁচাবে তা আদৌ উপযুক্ত কিনা খতিয়ে দেখবেন সমাজের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষেরা। যাতে সবার মধ্যে এই বার্তা যায়, খারাপ কিছু হচ্ছে কিনা তা দেখতে গিনিপিগ হিসেবে বড়লোকদের বেছে নিয়েছে জনগণের সরকার।
তবে এটা নতুন কিছু নয়। রাশিয়ার বিখ্যাত এপিডেমিওলজিস্ট অ্যালেক্সি চুমাকোভ জানাচ্ছেন তাঁর ছেলেবেলার কথা। তাঁর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন ভাইরোলজিস্ট। কাজ করছিলেন পোলিও টিকা নিয়ে। দম্পতি সেই টিকা প্রথম হিউম্যান ট্রায়াল করেছিলেন তাঁর তিন সন্তানের উপর। চিনির কিউবে ভ্যাকসিন ভরে অ্যালেক্সিদের ৩ ভাইকে গেলানো হয়েছিল পোলিও টিকা। সোভিয়েত রাশিয়ায় টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজের লোককে বেছে নেওয়াই দস্তুর। স্পুটনিক ৫ এ তারই ঝলক দেখেছে বিশ্ব।
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, এত কম মানুষের উপর প্রয়োগ করে বিশ্ব বাজারে স্পুটনিক ৫ ছেড়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে। আবার অন্য একটি পক্ষ বলছেন, পুতিনের কাছে হারানোর কিছু নেই। বরং এই ভ্যাকসিন ক্লিক করলে, তা দিয়ে বর্তমান দুনিয়ায় রাশিয়া তার হারানো ওজন খুঁজে পেতে পারে। আর এই কথা মাথায় রেখেই ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি উসকে ভ্যাকসিনের নামকরণ এবং তার বিপণনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুতিনের রাশিয়া। যার ফলশ্রুতি, বিজ্ঞানকে পিছনের আসনে ঠেলে দিয়ে সামনে চলে এসেছে রাজনীতি।
Comments are closed.