কিছুদিন আগেই ইউনিসেফ এক সতর্কবার্তায় বলেছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে শিশুরা যদি তাদের জীবন রক্ষাকারী টিকা না পায় তাহলে আরও একটি স্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। এই শিশুদের প্রায় ৯৭ শতাংশেরই বসবাস ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যে লকডাউন কার্যকর হয়েছে তাতে শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তা কাটিয়ে তোলা জরুরি।
নবজাতকদের কী কী জরুরি টিকা রয়েছে আসুন দেখে নেওয়া যাক (Vaccines for Babies)
হেপাটাইটিস–বি প্রতিষেধক
নবজাতকের জন্য হেপাটাইটিস-বি প্রতিষেধক এবং বিসিজি প্রতিষেধক অত্যন্ত জরুরি। এক মাসের কম বয়সী শিশুদের সরাসরি টিকা দেওয়া যায়। লকডাউনে দেরি হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেওয়া উচিত।
বিসিজি টিকা শিশুর জন্মের পরপরই দিতে হয়। একবারই দেওয়া হয় অর্থাৎ এর ডোজ একটিই। বাঁ হাতের কাঁধের কাছের হাতের অংশের ত্বকে এটি দেওয়া হয়। এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন- ক্ষত হওয়া, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
দেড়, আড়াই আর সাড়ে তিন মাসের Pentavalent প্রতিষেধকগুলিও নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। হেপাটাইটিস বি ও হিব টিকা ৬, ১০ ও ১৪ সপ্তাহের মধ্যে (immunization schedule) এই তিনটি ডোজ দিতে হয়। হেপাটাইটিস টিকা পরে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আর হিব টিকা নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিস প্রতিরোধ করে।
হেপাটাইটিস-বি হয় মূলত ব্লাড ট্রান্সফিউশন এবং একাধিক বার ব্যবহৃত ইঞ্জেকশনের সুচ ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ছাড়াও ট্যাটু আঁকার সময়েও সতর্কতার অভাবে এই ভাইরাস দেহে ঢুকতে পারে। সংক্রামিত মায়ের দেহ থেকে শিশুর মধ্যে হতে পারে সংক্রমণ।
যকৃতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, রক্তে লোহিত কণিকার আয়ু শেষ হলে, তার অন্তর্গত বিলিরুবিনকে দেহ থেকে নিষ্কাশিত করা। হেপাটাইটিস ভাইরাসের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে দেহ হলদেটে হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল হেপাটাইটিস বি এবং সি। কারণ এই দু’ধরনের ভাইরাস থেকে সমস্যা হলে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আবার এই দু’টি ভাইরাস থেকে ক্রনিক হেপাটাইটিসও হতে পারে। ক্রনিক হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
পোলিও টিকা
পোলিও টিকা মুখে খাওয়ানো হয়। এর সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলও খেতে দেওয়া হয় শিশুকে। এই টিকার মোট চারটি ডোজ। ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহ এবং নবম মাসে পোলিও টিকা দেওয়া হয়।
নতুন টিকা শিশুর পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে দু’বার দিলেই চলে৷ এখন চালু ওরাল টিকা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত খাওয়াতে হয়৷
পোলিয়ো-মুক্ত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে পালস পোলিও কর্মসূচি শুরু করে ভারত৷ কিন্তু পোলিয়ো-মুক্ত দেশের তকমা এখনও অধরাই৷ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ কিংবা মহারাষ্ট্রের মত কয়েকটি রাজ্যের ছোটখাটো ব্যর্থতার জন্যই ওই তকমা পাওয়া যায়নি৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই পরিস্থিতিতে দু’ধরনের টিকা (ওরাল ড্রপ এবং ইঞ্জেকশন) একসঙ্গে ব্যবহার করলে সমস্ত রকমের পোলিয়ো ভাইরাসই নির্মূল করা সম্ভব৷
এমএমআর টিকা (মাম্পস, মিজলস, রুবেলা)
ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় এই টিকা। নয় মাসের MMR টিকা আর প্রতি বছরের ফ্লু-এর টিকাও ফেলে রাখা উচিত নয় বলে মত চিকিৎসকদের। ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে তা দিতেই হবে। এর মধ্যে মিজলস বা হামের টিকা দিতে হবে নবম মাসে। ৪ থেকে ৬ বছরে একটি বুস্টার ডোজ দিতে হবে। এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। অ্যালার্জি, চামড়ায় র্যাশ হওয়া, টিকা স্থানে ব্যথা ও লাল হওয়া এবং ফুলে যাওয়া।
ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ও পারটুসিস
এর মোট তিনটি ডোজ- শিশুর জন্মের ৬, ১০ ও ১৪তম সপ্তাহে। পারটুসিস (হুপিং কাশি) টিকা দেওয়ার সময় অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। যাদের এ প্রবণতা বেশি বা শরীর দুর্বল তাদের শুধু ডিপথেরিয়া ও টিটেনাসের টিকা দেওয়া হয়। টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কারের টিকাটি শিশুদের জন্য খুবই জরুরি।
ডায়েরিয়া
বাচ্চাদের ডায়েরিয়ার প্রধান কারণ রোটা ভাইরাস। তাই রোটা ভাইরাসের প্রতিষেধক দিতে হবে। প্রতিবছর অনেক শিশু এ ভাইরাসের ইনফেকশনে মারা যায়। ডায়েরিয়া প্রতিষেধকের টিকার তিনটি ডোজ। প্রথম ডোজ ৬ থেকে ১২ সপ্তাহে এবং পরবর্তী ডোজগুলো ৪ থেকে ১০ সপ্তাহ পর পর ও শেষ ডোজ অবশ্যই ৩২ সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে। এ তিনটি টিকাই মুখে খাওয়ার।
নিউমোনিয়া
শিশুদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ টিকা নিউমোনিয়া। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিউমোনিয়া বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ট্র্যাক ইনফেকশনকে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী ভাইরাস হল নিউমোকক্কাস (স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি) ও হেমোফাইলাস ইনয়ুযেকি। এই দুই ভাইরাসকে ধরাশায়ী করতে টিকার বিকল্প নেই। এজন্য সিজনাল অ্যান্টি ভাইরাল ভ্যাকসিন বা নিউমোকক্কাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন যে কোনওটি দিলেই হয়। নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণ রোধে অনূর্ধ্ব ৫ শিশুদের টিকা দিতে হয়। নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে ফুসফুসের সংক্রমণের তীব্রতা কম হয় এবং ঝুঁকি কম থাকে।
Other Vaccines for Babies
এছাড়া কোনও ‘রেবিড এনিম্যাল’ যেমন, কুকুর বা বিড়ালের দংশনে Rabies ভ্যাকসিন কিন্তু খুবই জরুরি। এই ভ্যাকসিন ফেলে রাখলে বিপদ থাকে, অভিমত চিকিৎসকদের।
এবার জেনে নেওয়া যাক, সঠিক সময় টিকা দেওয়া কেন জরুরি? (Why to maintain children immunization schedule)
রোগ থেকে মুক্তি
বেশ কিছু রোগ জীবাণুর পক্ষে শিশুদের আক্রমণ করাটা সুবিধাজনক। কারণ শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়ার প্রধান লক্ষ্য হল এই রোগগুলোকে শিশুর থেকে দূরে রাখা। টিকাকরণের (vaccination) মাধ্যমে শিশুর শরীর ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা অর্জন করে।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
শিশুর ছোট্ট শরীর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় নেয়। তাই তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার। চিকিৎসকদের মত, টিকা বা ভ্যাকসিন এই কাজই করে। জন্মের পর শিশুর শরীরে প্রথম কয়েক বছর অনেক অ্যান্টিবডিই তৈরি হয় না। এতে বেশ কিছু রোগের ভাইরাস সহজেই আক্রমণের সুযোগ পায়। টিকা শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে।
পরিবার ও সমাজের সুরক্ষা
বেশ কিছু রোগের ভাইরাস সহজেই একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে সংক্রমিত হয়। অথচ এমন সব রোগের মধ্যে কয়েকটি টিকাকরণের মাধ্যমে সহজেই এড়িয়ে চলা যায়। তাই শিশুর টিকাকরণ সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন বা টিকার কোনও কোর্স বাদ দেওয়া বা দিতে দেরি করা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এতে শিশুকে নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।
করোনার প্রেক্ষিতে বন্ধ টিকাকরণ
আশঙ্কা বাড়ছে হাম, যক্ষ্মা, পোলিও-র মতো রোগের। লকডাউনের ফলে শিশুদের টিকাকরণ বন্ধ থাকায় আগামী দিনে ওই সমস্ত রোগে কয়েক লক্ষ শিশু আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসকদের পরামর্শ, লকডাউন চললেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবিলম্বে শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ের টিকাকরণ চালু করতে হবে।
তবে করোনার সংক্রমণ থেকে শিশুদের দূরে রাখতে টিকাকরণের সময়ে সামাজিক দূরত্ব-বিধি মানা ও মাস্ক পরা ইত্যাদি সাবধানতা অবলম্বন করা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কোনও শিশু জন্মানোর পরে হাসপাতালেই তাকে টিকা দেওয়া হয়। এর পরে প্রাথমিক পর্যায়ে দেড় মাস, আড়াই মাস ও সাড়ে তিন মাস বয়সে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি, পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস বি-র মতো বিভিন্ন প্রতিষেধক দেওয়া হয়। আবার ছ’মাস বয়সে ফ্লু এবং ন’মাস বয়সে হাম, রুবেলা, মাম্সের প্রতিষেধক দেওয়া হয়। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে রুটিন মাফিক ওই প্রতিষেধক পেতে পারে শিশুরা।
তাই vaccination for babies প্রক্রিয়ায় যাতে কোনও ছেদ না পড়ে, তার জন্য টিকাকরণের সময়ে চিকিৎসকদের বলা কিছু নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে মা-বাবাদের। শিশু-রোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, যে সব শিশু প্রতিষেধক নিতে আসবে, তাঁদের এক জনের সঙ্গে অপর জনের সময়ের একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান রাখা উচিত। যাতে একে অপরের সংস্পর্শে আসতে না পারে। টিকাকরণের দিন চিকিৎসকদের চেম্বারে অন্য রোগে আক্রান্ত শিশুদের ডাকা উচিত নয়।
Comments are closed.