মশার থুতু দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন কি ভবিষ্যতের মহামারি ঠেকাতে সক্ষম?

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব। এখনও পর্যন্ত নেই চিকিৎসা, আবিষ্কার হয়নি টিকাও। করোনা টিকার খোঁজে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি সাফল্যের খবর উঠে এসেছে। সেই সমস্ত টিকা চিকিৎসক মহলের হাতে আসতে এখনও ঢের দেরি।

শুধু তো করোনা নয়। ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে আরও অনেক মহামারি। তাই করোনা আবহে আরও কিছু ভ্যাকসিন আবিষ্কারের তোড়জোড় শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। তেমনই একজন জেসিকা ম্যানিং।

মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের বিজ্ঞানী ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জেসিকা ম্যানিং এমন এক ভ্যাকসিন তৈরির কথা শোনালেন যা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া-সহ মশাবাহিত যে কোনও সংক্রামক রোগ বা মহামারির প্রকোপ রুখে দিতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মশাবাহিত জীবাণু নয়, সরাসরি মশার লালা থেকে এই ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু আবিষ্কারই নয়, মানব শরীরে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে প্রথম পর্যায়ের হিউম্যান ট্রায়ালও শুরু হয়েছে।

 

হরেক মশাবাহিত রোগের এক ওষুধ

বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগের একটা বড় ক্ষেত্র হল মশাবাহিত। জেসিকা ম্যানিং নামে এই গবেষক বছর পাঁচেক আগে এক বিশেষ পরিকল্পনা করেন। বারবার বহু দেশ আক্রান্ত হয় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মত মারণ রোগে। আর সেগুলি সবই মশাবাহিত। তাই এই রোগগুচ্ছ থেকে মুক্তি পেতে একটি বিশেষ টিকার অনুসন্ধান শুরু করেন তিনি। যা একসঙ্গে সবার প্রতিকার করতে পারবে। অবশেষে সেই খোঁজ পান জেসিকা ম্যানিং। তিনি ঠিক করেন, মশার থুতু থেকেই তৈরি হবে তার প্রতিষেধক!

 

ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জির ইনকেফশাস ডিজিজ সংক্রান্ত বিষয়ের গবেষক ম্যানিং বিশ্বাস করেন মশার স্যালাইভা থেকে এমন এক ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব যা মানুষকে একসঙ্গে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্ট নিল, মায়ারো ভাইরাসের মত রোগ থেকে মুক্তি দেবে।

 

গবেষণা কোথায় দাঁড়িয়ে?

corona Vaccine made of mosquito

 

রয়টার্স সূত্রে খবর, জুন মাসের মাঝামাঝি ওই গবেষণার একটি প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমবার ওই মশাবাহিত রোগের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে কয়েকজন মানুষের শরীরে। ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে অ্যানোফিলিস মশা থেকে তৈরি এই ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম।

সম্প্রতি দ্য ল্যান্সেট জার্নালে জেসিকা ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়, মশার লালা থেকে তৈরি এই ভ্যাকসিন প্রথমবার মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়ে গিয়েছে। মোট ৪৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির শরীরে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। দুভাবে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হচ্ছে। প্রথমে দুটি ডোজে এই ভ্যাকসিন দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর সেই ব্যক্তিকে মশার কামড় খাইয়ে দেখা হবে তাঁর শরীরে কতটা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। মশার কামড়ের পর যদি দেখা যায় ব্যক্তির শরীরে আর কোনও সংক্রমণ হচ্ছে না, তাহলে আরও কয়েকবার তাঁকে মশার কামড় খাওয়ানো হবে। তারপরও সুস্থ থাকলে বুঝতে হবে রোগ প্রতিরোধকারী শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম এই ভ্যাকসিন। মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের বিজ্ঞানী জেসিকা ম্যানিং ও তার টিমের দাবি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটাই হবে সব থেকে বড় আবিষ্কার।

ম্যানিংয়ের কাজের প্রশংসা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, রোগ বহন ক্ষমতার দিক থেকে মশাকে বিশ্বের অন্যতম মারাত্মক পতঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে মশাবাহিত সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কার্যকরী হলেও এই ইউনিভার্সাল ভ্যাকসিন কি করোনার ক্ষেত্রেও কার্যকরী হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণার কাজ এখনও অনেক বাকি। হিউম্যান ট্রায়ালের সবে প্রথম ধাপ চলছো। তবে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

 

মশাবাহিত রোগে মানুষের মৃত্যু

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর হিসেব বলছে, প্রতি বছর কেবল ম্যালেরিয়াতেই পৃথিবীতে ৪ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশেষত গরিব দেশগুলোতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে প্রতিবছর নতুন নতুন দেশে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে মশা। ফলে বৃহত্তরভাবে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইয়োলো ফিভার, মায়ারো ভাইরাসের কারণেও প্রতিবছর বহু মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্ত মশাবাহিত এ সব রোগ প্রতিরোধে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনও ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ম্যানিং-এর গবেষণা ভবিষ্যতে ফের কোনও মহামারির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

রোগের বাহককে টার্গেট!

ম্যানিং-এর গবেষণা মশাবাহিত রোগে সীমাবদ্ধ হলেও বিশ্বজুড়ে ইনফেকশিয়াস বা সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা যে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা ও পরিকল্পনা করছেন, সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে।

ম্যানিং মশার লালা থেকেই মশাবাহিত সব রোগের জন্য একটি সর্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরি করছেন। কীভাবে হচ্ছে এটা? জানা গিয়েছে, মশার লালা থেকে পাওয়া একরকম প্রোটিন ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করছেন ম্যানিং ও তাঁর দলবল। রয়টার্স জানাচ্ছে, অন্যসব ভ্যাকসিনের বেলায় জীবাণুকেই উপজীব্য করা হয়, কিন্ত এখানে তা করা হয়নি। এই পরীক্ষায় ভেক্টর বা জীবসত্তাকেই হাতিয়ার করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যেহেতু জানেন, মশার লালা থেকেও মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। তাই মশার সেই লালাকেই ভ্যাকসিন তৈরির কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন তাঁরা।

 

কীভাবে এই পরিকল্পনা এল ম্যানিংয়ের মাথায়?

corona Vaccine chances

 

পাঁচ বছর আগে এক অফিস বিল্ডিংয়ে দৈত্যকায় মশার ভাস্কর্য দেখে জেসিকা ম্যানিং-এর মাথায় খেলে যায় এক অদ্ভুত পরিকল্পনা। আর সেটা মাথার মধ্যেই আটকে থেকে যায়। এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন তিনি। তারপরই আলাদা আলাদা করে মশাবাহিত অসুখের ওষুধ তৈরির চেয়ে একটি প্রতিষেধকের মাধ্যমেই সব মশাবাহিত রোগের খেল খতমের পরিকল্পনা করেন ম্যানিং।

তাঁর তৈরি প্রতিষেধকের বিস্তারিত ব্যাখা দিতে গিয়ে ওই মহিলা বিজ্ঞানীর দাবি, মশা থেকে যে সব জীবাণু বা প্যাথোজেন মানুষের শরীরে ঢোকে এবং ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভার বা মেয়ারো রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের রূপ নেয়, সেইসব প্যাথোজেন দিয়েই তিনি তৈরি করছেন এই ‘ইউনিভার্সাল ভ্যাকসিন’। এই প্রতিষেধক শরীরে প্রবেশ করে এমন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে যা, যে কোনও ভেক্টর-বর্ন জিজিজ আটকাতে সক্ষম। মশার লালা বা থুতুতে উপস্থিত প্রোটিনকেই কাজ লাগানো হচ্ছে এই ভ্যাকসিনে।

গবেষণা সফল হলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভার ইত্যাদির মতো ভাইরাস ঘটিত রোগ এবং যে কোনও সংক্রামক রোগকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে এই ভ্যাকসিন, দাবি জেসিকা ম্যানিং-এর।

Comments are closed.