রাজ্যে কিছু এলাকায় গোষ্ঠী সংক্রমণ: কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কী, কীভাবে হয়? গোষ্ঠী সংক্রমণের পরের ধাপ কী?
কোভিড পর্বে সাধারণ মানুষের ভোকাব্যুলারিতে স্থান পেয়েছে একগুচ্ছ নতুন শব্দ। তার মধ্যে তর্কাতিতভাবে ধারে-ভারে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শব্দবন্ধটি হল কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণ। করোনা বিধ্বস্থ প্রতিটি দেশে এই শব্দবন্ধের প্রভাব মারাত্মক।
সোমবার নবান্নে স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, রাজ্যে কোথাও কোথাও গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ভারতে এর আগেও একাধিকবার গোষ্ঠী সংক্রমণের দাবি করা হয়েছে, বারবারই তা খারিজ করেছে আইসিএমআর। এখন প্রশ্ন হল কী এই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, যাকে নিয়ে এত তোলপাড়?
১৮ মার্চ, ২০২০। দিল্লি থেকে ট্রেনে চেন্নাই পৌঁছলেন এক ব্যক্তি। চেন্নাইতে নেমে অসুস্থ বোধ করায় ডাক্তার তাঁকে করোনা পরীক্ষা করতে বলেন। পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। দেশের তাবড় বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের করোনা পর্বে গোষ্ঠী সংক্রমণের আরম্ভ সেদিনই। কিন্তু কেন এমন দাবি করলেন বিশেষজ্ঞরা?
দেখা গিয়েছে, ট্রেনে দিল্লি থেকে চেন্নাই পৌঁছনো ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণের কোনও সাম্প্রতিক ইতিহাস নেই। এমন কারও সংস্পর্শেও আসেননি, যিনি সম্প্রতি করোনা প্রভাবিত দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি কোথা থেকে সংক্রমিত হলেন, তা অজানা। এই অবস্থাকেই সাধারণত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায় বলে ধরা হয়। যেখানে সংক্রমণের উৎস ধরা যায় না।
তারপর কেটে গিয়েছে ৪ মাসেরও বেশি সময়। বিশেষজ্ঞরা গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হওয়ার দাবি করলেও তা মানতে চায়নি আইসিএমআর। এর মধ্যেই মুম্বইয়ের ধারাভি কিংবা দিল্লির কিছু এলাকায় গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে রাজ্য প্রশাসন দাবি করলেও, কেন্দ্র তা মানতে চায়নি। মুম্বই-দিল্লির মতোই কিছুদিন আগে কেরল সরকারও জানায়, কিছু কিছু এলাকায় গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আইএমএর হাসপাতাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ভিকে মোঙ্গাও দাবি করেছিলেন, দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গিয়েছে। সোমবার বিকেলে নবান্ন থেকে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন ব্যানার্জিও জানালেন এ রাজ্যের কোথাও কোথাও গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। তাই সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে আগের মতো সম্পূর্ণ লকডাউন-বিধি কার্যকর করবে রাজ্য সরকার।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, বিভিন্ন রাজ্য বারবার গোষ্ঠী সংক্রমণের দাবি করলেও আইসিএমআর সেই দাবি মানছে না কেন? আইসিএমআর থেকে সদ্য অবসর নেওয়া বিজ্ঞানী অধ্যাপক রমণ গঙ্গাখেদকড় তার যুক্তি দিয়েছেন সাংবাদিক করণ থাপারকে। তাঁর প্রশ্ন, বিশাল দেশ ভারতের কোনও একটি এলাকায় সংক্রমণের উৎস খুঁজে না পাওয়া গেলে কি তাকে দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলা যায়? দেশের সর্বত্রই কি একই পরিস্থিতি? কোথাওই কি সংক্রমণের উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? কনট্যাক্ট ট্রেসিং করা যাচ্ছে না? বাস্তব তো তা বলছে না। তাই একে লোকাল ট্রান্সমিশন বা স্থানীয় সংক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ডক্টর গঙ্গাখেদকড় জানিয়েছেন, শুরুতে স্ট্রেজ থ্রি বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, ভারতের মতো বিশাল এবং বিপুল বৈষম্যের দেশে তা কার্যকরী নয়। তাই গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায়কে স্থানীয় এবং গোষ্ঠী সংক্রমণ, এই দুই ভাগে দেখা প্রয়োজন। ভারতের বিজ্ঞানীরা তাই করেছেন। তাঁর মতে, ইউরোপ বা আমেরিকার মতো দেশে অতিমারি পরিস্থিতিতে গোষ্ঠী সংক্রমণের সংজ্ঞার সঙ্গে কোনওভাবেই মিলতে পারে না ভারতের পরিস্থিতি। কারণ এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক।
এবার প্রশ্ন হল, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণের কারণ কী? বাংলায় স্বরাষ্ট্র সচিবের সাংবাদিক বৈঠকের পরই বিজেপির দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহা থেকে শুরু করে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী কিংবা সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, প্রত্যেকেই গোষ্ঠী সংক্রমণের নেপথ্যে মমতা সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এ কি স্রেফ রাজনৈতিক গিমিক? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অতিমারির চরিত্রই এটা। যে মুহূর্তে ভারতে এই ভাইরাস ঢুকেছে এবং একজন মানুষকে সংক্রমিত করেছে, সেদিন থেকেই এই পর্যায়ে পৌঁছনো কার্যত অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ যে কোনও অতিমারির এটাই নিয়ম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও একটি এলাকা থেকে প্রচুর সংক্রমণের খবর আসার অর্থই হল সেখানে স্থানীয়স্তরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সেখানে কনট্যাক্ট ট্রেসিং বাস্তবিকই অসম্ভব। তা না হলে এক জায়গায় এত মানুষ সংক্রমিত হতেন না। সেক্ষেত্রে মূল সমস্যার জায়গা হল, সারা দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব।
এবার প্রশ্ন হল, যদি অতিমারির অন্যতম চরিত্র হয় গোষ্ঠী সংক্রমণ, তাহলে এর শেষ কোথায়? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, করোনা সংক্রমণ একবার গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্বে পৌঁছে যাওয়ার অর্থ হল সেই সংক্রমণ দিনে দিনে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই আপাত নিরীহ হওয়ার পথে দৌড়চ্ছে। যেখানে আর পাঁচটা সাধারণ ভাইরাস ঘটিত রোগে পরিণত হবে মারণ ভাইরাস করোনা।
Comments are closed.