বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ। এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে একরকম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। কোনও অসুখ-বিসুখ হলে এখন চটজলদি কেউ হাসপাতালমুখো হতে চান না। আবার চাইলেও এই লকডাউন বা আনলক পরিস্থিতিতে চটজলদি গাড়ি পাওয়াও মুশকিল। কিন্তু রোগ তো থেমে থাকে না। করোনার মধ্যেও এমন কিছু অসুখ হয়, যাতে চটজলদি চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি হয়ে পড়ে। তেমনই একটা হঠাৎ বিপদের নাম sudden heart attack.
আধুনিক জীবনযাত্রা, পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে হৃদরোগের ভয়। বাইরের খাবার, বেশি তেল-মশলা যুক্ত খাবার, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান ইত্যাদি বদভ্যাসের বেশিরভাগের সঙ্গে যতই জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। ততই শরীরে জমছে মেদ। সেই সঙ্গে বাড়ছে cardiac attack -এর আশঙ্কাও।
অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক হলেও তা ঠিকভাবে বোঝা যায় না। তার আগেই শারীরিক ক্ষতি হয়ে যায়। কোনও কোনও সময় বুকে কোনও রকমের যন্ত্রণা ছাড়াও হানা দিতে পারে হার্ট অ্যাটাক। তবে চিকিৎসকদের মতে, কিছু উপসর্গ আন্দাজ করে যদি আগে থেকেই সচেতন হওয়া যায়, সেক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক রুখে দেওয়া সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ (Sudden Cardiac Arrest Symptoms)
চিকিৎসকেরা বলেন, cardiac arrest -এর প্রাথমিক কিছু উপসর্গ দেখে যদি সাবধানতা অবলম্বন করা যায় সেক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কিন্তু হৃদকম্পের লক্ষণ চেনার পরেও তা এড়িয়ে গেলে ফল হতে পারে মারাত্মক। ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা বলছে, হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ খেয়াল না করলে কেবল মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকলেও অনেক জটিলতা নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হয়। তাই এই সব উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হোন।
১) বুকে ব্যথা
হঠাৎ বুকে চাপ চাপ ব্যথা, বুকের এক পাশে কিংবা পুরো বুক জুড়ে ভারী ব্যথা শুরু হলে সতর্ক হোন। হার্ট অ্যাটাকের আগে বুকে ব্যথার চেয়েও বেশি চাপ অনুভব করেন অনেকে। খেয়াল রাখুন, বুক, ঘাড়, চোয়াল, বা তলপেটে কোনও চাপ আসছে কি না। শুধু বুক নয়, বাম হাত, ঘাড় এমনকি, ডান হাতেও একটানা ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২) শরীরের অন্য অংশে ব্যথা, যেমন, মনে হতে পারে ব্যথা শরীরে এক অংশ থেকে অন্য অংশে চলে যাচ্ছে। বুক থেকে হাতে ব্যথা হতে পারে, এমন কিছু হলে সতর্ক হোন। হৃদকম্পের লক্ষণে সাধারণত বাম হাতে ব্যথা হয়। আবার দুই হাতেই ব্যথা হতে পারে।
৩) মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করলে সতর্ক হওয়া উচিত। চাপের সঙ্গে ঘাম হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও সচেতন হোন। এই সময় রক্ত সঞ্চালনে হৃদপিণ্ডকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে বেশি ঘাম হয় এবং এই ঘাম সাধারণত অনেক ঠান্ডা। চাপ ও ঘাম একসঙ্গে হলেই ঘাড়ে-মাথায় জল দিন। দ্রুত কোনও হাসপাতালে যান। সেই সঙ্গে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো অনুভূতি দেখা যায়।
৪) বুকের বাঁ-দিক, ঘাড়-পিঠে ব্যথাই শুধুমাত্র হার্ট অ্যাটাকের সংকেত নয়। নাভি থেকে গলা পর্যন্ত যে কোনও জায়গাতেই ব্যথা হতে পারে (যা বেশিরভাগ রোগী গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করেন)।
৫) বমি ভাব হওয়া, বিনা কারণে অস্থির লাগা, বুক ধড়ফড় করা, সর্দি বা কাশিও হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ। আবার বেশিরভাগ সময় বুকে ব্যথা খুবই তীব্র হয়, ফলে শরীরের অন্য অংশে ব্যথা অনেকে টের পান না। কারও ক্ষেত্রে হয়ত বুকে ব্যথা অনুভূত নাও হতে পারে, বিশেষ করে মহিলা, বয়স্ক মানুষ এবং যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বুকে ব্যথা বা অজ্ঞান হয়ে যাবার মত ঘটনা সাধারণ হার্ট অ্যাটাকের এক মাস আগে হয়।
অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের আগে তলপেটে চাপ অনুভব করেন। অনেকে একে গ্যাসের সমস্যা বলে উড়িয়ে দেন। এই ভুল একেবারে করবেন না। ঘন ঘন এমন হলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। ইসিজি করান। অনেক সময় দাঁতেও ব্যথা হতে পারে।
কেন হয় হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক? (Causes of Heart Attack)
আমাদের হৃদপিণ্ডে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তা হৃদযন্ত্রে আসে ধমনী বেয়ে। সেটি যখন সরু হয়ে যায়, তখন নালীর ভেতরে রক্ত জমাট বেধে যেতে পারে। ফলত নালীর ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়। আর অক্সিজেন প্রবাহিত করতে পারে না।
হৃদপিণ্ডের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন প্রবাহিত না হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়।
অ্যাটাকের সময় কী করবেন?
হার্ট অ্যাটাক হলে তিন ঘণ্টা অর্থাৎ গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এই সময় অনিয়মিত হারে হার্টবিট পড়ে। একে ভেন্ট্রিকিউলার ট্যাকিকার্ডিয়া বলে। এছাড়া ধমনীর মাধ্যমে রক্ত হার্টে পৌঁছতে পারে না। তাই যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। একইসঙ্গে হার্ট কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কাদের ঝুঁকি
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, হাই ব্লাড সুগার, ধূমপানের অভ্যাস, কোলেস্টেরল বেশি থাকলে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেশি। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা না করালে ফল মারাত্মক হতে পারে। ব্লাড প্রেশারের মতোই নিঃশব্দ ঘাতক হল ব্লাড সুগার। হার্টের অসুখের পাশাপাশি ডায়াবেটিসের জিনও ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছে। আবার অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগারের জন্য ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যাঁদের পরিবারে হৃদরোগে মৃত্যুর ইতিহাস আছে তাঁদের ক্ষেত্রে আশঙ্কা বেশি। বিশেষ করে মা-বাবা, ভাই-বোন, কাকা-জেঠুদের কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হলে পরবর্তী প্রজন্মকে সাবধান থাকতে হয়। বয়স বাড়লে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসাবে পারিবারিক ইতিহাস আর বয়সকে ধরেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এই দু’টি কারণকে প্রতিহত করার জন্য সাবধান হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কেউ সুগার, প্রেশার নিয়মিত চেক করালেও কোলেস্টেরল, থাইরয়েড কোনওদিন পরীক্ষা করাননি। কেউ আবার এমনিতে ডিসিপ্লিনড জীবনযাপন করলেও অত্যধিক ধূমপান করেন। এমন রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেক বেশি।
সাবধান হোন
বয়স ৫০ বছর পেরলেই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু ভারতীয়দের সেই ঝুঁকি ৪০-এর পর থেকেই রয়েছে। একইসঙ্গে এ দেশের মানুষের জিনে হার্টের অসুখের প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশি। এমন নয় যে, এখানকার আবহাওয়া এর জন্য দায়ী। কারণ, বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দেরও কম বয়সে হার্টের অসুখ হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জিন বদলানো সম্ভব নয়, তাই তিরিশের কোঠা থেকেই হার্ট সুস্থ রাখতে সচেতন হওয়া উচিত।
শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার পর রুটিন হেলথ চেক আপ না করে সুস্থ থাকার সময় থেকেই করুন। তাই ৩৫-৪০ বছর বয়স থেকেই ছ’মাস অন্তর একবার ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল চেক করতে হবে। বয়স বাড়লে দু’-এক মাস অন্তর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খান।
হার্ট অ্যাটাক হলে কী করণীয়?
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর রোগীকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চিকিৎসা পেতে এক ঘণ্টা দেরির জন্য হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হার বেড়ে যায় প্রায় ১০ শতাংশ। হার্ট অ্যাটাকের পরপরই রোগীকে শক্ত জায়গায় হাত-পা ছড়িয়ে শুইয়ে দিন এবং গায়ের জামা-কাপড় ঢিলেঢালা করে দিন
১) হার্ট অ্যাটাকের পর যদি আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তার কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর চেষ্টা করুন
২) হার্ট অ্যাটাকের পর রোগীর যদি বমিভাব হয়, তাহলে তাঁকে একদিকে কাত করে দিন। যাতে সহজেই বমি করতে পারেন। এতে ফুসফুসের মতো অঙ্গে বমি ঢুকে পড়া থেকে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তি রক্ষা পাবেন।
৩) রোগীর মুখে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। সরবিট্রেট জাতীয় ওষুধ-ও দেওয়া যেতে পারে। তবে এই ওষুধ রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। তাই এটি দিলে রোগীকে শুইয়ে রাখতে হবে।
৪) দ্রুত ইসিজি করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না।
৫) রোগীকে বসিয়ে পিঠে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে থাকতে বলুন। তবে যে পজিশনে থাকতে রোগীর সুবিধা হচ্ছে, তেমন অবস্থাতেই রাখা ভাল।
৬) এই সময় সিঁড়ি ভাঙা, হাঁটাচলা করানো ঠিক নয়।
কিভাবে ঠেকানো যাবে হার্ট অ্যাটাক? (How to Prevent Sudden Heart Attack)
১) খাবার ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। একটা বয়সের পর জীবনে রুটিন আনা জরুরি। নিয়মিত হাঁটা-চলা ও ব্যায়াম করতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে। সর্বদা সক্রিয় থাকতে হবে।
২) ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির মতো সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হোন।
৩) চিন্তামুক্ত থাকতে হবে, টেনশনে পড়ে একের পর এক সিগারেট খাওয়ার মতো বদ অভ্যাস ত্যাগ করুন। ধূমপানের অভ্যেস থাকলে আজই বন্ধ করুন।
৪) চিকিৎসকের কাছে রুটিন মাফিক পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা
রক্ত সংবহন পথে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হার্টে রক্ত পৌঁছতে পারে না। সেই কারণে মূলত হার্ট অ্যাটাক হয়। সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছলে ওষুধের মাধ্যমে জমাট রক্ত তরল করে দেওয়া যায়। ৩ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে গেলে সাধারণত হার্টে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। তখন তা কাটানোর সবচেয়ে ভাল উপায় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো। অ্যাটাকের ১২ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলে যথেষ্ট ভাল ফল পাওয়া যায়। কোনও কারণে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে না পারলে ওষুধের উপরই ভরসা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে ফল খুব ভাল নাও হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের রোগীর পরবর্তীকালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক ও cardiac death -এর সম্ভাবনা থাকে। কারণ প্রথম অ্যাটাকের পর হার্ট যথেষ্ট দুর্বল হয়ে যায়। স্বাভাবিক ৬০-৬৫ শতাংশের পরিবর্তে হার্ট ৩০-৩৫ শতাংশ কাজ করে।
Comments are closed.