পরিবারকে দাস বৃত্তি থেকে মুক্তি দিতে দলিত ছেলের অবিশ্বাস্য লড়াই, আজ ১৮০০ কোটির মালিক অন্ধ্রের মন্নম মধুসূদন রাও

দারিদ্রের সঙ্গে মোকাবিলা করে বড় হওয়ার উদাহরণ হয়ত অনেক আছে। তবে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকাশম জেলার মন্নম মধুসূদন রাওয়ের উত্থান কাহিনি যেমন ব্যতিক্রমী তেমনি চমকপ্রদ। শুধু দারিদ্র আর অর্থকষ্ট নয়। তার সঙ্গে ছিল বংশ পরম্পরা ধরে চলে আসা দাস প্রথায় বন্দি পরিবারকে নিয়ে মুক্তির গল্প।

শূন্য হাতে শুরু করে নিজস্ব কোম্পানি তৈরি, যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৭৫ থেকে ৯০ কোটি টাকা! দারিদ্র, দাসত্ব, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বড় হওয়া এই দলিত বাচ্চা আজ বিখ্যাত এমএমআর গ্রুপের মালিক। যারা প্রায় কুড়িটি লাভজনক সংস্থা চালায়। যে ছেলের পারিবারিক সূত্র ধরে ভবিতব্য ছিল দাস বৃত্তি করে জীবন কাটানো, তাঁর সংস্থায় এখন কয়েক হাজার কর্মী।

বংশ পরম্পরায় শ্রম দাস হয়ে অন্যের সেবা করে আসছিলেন মন্নম মধুসূদনের বাবা, ঠাকুরদা। ঠিকা শ্রমিক হিসেবে স্থানীয় জমিদারের বাড়িতে কাজ করতেন মধুসূদনের বাবা। আর মা কাজ করতেন একটি তামাকের ফ্যাক্টরিতে। মন্নমের বাবা চাননি ছেলেও তাঁর মতো ঠিকা শ্রমিক হয়ে জীবন কাটাক, চেয়েছিলেন বংশ পরম্পরা ধরে চলে আসা পেশার ইতিহাসে এখানেই ইতি পড়ুক। পাশের বাড়ির এক যুবককে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দেখে মন্নমের বাবাও ঠিক করে ফেলেন দুই ছেলেকে শহরে পড়তে পাঠাবেন। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরেই মন্নম ও তাঁর দাদাকে তিনি পাঠিয়ে দেন একটি আবাসিক স্কুলে। ওই স্কুলটির বিশেষত্ব হল, তারা তফশিলি জাতি ও উপজাতির ছেলেমেয়ে যারা পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের শিক্ষার ভার নেয়।

এভাবেই পড়াশোনা শুরু মন্নম মধুসূদন রাওয়ের। বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দাদা ততদিনে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দু’ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর খরচ সামলানো চাপের হবে, তাছাড়া পলিটেকনিক ডিগ্রি থাকলেও ভালো চাকরি পাওয়া যায় এসব চিন্তাভাবনা করে মুন্নমকে পলিটেকনিক কোর্সে ডিপ্লোমা করতে পাঠান বাবা। কিন্তু সেই কোর্স শেষে কোথাও চাকরি পেলেন না মন্নম। পিঠে ডিগ্রির বোঝা চাপিয়ে একের পর এক অফিসে ইন্টারভিউ দিতে যেতেন। আর শুনতেন রেফারেন্স ছাড়া চাকরি হয় না।

কিন্তু এভাবে বসে থাকাও যাচ্ছিল না। অগত্যা বুকে একরকম পাথর চাপা দিয়েই মন্নম মধুসূদনের হায়দরাবাদ যাত্রা। যে শ্রমিক জীবন এড়াবেন বলে বাবা শিক্ষিত করেছিলেন ছেলেকে, সেই পেশাই বেছে নিতে হল মন্নমকে। কষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু জেদ চেপেছিল দ্বিগুণ। বড় হওয়ার জেদ, নিজে কিছু করার আকাঙ্ক্ষা তীব্র ছিল মন্নম মধুসূদনের মধ্যে। শ্রমিকের কাজ করতে করতেই তিনি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেছেন একটু বেশি রোজগারের জন্য। তার মধ্যে মধ্যে চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় বের করে রাখতেন।

এভাবেই একদিন সুযোগ এল। ২৫ হাজার টাকা মাইনের চাকরি পেলেন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে। ব্যাস এইটুকুই তাঁর মনোবল বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। এই কাজের কিছুদিনের মধ্যেই নিজের সংস্থা খুলে ফেলেন মন্নম মধুসূদন রাও। নাম দেন এমএনএম গ্রুপ। কোম্পানিটি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মী নিয়োগ করত। এভাবেই কয়েক বছরে ব্যবসার বিস্তার হয়। ভোডাফোন, টাটা টেলিসার্ভিসের মতো সংস্থায় কর্মী নিয়োগ করতে শুরু করে এমএমআর গ্রুপ। অন্তত পাঁচ রাজ্যে ৩২ হাজার কিলোমিটার অপটিক ফাইবার কেবল সম্পসারণের কাজে যুক্ত মন্নম মধুসূদন রাওয়ের সংস্থা। বর্তমানে এমএমআর গ্রুপ ২০ টি লাভজনক সংস্থা চালায়। টেলিকম থেকে আবাসন, মাইনিং থেকে সফটওয়্যার প্রতিটি সেক্টরে অবাধ যাতায়াত মন্নমের সংস্থার।

চরম দারিদ্র, সামাজিক বাধা কাটিয়ে দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা মন্নম মধুসূদন রাও আজ সফল বিজনেসম্যান। শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করা ৪২ বছর বয়সি মন্নম আজ কয়েকশো কোটি টাকার মালিক। কঠোর পরিশ্রম, সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং বড় হওয়ার ইচ্ছের কাছে যে যে কোনও বাধাই তুচ্ছ তা প্রমাণ করেছেন দলিত ঠিকা শ্রমিকের সন্তান মন্নম মধুসূদন রাও।

Comments are closed.