দারিদ্র জয় করে মাধ্যমিকে সফল মানিকতলা খালপাড় বস্তির মাশরিকা, স্বপ্ন আইনজীবী হওয়ার

১৪ পেরোতে না পেরোতেই মেয়েরা পাত্রস্থ হত। আর ছেলেদের বিয়ের বয়স মেরেকেটে ১৬ কিংবা ১৭। না, কোনও প্রান্তিক গ্রামাঞ্চল নয়, কলকাতা শহরের মানিকতলা খালের পূর্বপাড়ের কাহিনি এটাই। নিম্ন মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত এই অঞ্চল থেকে ৫০ বছরে এই প্রথম কোনও মেয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি টপকালেন। সৌজন্যে ভাষা ও চেতনা সমিতির পাঠশালা।

ঠিকানা মানিকতলার ৩০ এ ক্যানাল ইস্ট রোড। বাবা ভ্যান চালক, মা গৃহবধূ। একচিলতে ঘরে বাবা- মা, তিন বোন এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন মাশরিকা খাতুন। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের মেয়েটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নজির গড়লেন। বাণীপীঠ গার্লস স্কুলের ছাত্রীর ইচ্ছে বড় হয়ে আইনজীবী হওয়ার। আর তাঁর সেই স্বপ্ন সত্যি করতে পাশে দাঁড়িয়েছে ভাষা ও চেতনা সমিতির পাঠশালা। বছর চারেক আগে এই সংগঠনই স্কুলছুট মাশরিকার পড়ার ভার নিয়েছিল। সংগঠনের সম্পাদক অধ্যাপক ইমানুল হকের কথায়, মেয়েটির স্বপ্ন সত্যি করতে আমরা পাশে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।

এখানকার মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি টপকাতে না টপকাতেই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াই রীতি। ছেলেদেরও মোটামুটি সেই একই হাল। তবে এখন ছবিটা অনেকটাই পাল্টেছে। স্কুলছুটের সংখ্যা এখন শূন্য, ভাষা ও চেতনা সমিতির চেষ্টায় বাল্যবিবাহও আজ অতীত। ২০১৬ সালে এখান থেকে প্রথম একজন মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। এখন সেই যুবক স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করছেন। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে গত ৫০ বছরে মাশরিকা খাতুনই প্রথম যিনি মাধ্যমিক পাশ করলেন, জানান ইমানুল হক।

২০১৬ সালের জুন মাস থেকে স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের ফের বইমুখো করতে তৈরি হয় ভাষা ও চেতনা সমিতির পাঠশালা। ২০১৭ সালে ফুটপাথে বইঘর তৈরি করে এই সংগঠন। লক্ষ্য সবার জন্য শিক্ষা, সবাইকে শিক্ষিত করা। তার আগে রবীন্দ্র সদন চত্বরে কচিকাঁচাদের পড়ানো শুরু করলেও ২০১৬ সাল থেকে অধ্যাপক হক ও তাঁর সঙ্গীরা স্কুলছুট পড়ুয়াদের শিক্ষার ভার নেন। ২০ জন পড়ুয়া নিয়ে শুরু হওয়া এই পাঠশালার বর্তমান পড়ুয়া সংখ্যা ২১১। তাঁদেরই অন্যতম মাশরিকা খাতুন। এখানে শিক্ষকের সংখ্যা ১০ জন। তাঁরা কেউ প্রাক্তন অধ্যাপক, কেউ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, কেউ বা এমএ পাশ করা তরুণ।

পড়ুন: সিবিএসই’র দ্বাদশ শ্রেণিতে ৬০০ তে ৬০০! ইতিহাস নিয়ে পড়তে চান লখনউয়ের দিব্যাংশী

সংগঠনের তরফে খুদে পড়ুয়াদের আগ্রহ তৈরি করতে চিকিৎসক, আইনজীবী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার বিখ্যাতদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বপ্ন দেখানো হয়, চাইলে তাঁরাও একদিন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, উকিল হয়ে দেশের সেবা করতে পারে। একদিন এভাবেই কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে দেখে, তার বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হন মাশরিকা। মাথায় ঢুকে যায় আমাকেও বড় উকিল হতে হবে। আর তার সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভাষা ও চেতনা সমিতি। পারিবারিক অর্থাভাবে ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন মাশরিকা। সেখান থেকে ভাষা ও চেতনা সমিতির পাঠশালায়। তারপর মাধ্যমিক পাশ করে আজ অন্যান্য পড়ুয়াকেও উৎসাহ যোগাচ্ছেন মাশরিকা, সঙ্গে পরিবারের মুখেও হাসি ফুটেছে। মাশরিকাদের ছয় জনের সংসারে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। লকডাউনের জেরে পেশায় ভ্যান চালক বাবার রোজগার আরও কমেছে। সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি ভাষা ও চেতনা সমিতি নিজেদের উদ্যোগে গত তিন মাস ধরে মানিকতলা ক্যানাল পাড়ের প্রায় দুশো পরিবারকে খাবার যোগাচ্ছে।

সকলের দু’মুঠো অন্ন সংস্থান যেখানে কঠিন, সেই জায়গা থেকে মাশরিকার স্বপ্ন আইনজীবী হয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো, যাতে তাঁরা সুবিচার পান।

Comments are closed.