অগ্নিপরীক্ষা

‘একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নেই। একজনকে বাধা দিতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধ্যার পর কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র শুধু গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে।’

(অসমাপ্ত আত্মজীবনী। শেখ মুজিবুর রহমান।)

এই ঘটনা কলকাতা শহরের। ১৯৪৬ সালের ১৭, ১৮ অগাস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন কলকাতায়। কয়েক দিন আগে ২৯ জুলাই মুম্বইয়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা ডাকলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ। সেই সভায় ১৬ অগাস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করলেন তিনি। সমাবেশ হবে কলকাতায়, গড়ের মাঠে। সেদিন সকাল থেকেই গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল ওয়েলিংটন স্কোয়ার, কলেজ স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি রোডসহ পুরো মধ্য কলকাতায়। মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল শহরের বিভিন্ন এলাকায়। খুন-পাল্টা খুন। শয়ে-শয়ে মানুষ ঘরছাড়া হলেন। বেশিরভাগই গরিব মানুষ। স্কুল, কলেজ হয়ে উঠল শরণার্থী শিবির। দাঙ্গার সঙ্গে শুরু হল লুঠপাট, ধর্ষণ। কলকাতা সাক্ষী হল এক ভয়াবহ নৃশংসতার। কলকাতায় থামতে না থামতেই দাঙ্গা শুরু হল নোয়াখালীতে। তার প্রতিক্রিয়ায়
আবার বিহারে। বিহার থেকে হাজার-হাজার মানুষ এসে আশ্রয় নিলেন আসানসোলে।

স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগের এই ভয়াবহ দাঙ্গা বিধ্বস্ত পরিবেশ, পরিস্থিতি কি আজ আমরা আবার ফিরিয়ে আনব বাংলায়? স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মে-ধর্মে যুদ্ধ লাগিয়ে যারা ক্ষমতা দখল করতে চাইছে, তাদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে কি একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমরা ফের ফিরব সেই অন্ধকার দিনে? নাকি দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠা একটা ধর্মপ্রাণ সমাজে দাঙ্গা-নিরপেক্ষ জীবন কাটবো? কঠিন পরীক্ষা আজ বাংলার মানুষের সামনে।

২০০৮ সালে এল বিশ্বজোড়া মন্দা। আর তার এক অনিবার্য পরিণতি, দূনিয়াজুড়েই অতি দক্ষিণপন্থী দলের শক্তিবৃদ্ধি। ধর্ম এবং জাতিসত্ত্বাকে মূলধন করে যে শক্তি তীব্র আঘাত হানল কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক থেকে গ্রেট ব্রিটেনে। ফ্রান্স থেকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি হয়ে একেবারে আল্পসের ধারের সুইতজারল্যান্ডে। গ্রেট ব্রিটেনে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে ব্রেক্সিট থেকে ফ্রান্সে মেরি লা প্যঁ। মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে আরএসএস। ‘আমেরিকা ফর আমেরিকানস’ স্লোগান তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টপতি বনে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প। সবকটা মুখই আসলে এক সুতোয় বাধা। বিশ্বজুড়ে যার ভিত্তি শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগ এবং তীব্র জাতিসত্ত্বা তৈরি করে মানুষে মানুষে একটা ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করা। জীবন এবং সম্পদের বিনিময়ে যার মূল্য চোকাতে হয় শুধুমাত্র গরিব, প্রান্তিক মানুষকেই।

দেশের সামনে আজ এক কঠিন পরীক্ষা। আরও কঠিন পরীক্ষা বাংলার মানুষের। ২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে যে ল্যাবরেটরিতে উত্তরপ্রদেশে মুজফফরনগরের সফল পরীক্ষা হয়, তা বাংলার মাটিতে আমদানির অপচেষ্টা রোখার দায়িত্ব রাজ্যের মানুষেরই।

Leave A Reply

Your email address will not be published.