সুরজিতের মতোই কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যালঘু হয়েও ফের সাধারণ সম্পাদক হলেন ইয়েচুরি। পারবেন স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে, প্রশ্ন দলেই
পার্টি কংগ্রেসের প্রথম দিন দলের সংখ্যালঘু মত পেশ করেও শেষ দিনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের পদাঙ্কই অনুসরণ করলেন তাঁর ভাবশিষ্য সীতারাম ইয়েচুরি। হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে ব্যাকফুটে শুরু করেও যেভাবে ইয়েচুরি নিজের চেয়ার বাঁচালেন, অনেকটা একইভাবে ১৯৯৮ পার্টি কংগ্রেসে দলের সংখ্যালঘু মত পেশ করেও সাধারণ সম্পাদক থেকে গিয়েছিলেন সুরজিত। আর আশ্চর্যজন হলেও সত্যি, সেইবার সুরজিতের মতের বিরোধিতা করেছিলেন এই সীতারামই। তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রকাশ কারাট, যাঁর সঙ্গে এবার লড়তে হল তাঁকে।
১৯৯৬ সালে নরসিংহ রাও সরকার পতনের পর প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ আসে জ্যোতি বসুর সামনে। একাধিক আঞ্চলিক দল জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার দাবি তোলে। কিন্তু জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হবেন কিনা তা নিয়ে সিপিএমের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। শেষমেশ কেন্দ্রীয় কমিটির ভোটাভুটিতে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি, যে ঘটনাকে পরে তিনি বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুল। ১৯৯৬ সালের সেই ঘটনার পরও এই ইস্যুতে দলের মধ্যে তীব্র বিতর্ক জারি থাকে এবং তা সঙ্গী করেই ১৯৯৮ সালে কলকাতার নজরুল মঞ্চে শুরু হয় সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। দলের সাধারণ সম্পাদক তখন হরকিষেণ সিংহ সুরজিত। কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে সুরজিত প্রস্তাব দেন, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়া উচিত ছিল। তা না করে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই দুর্বল হয়েছে। সুরজিতের পক্ষে ছিলেন জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সুভাষ চক্রবর্তীরা। আর এক প্রবীন পলিটব্যুরো সদস্য এবং কেরলের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদও এই মতেরই পক্ষে ছিলেন, যদিও অসুস্থতার কারণে তিনি কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে আসতে পারেননি। অন্যদিকে, সেই সময় কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত ছিল, কংগ্রেসের মতো বুর্জোয়া দলের সমর্থনে সরকার গঠন করলে সেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ শক্তি কিছুতেই সিপিএমের হাতে থাকত না। কংগ্রেসের নীতিই রূপায়ন করত সেই সরকার, যার দায়ভার নিতে হোতও সিপিএমকে। এই মতের পক্ষে ছিলেন প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, সূর্যকান্ত মিশ্ররা।
কলকাতা পার্টি কংগ্রেসের প্রথম দিনে এবারের মতোই কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব পেশ করেন প্রকাশ কারাট। ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গঠন না করে দল যে ঠিকই করেছে তার পক্ষেই প্রস্তাব রাখেন তিনি। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে ভুল এবং সাম্প্রদায়িকতাকে সুযোগ করে দেওয়া বলে পালটা ভাষণ দেন সুরজিত। কেন্দ্রে সরকার গঠন করা কিংবা না করা ইস্যুতে সিপিএম নেতাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয় নজরুল মঞ্চে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দলিলের ওপর আলোচনায় ভোটাভুটি হয় এবং সাধারণ সম্পাদক সুরজিত হেরে যান। সুরজিতের প্রস্তাব পার্টি কংগ্রেসে হেরে গেলেও, শেষদিনে কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে বিনা ভোটাভুটিতে তিনি ফের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবার হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসেও প্রথম দিন কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ করেন দলের সুপার সেক্রেটারি কারাট। পাশাপাশি সংখ্যালঘু অংশের মত পেশ করেন ইয়েচুরি। এবং কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও নির্বাচনী জোট কিংবা সমঝোতা নয়, এই মতই এখনও সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই বিতর্কে হার হলেও, হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসের শেষদিন রবিবার ফের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সীতারাম ইয়েচুরি। বিনা ভোটাভুটিতেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন তিনি।
১৯৯৮ সালে হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের মতোই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধিত্ব করা সীতারাম ২০১৮ সালে ফের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেও, কুড়ি বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই আলাদা। বরং বলা যায়, দুই পরিস্থিতির মধ্যে একটা মৌলিক তফাত আছে। সুরজিত যে বিতর্ক ১৯৯৮ সালের পার্টি কংগ্রেসে তুলেছিলেন, তা ছিল অতীতের ঘটনা। অর্থাৎ, কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে ১৯৯৬ সালের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়ার যে ঐতিহাসিক সুযোগ ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সামনে এসেছিল, তার পুনরাবৃত্তি আর কখনও হবে বলেও কেউ মনে করেন না। তাই ১৯৯৮ সালের তাত্ত্বিক বিতর্কটাকে অনেকটাই ময়নাতদন্ত বলা যায়। যে কারণে সেই বিতর্কে হেরে গেলেও, সুরজিতের পরবর্তীকালে দল চালাতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এবার হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে সীতারাম ইয়েচুরির পরিস্থিতি একেবারেই তা নয়। কারণ, এবারের বিতর্কটা ছিল, আগামী ২০১৯ লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে। ফলে ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন না থাকলেও, সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরির প্রশ্রয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট যেভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছিল, ফের তা ২০১৯ সালে করতে গেলে পার্টিতে চূড়ান্ত বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। যা দলকে আড়াআড়ি ভেঙে দিতে পারে বলেও অনেক নেতাই মনে করেন। তাই ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘু মতের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কীভাবে দলকে নেতৃত্ব দেন, সেটাই এখন সিপিএমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।