১৩ বছর বয়সে গ্যারেজে মেকানিকের কাজ দিয়ে জীবন শুরু, আজ ২৬ হাজার কোটির মালিক! চেন্নাইয়ের অরুণের বিশ্বজয়ের কাহিনি

বাড়িতে তীব্র অর্থাভাব। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ছেলেটিকে কাজ নিতে হয়েছিল মোটর গ্যারাজে। এর ৩৩ বছর পর সেই ছেলেটির নাম আসে এমন এক তালিকায় যা শুরু হয় ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গের নাম দিয়ে। খাবারের অভাবে যে ছেলে কান্না চেপে প্রিয় পোষ্যকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল, আজ ৩৯ বছর বয়সে এসে তিনি বিশ্বের ধনীদের তালিকায় থাকেন প্রথম দশে। না, কোনও গল্প বা সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। এটা রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে লড়াই করে ২৬ হাজার কোটি টাকার মালিকের কাহিনি। তিনি চেন্নাইয়ের অরুণ পুদুর।

কেউ জীবনে কতটা সফল তার বিচার কখনও সম্পদ দিয়ে করা উচিত নয়, কিন্তু শূন্য হাত থেকে শুরু করে নিজের চেষ্টায় একটা ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য তৈরি করার এই বাস্তব কাহিনি অনুপ্রাণিত করবে বহু মানুষকে।

চেন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম অরুন পুদুরের। মা হাউজ ওয়াইফ আর বাবা সিনেমাটোগ্রাফার। যাঁর রোজগার নির্ভর করত বছরের কোনও একটা বা দুটো শুক্রবারের সিনেমার হিট-ফ্লপের ভাগ্য দিয়ে। সেই সিনেমাটোগ্রাফার বাবা হয়ত স্বপ্নেও কল্পনা করেননি কয়েক বছর পর তাঁর ছেলের উত্থান হার মানাবে হিট ছবির গল্পকেও।

অরুণের বয়স তখন মাত্র ১৩। বন্ধুরা যখন স্কুল শেষে খেলাধুলো করছে, সে তখন ব্যস্ত কোনও বিগড়ে যাওয়া মোটরবাইক সারানোয়। এভাবেই অভাব অনটনের মধ্যে চলছিল মোটর মেকানিক অরুণের জীবন। কিন্তু আচমকা একদিন গ্যারাজ মালিক চাইলেন দোকান বিক্রি করে দিতে। আবার কোথায় কাজ খুঁজতে যাবেন অরুণ? মাকে অনুরোধ করলেন তাঁদের জমানো কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গ্যারাজটা কিনে নিতে।

ওই অল্প বয়সেই মেকানিকের কাজে হাত পাকিয়ে নিয়েছিলেন অরুণ। যে কোনও বিকল গাড়ি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারিয়ে ফেলার ক্ষমতা ততদিনে আয়ত্ত।  তাও আবার কোনও আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া। মেকানিক অরুণের তখন দারুণ নাম এলাকায়। গ্যারেজের সুনাম এমন জায়গায় পৌঁছল যে ইসরোয় কাজ করা কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁদের বিকল গাড়ি নিয়ে চলে যেতেন অরুণের কাছে। এটাই দারুণ উদ্বুদ্ধ করল মেকানিক অরুণকে। জীবনে সফল হওয়ার রসদ খুঁজে পেলেন তিনি। স্কুল আর হোমওয়ার্ক শেষে সোজা গ্যারেজ ছিল তাঁর ঠিকানা। তবে এবার শুধু রোজগার নয়, মেকানিকের কাজকে ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে সেলস, মার্কেটিং, কাস্টোমার হ্যান্ডলিং এর কাজে তাঁর দারুণ আগ্রহ। এদিকে বাবা তাগাদা দিচ্ছেন বাড়ির অবস্থা তো কিছুটা ভালো… এবার গ্যারাজ বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দাও। অগত্যা পাঁচ বছর দারুণ গ্যারাজ চালিয়েও তা বিক্রির জন্য লোক খুঁজতে লাগলেন অরুণ। অবশেষে একটা স্থানীয় কোম্পানি এই গ্যারেজ কিনতে চাইল অভাবনীয় দামে। এক কোটি টাকার বেশি দামে এই গ্যারেজ কিনে নিল সেই কোম্পানি। মজার কথা, অরুণ এই গ্যারেজ কেনার জন্য মায়ের কাছ থেকে নিয়েছিলেন ৮ হাজার টাকা!

যাই হোক, মেকানিকের কাজ ছেড়ে ততদিনে পড়াশোনায় মন বসিয়েছেন অরুণ। বাইকের খুঁটিনাটি হোক কিংবা কঠিন অঙ্ক, সমস্যা সমাধান আর শেখার তীব্র আগ্রহই ছিল অরুণের এক্স ফ্যাক্টর। পড়াশোনা শেষে জয়নগরের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে যোগ দিলেন অরুণ পুদুর। প্রতি বছর ওই সংস্থার টার্নওভার ছিল ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা। সংস্থার মালিক কথা দিয়েছিলেন লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি হলে বড় অঙ্কের কমিশন পাবেন অরুণ। সেই মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে নাওয়া খাওয়া ভুলে সংস্থার উন্নতিতে পরিশ্রম করে গিয়েছেন তিনি। একটা সময়ে সংস্থার টার্নওভার গিয়ে ঠেকল এক কোটি টাকায়। কিন্তু নিজের কমিশন চাইতেই মিলল অপমান। অরুণ বুঝে গেলেন লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া বলা কথার কোনও মূল্য নেই এই দুনিয়ায়। অপমান, অভিমান আর চরম শিক্ষা নিয়ে কোম্পানি ছাড়লেন তিনি।

আবার নতুন করে শুরু। স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে বারকয়েক ঠোক্কর খেলেন। তবে অরুণের কথায়, এই প্রত্যেকটা হোঁচট ছিল ভালো করে পথ চলার শিক্ষা। বুদ্ধিমান ছেলেটা বুঝে গিয়েছেন, এই ‘এজ অফ ইনফর্মেশন’এ দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্যবসাই পারে তাঁকে সাফল্যের দরজায় এগিয়ে দিতে। তৈরি করলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা Celframe। রিপোর্ট অনুযায়ী এই Celframe এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়ার্ড প্রসেসর। যার নাম আসে ঠিক মার্কিন সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের পরেই। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের পাবলিক সেক্টরে ব্যাপক চাহিদা এই ওয়ার্ড প্রসেসরের। এই ব্যবসা দিয়েই মাত্র ২৬ বছরে মিলিওনিয়ারের ট্যাগ জুটিয়ে ফেলেন অরুণ পুদুর। কোনও গডফাদার, ব্যবসায়িক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই আজ জীবনে সফল তিনি। কঠোর পরিশ্রম ছিল তাঁর বিনিয়োগ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা মূলধন। তাই একজন সাধারণ কমার্স গ্র‍্যাজুয়েট হয়েও পুদুর কর্পের ৮৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক অরুন পুদুর। ২০ টি ইন্ডাস্ট্রি এবং ৭০ টি দেশে অবাধ বিচরণ তাঁর সংস্থার। গত বছর কোম্পানির রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৩.৪ বিলিয়ন ডলার এবং নেট প্রফিটের পরিমাণ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার।

Comments are closed.