কসবা নিউ মার্কেট এলাকায় ক্যাফে চালান সোমদত্তা মুখার্জি। করোনা আবহে কয়েকমাস বন্ধ রাখার পর ক্যাফে খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সোমদত্তা। কিন্তু ক্যাফেতে যাঁরা আসছেন তাঁদের কেউ সংক্রমিত কিনা তা জানা যাবে কীভাবে? প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ করে তাই সোমদত্তা কিনে ফেলেছেন একটি ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। তা দিয়ে ক্যাফেতে আসা প্রত্যেকের দেহের উষ্ণতা চেক করছেন তিনি, তারপরই মিলছে ভিতরে ঢোকার ছাড়পত্র।
আনলক পর্ব শুরু হওয়ার পর নিউ নর্মালের অন্যতম অলঙ্কার হয়ে উঠেছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। মল থেকে শুরু করে স্ট্যান্ড অ্যালোন দোকান কিংবা মদের দোকানের লম্বা লাইন, সোমদত্তার মতো ইনফ্রারেড থার্মোমিটারকে হাতিয়ার করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে স্থানীয় অর্থনীতি। অনেকটা হেয়ার ড্রায়ারের মতো দেখতে এই যন্ত্র করোনা-কালে মানুষকে ভরসা যোগাচ্ছে। স্বভাবতই মহামারির সময় ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের কাটতি বেড়েছে কয়েক গুণ। শুধু দোকান নয়, ঘরে ঘরে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মতো নন কন্টাক্ট মেডিক্যাল ডিভাইস কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের উপযোগিতা কতটা?
অতিমারি বিধ্বস্ত বিশ্বে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। আপনার কপাল লক্ষ্য করে সেই যন্ত্র তাক করলে শরীরের তাপমাত্রা নথিভুক্ত হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে আপনার গায়ে জ্বর আছে কিনা। গায়ে জ্বর থাকা করোনার অন্যতম উপসর্গ।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে করোনা সংক্রমিতদের বেশিরভাগই অ্যাসিমটোম্যাটিক বা উপসর্গ বিহীন। সুতরাং মল কিংবা অন্য কোথাও ঢোকার মুখে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাঁদের শরীরে জ্বর মাপলেও উষ্ণতা পাওয়া যাবে না। অথচ উপসর্গহীনেরা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারেন। ফলে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে পুরোপুরি সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়।
ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলতে গিয়ে মার্কিন মুলুকের জন্স হপকিন্সের ইনফেকশাস ডিজিজ ফেলোশিপ প্রোগ্রামের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর তথা মেডিসিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর নাতাশা চিডা বলছেন, ধরুন আপনি জিম থেকে ওয়ার্ক আউট করে বা মাঠে ঘাম ঝরিয়ে মলে ঢুকতে গেলেন। এই সময় আপনার দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। স্বভাবতই আপনি করোনা সংক্রমিত না হলেও আপনার দেহের তাপমাত্রা বেশি দেখাবে।
এছাড়াও রয়েছে ওই যন্ত্র ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারা না পারার প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথা বা শরীর থেকে ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার ধরতে হয়। কিন্তু যাঁরা এই কাজ করছেন তাঁরা কেউই প্রশিক্ষিত নন। ফলে দূরত্ব ভেদে সঠিক তাপমাত্রা নাও ধরা পড়তে পারে। তাই পুরোদস্তুর চিকিৎসা পরিকাঠামো ছাড়া, শুধুমাত্র ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে সংক্রমণের হদিশ মেলার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। বরং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি রয়েছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মানের প্রশ্নটিও। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সস্তার থার্মোমিটার দিয়ে বাজার ধরতে গিয়ে মানের সঙ্গে আপোস করারও আশঙ্কা রয়েছে।
বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হালফিলের বিশ্বে এই যন্ত্রের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। আমেরিকায় আগামী ৭ বছরের মধ্যে নন কন্টাক্ট টেম্পারেচার মেজারমেন্ট সিস্টেম মার্কেট ১৩৫০.২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। একই হারে লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপেও বাজার বাড়ছে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের মতো না হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে নন কন্টাক্ট থার্মোমিটারের বাজার বাড়ছে। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতদিন যাবে ভারতের বাজার আরও বাড়বে।
ইতিমধ্যেই অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের মতো ই-কমার্স সংস্থায় ঢেলে বিক্রি হচ্ছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। ফ্লিপকার্টের তরফে জানানো হয়েছে, শেষ ৬ মাসে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের বিক্রি বেড়েছে ২৬ গুন! ভারতের সবচেয়ে বড় অনলাইন ফার্মাসিউটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম 1mg জানাচ্ছে, মে মাসে কয়েকশো হোম মেডিক্যাল ডিভাইস বিক্রি হয়েছিল। জুন মাসে তা বেড়েছে অন্তত ১৫ গুন। তার মধ্যে রয়েছে পালস অক্সিমিটারও।
সবমিলিয়ে মাস্ক-স্যানিটাইজারের মতোই নিউ নর্মালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠতে চলেছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। যদিও তা আদৌ কতটা কাজের, তা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন থাকছেই।
Comments are closed.