৫৬ দিনেই দিল্লিতে বাজিমাত! বিজেপি বিরোধী শক্তির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর প্রশান্ত কিশোরের লক্ষ্য এবার বাংলা
১৯৭৭, কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করে বাংলায় ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হলেন জ্যোতি বসু। হয়ত নেহাতই কাকতালীয়, সেই বছরই বাংলার পাশের রাজ্য বিহারে জন্ম প্রশান্ত কিশোরের, যিনি আজ নিঃসংশয়ে গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলের পয়লা নম্বর ব্যান্ড অ্যাম্বাসাডর!
দিল্লি বিধানসভা ভোটের মাত্র ৫৬ দিন আগে নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর হাত মেলালেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে। হ্যাঁ ৫৬ দিন। আর তাতেই ম্যাজিক! পাঁচ বছর সরকার চালানোর পর প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটের আশঙ্কা, অমিত শাহের ৩৯ টি জনসভা এবং ১১ র্যালি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে আদিত্যনাথের আক্রমণাত্মক প্রচার, শাহিন বাগ নিয়ে তীব্র মেরুকরণের রাজনীতি-সব কিছুকে হেলায় উড়িয়ে দিল্লি দখল কেজরিওয়ালের। নেপথ্যে প্রশান্ত কিশোর।
কে এই প্রশান্ত কিশোর? উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯৭৭ সালে বিহারের রোহতস জেলার কোনার গ্রামে জন্ম প্রশান্ত কিশোরের। কিন্তু জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে পেশায় চিকিৎসক বাবা শ্রীকান্ত পাণ্ডের বদলি হয়ে যায় বক্সার জেলায়। বক্সারেই পড়াশোনা শুরু প্রশান্ত কিশোরের। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে তাঁর মতোই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়র হোক। কিন্তু ছেলের মাথায় ছিল অন্য ভাবনা।
পড়াশোনা শেষ করে প্রশান্ত চাকরি শুরু করেন রাষ্ট্রপুঞ্জে। টানা ৮ বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের চাকরি করেন। সেই সময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে থেকেছেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরেন প্রশান্ত। আচমকা মাথায় আসে ভোট প্রচারের বিষয়টি। আর যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিহারে জেডিইউয়ের হয়ে ছোটখাটো কাজ করতে করতেই বরাত মেলে বিজেপির প্রচার সামলানোর। ২০১৪ সালে সেই প্রশান্ত কিশোরই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জিতিয়ে জাতীয় মঞ্চে নিজের আবির্ভাব ঘোষণা করেন। বাকিটা ইতিহাস।
আরও জানতে ক্লিক করুন, ডিসেম্বরে আপের প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে কী বলেছিলেন প্রশান্ত কিশোর?
তবে এবার রাজধানী দিল্লিতে খড়গপুরের প্রাক্তনী কেজরিওয়ালের হ্যাটট্রিক অতটা সহজ ছিল না। ২০১৯ লোকসভা ভোটে বিজেপি দিল্লির ৭ টির ৭ টি আসনই দখল করে।
মহল্লা ক্লিনিক থেকে শুরু করে সরকারি বিদ্যালয়, ফ্রি বিদ্যুৎ, রাস্তা, মহিলাদের ফ্রি বাস ভ্রমণের কাঁধে ভর করে আপ আত্মবিশ্বাসী ছিল, কাজের নিরিখে ভোট হলে তাদের জয় অনিবার্য। কিন্তু বিজেপি এত সহজে খেলা ছাড়ার বান্দা নয়। সম্ভবত এমনটা আঁচ করেই কেজরিওয়াল কাছে টানেন ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে। পিকের সংস্থা আই প্যাক কাজ শুরু করে আপের হয়ে। আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে রাজধানীর পটচিত্র। ব্যাকফুটে যাওয়া শুরু বিজেপির।
প্রশান্ত কিশোরের সুচিন্তিত প্রচার পরিকল্পনায় বিজেপিকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার দিকে এগোতে থাকে আম আদমি পার্টি। কিন্তু শেষ বেলায় তেড়েফুড়ে ওঠে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলের সুপার প্রেসিডেন্ট অমিত শাহের নেতৃত্বে মাঠে নামে গেরুয়া ব্রিগেড। দিল্লির ভোটে ঘুরেফিরে আসতে শুরু করে পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলিম, বালাকোট। এতদিন বিজলি, সড়ক, পানির জোরে ভোটে লড়তে যাওয়া আম আদমিরাও খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বরাভয় দেন প্রশান্ত কিশোর। বলেন, দিনের শেষে ভোটবাক্সে আলো জ্বালাবে বিজলি, সড়ক, পানিই। মঙ্গলবারের ফলাফল কিন্তু সেই কথাই বলছে। নিজের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হচ্ছে দেখেই এদিন সক্কাল সক্কাল দিল্লিবাসীকে ট্যুইট করে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রশান্ত কিশোর।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীকে জাতীয় মঞ্চে পৌঁছে দেওয়া থেকে কখনও কংগ্রেসের হাত ধরে পঞ্জাব, আবার কখনও জগন রেড্ডির হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, প্রশান্ত কিশোরের মিডাস টাচে একে একে বিভিন্ন রাজ্যে সুফল মিলেছে।
অন্ধ্রের ভোটের ফল বেরোতেই পিকের ডাক পড়ে বাংলায়। লোকসভায় ১৮ আসন জিতে বিজেপি তখন বাংলা দখলের স্বপ্নে মশগুল। সেই সময় পিকে হাল ধরেন মমতা ব্যানার্জির দলের প্রচার অভিযানের। রাজ্যজুড়ে চালু হয় দিদিকে বলো, আমার গর্ব মমতা। রাজ্যে কদিন আগে হওয়া ৩ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপিকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের একটি অংশের মত, এই জয়েও রয়েছে প্রশান্ত কিশোরীয় ছাপ।
বাংলায় যখন প্রশান্ত ব্যস্ত বিজেপিকে বধ করার কৌশল ছকতে, ঠিক তখনই ডাক পড়ে দিল্লি থেকে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রচারের ভার নেন পিকে। তারপর এদিনের ফল।
এবার সামনে বিহার ভোট। কিছুদিন আগেই সিএএ নিয়ে মতবিরোধের জেরে জেডিইউ থেকে প্রশান্ত কিশোরকে তাড়িয়েছেন নীতিশ কুমার। এবছরের শেষে বিহার নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা, এরই মধ্যে তামিলনাডুতে স্ট্যালিনের সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন প্রশান্ত কিশোর। দিল্লি জয়ের পর এবার পিকের লক্ষ্য বাংলা, তামিলনাডু। এবং অবশ্যই নীতিশের বিহার!
Comments are closed.