গত বছরের শেষভাগ থেকে করোনা সংক্রমণে বিধ্বস্ত সারা বিশ্ব। এই অতিমারির প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে চাই ভ্যাকসিন। বহু দেশেই চলছে সেই প্রচেষ্টা। কোনও কোনও দেশ দাবি করছে তারা এই প্রতিষেধক তৈরিতে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যিই কোথায় দাঁড়িয়ে আছে করোনা ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া?
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পথে এগোচ্ছে। এর মধ্যে বিগত করোনাভাইরাস (সার্স) মহামারির সময়ে অর্জিত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে একদল গবেষণা করছেন। আরেক দল ইবোলার মতো অন্য মহামারিগুলো থেকে নেওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছেন। কিন্তু একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি সেবা প্রকল্পের পরিচালক ড. মাইক রায়ান সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, নিরাপত্তা মানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরিতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।
প্রতিষেধক তৈরিতে কোন দেশের কোন ইনস্টিটিউট কতদূর এগিয়েছে? (Growth in COVID Research)
করোনার প্রতিষেধক প্রস্তুতি ও অগ্রগতি
যে কোনও ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি করতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগে বিজ্ঞানীদের। ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা, ভ্যাকসিন তৈরি, হিউম্যান ট্রায়াল, মানব শরীরে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি জানতে অনেকটা সময় প্রয়োজন। কিন্তু করোনার প্রভাব এত ভয়াবহ ও মারাত্মক যে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী ও গবেষকরা হন্যে হয়ে তার প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করছেন। কার্যকরী ভ্যাকসিনের খোঁজে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০০ টি দেশ নিরন্তর গবেষণা ও ট্রায়াল চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ৯ জুন আলজাজিরায় একটি প্রতিবেদন লিখেছেন ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর চিকিৎসক আমির খান। তাঁর ‘Doctor’s Note: Where are we in developing a coronavirus vaccine’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক তৈরিতে কোন দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে।
আমেরিকা ও ইউরোপে করোনা প্রতিষেধকের গবেষণা (Growth in America and Europe)
করোনা বিধস্ত আমেরিকায় গত মার্চের মধ্যভাগে মানবশরীরে প্রথম প্রতিষেধকের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের উদ্যোগে সিয়াটেলে এই ট্রায়ালে ৪৫ জন স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়। এর প্রভাব জানতে আগামী কয়েকমাস স্বেচ্ছাসেবীদের নজরে রাখা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক আমির খান। তিনি লিখেছেন, ভ্যাকসিন ট্রায়ালের একটি ধাপ, পশুর শরীরে প্রতিষেধক পরীক্ষা না করেই সার্স ও মার্স ভাইরাস থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গবেষকরা সরাসরি মানব শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছেন। যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এদিকে গত এপ্রিল মাসে প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রায়াল-ও হয়ে গিয়েছে। মাত্র তিন মাসের গবেষণায় ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হন বলে দাবি। আগামী দিনে এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছা সেবককে নিয়োজিত করা হচ্ছে পরের ট্রায়ালের জন্য। যেখানে অর্ধেক মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হবে SARS-CoV-2 ভাইরাস ভ্যাকসিন এবং বাকি অর্ধেকের শরীরে দেওয়া হবে মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিন। তবে কোন ভ্যাকসিন কার শরীরে দেওয়া হচ্ছে সেই তথ্য কেবল গবেষকরাই জানবেন, বলছে আলজাজিরার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন। আমেরিকার গবেষণার মতো এখানেও পুরো ভাইরাসের বদলে তার জেনেটিক কোডের একটা অংশ ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। অক্সফোর্ডের ট্রায়ালেও সব স্বেচ্ছাসেবীকে একই মাত্রার প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে না এবং একের বেশি ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে বলে লিখেছেন চিকিৎসক আমির খান। এভাবেই গবেষকরা ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিচার করবেন এবং অনাক্রমতা বিচার করে দেখবেন।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি
বিভিন্ন দেশ তো বটেই, কিছু বিখ্যাত ফার্মা কোম্পানিও নিজেদের মতো প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসেই বিখ্যাত ফার্মা সংস্থা সানোফি (Sanofi) এবং জিএসকে (GSK) যৌথভাবে একটি করোনা প্রতিষেধক তৈরি করেছে। যা তারা নিজেরাই ‘অভূতপূর্ব’ বলে দাবি করেছে। সানোফি সংস্থা এস-প্রোটিন কোভিড-১৯ অ্যান্টিজেন দেবে, এক্সা তাদের দাবি অনুযায়ী, SARS-CoV-2 পাওয়া প্রোটিনের ঠিক অনুরূপ জেনেটিক কোডের প্রোটিন হল এস-প্রোটিন (S-protein)। আর GSK এর এই ভ্যাকসিন তৈরিতে অবদান হিসেবে থাকবে ‘অ্যাডজুভান্ট’ (adjuvant) প্রযুক্তি। শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর তার কার্যক্ষমতা বাড়ানো এবং ওই ব্যক্তির অনাক্রমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে এই প্রযুক্তি। চিকিৎসক আমির খান জানাচ্ছেন, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সানোফি ও জিএসকের তৈরি ভ্যাকসিন বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া ফাইজার (Pfizer) নামে আর একটি ফার্মা সংস্থা জার্মানির বায়োএনটেক ( BioNTech) এর সঙ্গে জোট করে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরিতে নেমেছে। ইতিমধ্যেই জার্মানিতে তাদের হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আগামী দিনে আমেরিকাতেও তাদের তৈরি প্রতিষেধক পরীক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ফাইজার ও বায়োএনটেক।
মডার্না
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি মডার্নার সংক্রামক রোগ সম্পর্কিত এক দল গবেষক ও মার্কিন জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) তৈরি করা এমআরএনএ-১২৭৩ নামের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজ গত ১৬ মার্চ এক স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। সার্স ও মার্সের ওপর পরিচালিত গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি করা এই ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এটি কতটা সক্রিয় করতে পারে, সে বিষয়টিই এখন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে এটি ৪৫ জন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কের শরীরে পরীক্ষা করা হবে।
মডার্না জানিয়েছে, তারা এখনও শুরুর পর্বে রয়েছে। যদিও মডার্নার এই পদক্ষেপকে এক ধাপ অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন এনআইএইচের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসের পরিচালক ও করোনাভাইরাস সম্পর্কিত হোয়াইট হাউসের টাস্ক ফোর্স সদস্য ডাঃ অ্যান্থনি ফউসি।
ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনোভিও গত ১২ মার্চ ঘোষণা করে, কোভিড ১৯ এর জন্য তাদের তৈরি করা ডিএনএ ভ্যাকসিনের গবেষণার গতি বাড়াতে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন নতুন করে তাদের ৫০ লাখ ডলারের তহবিল দিয়েছে। তাদের তৈরি ভ্যাকসিনটির নাম আইএনও-৪৮০০। গবেষণাটি বর্তমানে প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে।
এশিয়া পেসিফিকে করোনার প্রতিষেধক
এপ্রিলেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি একটি ভ্যাকসিন পশুর শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমতি পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
এনএইচএসে কর্মরত চিকিৎসক আমির খান তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, চিনও ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে অনেকটা এগিয়েছে।
CanSino Biologics নামে এক চিনা সংস্থা পশুদের শরীরে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে সাফল্য পাওয়ায় হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়া চিনে আরও অনেকগুলি সংস্থা ও ফার্মা কোম্পানি আলাদাভাবে করোনা ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্যানসিনো বায়োলজিকস
চিনের তিয়ানজিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও দেশটির অ্যাকাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেসের গবেষকদের তৈরি একটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে চিন কর্তৃপক্ষ। সেখানকার গবেষকেরা বলছেন, অ্যাড ৫-এনকোভ নামের এই ভ্যাকসিন এরই মধ্যে প্রাণী শরীরে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেখানে এটি নিরাপদ ও এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করার ক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে। মানুষের শরীরে এর পরীক্ষা করার প্রাথমিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন। উহানের টংজি হাসপাতালে ১০৮ জন স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এর পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
ক্যানসিনোর চেয়ারম্যান তথা সিইও জুয়েফেং উ সম্পূর্ণ নিরাপদ ও উচ্চমানের একটি ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে আশাবাদী।
মিগাল
মিগাল গ্যালিলি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েছে। ইসরায়েলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুরগির সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে।
এতে সফল হলে তিন চার মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পাওয়া যাবে।
মিগালের সিইও ডেভিড জিগডন জানান, ভ্যাকসিন তৈরিতে বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। পুরো প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও সহযোগিতা করছে।
কানাডা
প্রতিষেধক তৈরির দৌড়ে রয়েছে কানাডিয়ান গবেষকদের একটি দল। যে দলে একজন বাঙালিও আছেন। সেই গবেষকদের দাবি, কিছুটা হলেও তাঁরা এই ভাইরাসকে জব্দ করতে পেরেছেন। জানা গিয়েছে, কানাডার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই বিষয়ে আশার আলো দেখিয়েছেন গোটা বিশ্বকে।
এই গবেষক দলে থাকা বাঙালি অরিঞ্জয় ব্যানার্জি টরেন্টোর ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামিত রোগ বিভাগের গবেষক। এই বিভাগ সংক্রামিত রোগ, করোনাভাইরাসের মতো মহামারি আর বাদুড় থেকে সংক্রামিত রোগ নিয়ে গবেষণা করে। জানা গিয়েছে, এই গবেষকের দল কোভিড ১৯ এর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তাঁরা দু’জন রোগীর লালারস ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কিছুটা হলেও করোনাকে জব্দ করার হদিশ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
ভারত (COVID Research in India)
এর মধ্যে কিছুদিন আগে বড় চমক দিয়ে যোগগুরু রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ ঘোষণা করেছে, এই মারণ ভাইরাসের ওষুধ তৈরি করে ফেলেছে তারা! শুধু তাই নয়, পাঁচ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই করোনা রোগীকে সুস্থ করে তুলবে তাদের আয়ুর্বেদ ওষুধ! এমনই দাবি করেছেন পতঞ্জলির সহ প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও আচার্য বালাকৃষ্ণ। যদিও পতঞ্জলির এই দাবি নিয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক কিংবা আইসিএমআর।
সব মিলিয়ে অন্তত আরও এক বছর
বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তরফে যে সমর্থন মিলছে তা এক কথায় ‘অভূতপূর্ব’। তা সত্ত্বেও ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে কারও তরফেই ভ্যাকসিন বাজারে আনার সম্ভাবনা প্রায় নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, প্রতিষেধক হাতে আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য রোগের ভ্যাকসিন তৈরির চেয়ে ঢের আগে করোনার প্রতিষেধক বাজারে আসতে চলেছে। যদিও তা নিশ্চিতভাবে কার্যকরী হবে কিনা তা হলফ করে কেউই বলতে পারবেন না।
Comments are closed.