বাংলার সিপিএম নেতারা যখন আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার রাস্তা পাকা করতে মরিয়া, তখনই এ কে গোপালন ভবন সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুতে তীব্র আক্রমণ করল কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধীকে। সিপিএমের মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসির শেষ প্রকাশিত সংখ্যায়, চলতি পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন পর্বে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে কংগ্রেসের। ঘটনাচক্রে সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদক, যিনি আবার দলের অন্দরে তীব্র কংগ্রেস বিরোধী বলেই পরিচিত।
৯ ই ডিসেম্বর প্রকাশিত পিপলস ডেমোক্রেসিতে ‘গ্রোয়িং মোবিলাইজেশন অফ ওয়ার্কিং পিপল টু ডিফিট বিজেপি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানে নির্বাচনী প্রচারে কংগ্রেস ব্যাপক হিন্দুত্বের প্রচার করেছে। নিজেকে বিজেপির থেকেও বেশি ‘হিন্দু’ প্রমাণে মরিয়া রাহুল গান্ধী একের পর এক মন্দিরে গিয়েছেন। মধ্য প্রদেশে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি পঞ্চায়েতে গো-শালা তৈরি করা, গো-মূত্র বিক্রি, এবং রামের বনে যাওয়ার পথ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস। রাজস্থানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, বৈদিক নীতি কথা পড়ানোর জন্য আলাদা এডুকেশন বোর্ড গঠনের। শুধু তাই নয়, পেহলু খান খুনের ব্যাপারেও চুপ থেকেছে কংগ্রেস।’
পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছে, ‘কংগ্রেস যদি মনে করে নরম হিন্দুত্বের কথা বলে তারা বিজেপিকে পরাস্ত করবে তবে তারা ভুল করছে।’
পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদকীয়র মূল নির্যাস, ভারতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য শক্তিশালী হচ্ছে। রুটি, রুজিসহ মানুষের মৌলিক দাবি পূরণে ব্যর্থ কেন্দ্র। ‘অযোধ্যায় মন্দির চাই না, ঋণ মকুব চাই’ বলে লাখো কৃষকের মিছিল হচ্ছে দিল্লিতে। এই অবস্থায় কংগ্রেসের এই নরম হিন্দুত্বের লাইন দিয়ে বিজেপির মোকাবিলা করা যাবে না।
৯ ই ডিসেম্বর প্রকাশিত সিপিএমের মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসির এই সম্পাদকীয় স্বাভাবিকভাবেই পার্টিতে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে সিপিএমের বাংলার নেতাদের একটা বড় অংশ যেখানে সাম্প্রতিক অতীতে বারবারই বলে এসেছেন, বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিই এই মুহূর্তে দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ। একধাপ এগিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ধারাবাহিক বক্তব্য হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিজেপি এবং তৃণমূল মুদ্রার দু’পিঠ। তাই বাংলায় বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্যকান্ত মিশ্ররা বারবার বাংলার পার্টি নেতাদের মধ্যে এই বার্তাই দিয়েছেন, তৃণমূল এরাজ্যে বিজেপির মোকাবিলা করতে পারবে না।
কিন্তু হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুতে খোদ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর যা ভূমিকা, কিংবা কেরলে সাবরীমালা মন্দির ইস্যুতে সেই রাজ্যে সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের যে ভূমিকা, তা দিয়ে কীভাবে বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলা হবে তা ইয়েচুরি, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিমের মতো ‘প্রো-কংগ্রেসি সিপিএম’ নেতাদেরও চিন্তায় ফেলেছে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন সম্প্রতি সেই রাজ্যের বিধানসভায় কংগ্রেসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তারা অমিত শাহের দেখানো রাস্তায় চলছে। প্রকাশ কারাট ঘনিষ্ঠ পলিটব্যুরো সদস্য এস আর পিল্লাইও সাবরীমালা ইস্যুতে সম্প্রতি কেরলে কংগ্রেসের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন।
কিন্তু ৯ ই ডিসেম্বর পার্টির মুখপত্রে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে যে ভাষায় সরাসরি রাহুল গান্ধীর নাম করে কংগ্রেসের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, তা সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তো বটেই, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকেও একটা স্পষ্ট বার্তা, যা কংগ্রেসপন্থী সিপিএম নেতাদের পক্ষে অত্যন্ত চিন্তার। সূর্যকান্ত মিশ্ররা একরকম ঠিক করেই রেখেছেন, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলায় আসন সমঝোতার একটা রাস্তা খোলা রাখার ব্যাপারে। কিন্তু মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে যেভাবে মন্দিরে, মন্দিরে ঘুরে রাহুল গান্ধী নির্বাচনী জনসভা করেছেন, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে এরাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে ৩১ নম্বর মুজফফর আহমেদ ভবনে।
Comments are closed.