১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তখন তিনি ১২ বছরের কিশোরী। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিদেশি দ্রব্য বর্জন করতে লাগাতার ৬ মাস চাটাইয়ে শুয়ে ছিলেন। তখন থেকেই পথ চলা শুরু। যা জারি রয়েছে তাঁর এই ৯২ বছর বয়সে এসেও।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সমাজের গরিব, পিছিয়ে পড়া অংশের হয়ে সারাজীবন কাজ করে গিয়েছেন প্রভাবেন শাহ। তাঁর কাজকে স্বীকৃতি জানাতে অবশেষে ৯২ বছর বয়সের প্রভাবেন দেবীকে পদ্মশ্রী সম্মান দিয়েছে কেন্দ্র।
‘নিজে সেই পরিবর্তনটা হয়ে দেখাও, যা তুমি সমাজের মধ্যে দেখতে চাইছো’ গান্ধীজির এই একটা কথাই গভীর প্রভাব ফেলেছিল কিশোরী প্রভাবেন শাহের মনে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয় গুজরাটের বাসিন্দা সুভাষ শাহের সঙ্গে। সুভাষ শাহ গুজরাট ইলেকট্রিক বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর বদলি হওয়ায় তাঁরা চলে আসেন বারডলি নামে একটি জেলায়। ১৯৬০ সালে বদলি হয়ে তাঁরা যখন বারডলি আসেন তখন তাঁদের বড় মেয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর। নতুন জায়গায় এসে প্রভাবেন দেবী দেখেন মেয়ের পড়াশোনার জন্য সেখানে কোনও স্কুল নেই।
মেয়ের পাশপাশি স্থানীয় শিশুদের পড়াশোনার জন্য একার উদ্যোগে ‘বাল মন্দির’ নামে একটি প্রাথমিক স্কুল তৈরি করেন প্রভাবেন। প্রথমে নিজেই পড়াতে শুরু করেন। পরে শিক্ষকও নিয়োগ করেন। এমনকী শিক্ষকদের বেতন এবং স্কুলের খরচের জন্য খাদি আশ্রমে কাজ শুরু করেন প্রভাবেন।
দু’বছর পর ফের তাঁর স্বামীর বদলি হয়ে যায় দমান নামে একটি জেলায়। সেই সময় ওই জেলাতেও কোনও স্কুল ছিল না। প্রভাবেন জানান, দমান-এ স্কুল খোলার বদলে আরও সংগঠিতভাবে কাজ করার জন্য স্থানীয় কিছু মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে আমি মহিলা মন্ডল নাম দিয়ে একটি গোষ্ঠী শুরু করি। ওই মহিলা মন্ডলের উদ্যোগেই আমরা ওখানে স্কুল শুরু করি।
৬০ দশকে রক্ষণশীল সমাজে শুধু মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত কোনও গোষ্ঠী কার্যত কাঁচের পাথর বাটির মতোই অসম্ভব একটি কাজ ছিল। কিন্তু প্রভাবেন হার না মেনে তা করে দেখান। শিশুদের পাশপাশি বাড়ির মহিলাদেরও পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন তিনি। মহিলাদের সুবিধের কথা ভেবে রাতে তাঁদের জন্য স্কুল চালু করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর তৈরি মহিলা মন্ডল স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একটি ইংলিশ মিডিয়াম এবং একটি গুজরাটি মিডিয়াম স্কুল গড়ে তোলে।
স্কুল তৈরিতেই থেমে না থেকে নিজেরাই সয়ম্বর গোষ্ঠী তৈরি করে ছোটো ছোটো ব্যবসার জন্য মহিলাদের লোন দিতে শুরু করে। মহিলা মন্ডলের এধরণের একাধিক উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম ১৯৬৫ সালে তারা সরকারি হাসপাতালে রুগীর পরিবারের জন্য ক্যান্টিন শুরু করে।
১৯৬৫-১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সারা দেশে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের জন্য অনুদান সংগ্রহ করছিলেন। প্রভাবেন তাঁর সাক্ষাৎকরে জানান, সে সময় মহিলা মন্ডল পর্যাপ্ত অনুদান সংগ্রহ করতে পারেনি। বদলে আমরা সৈনিকদের জন্য সোয়েটার তৈরি করে এবং রেশন সামগ্রী জোগাড় করে পাঠাতাম। তাঁর কথায়, স্বাধীনতার মুহূর্তের স্বাক্ষী ছিলাম আমি। প্রতিবেশী দেশের কাছে অত্যাচারিত হওয়ার জন্য ভারত স্বাধীন হয়নি! সেই কারণেই আমরা দেশের জওয়ানদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম।
এখানেই শেষ নয়, ১৯৮৪ সালে ভূপাল গ্যাস ট্রাজেডি, ২০০১ সালের ভূমিকম্প থেকে শুরু করে সম্প্রতি ২০১৮ সালে কেরলের বন্যা। প্রতিবারই দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে প্রভাবেনের সংস্থা মহিলা মন্ডল ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এই ফেব্রুয়ারিতে ৯৩ তে পড়বেন প্রভাবেন শাহ। এখনও একই ভাবে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে কাজ করছে তাঁর সংস্থা। বললেন, এতটা পথ পেরিয়ে আসা মোটেই সহজ ছিল না। যখন মহিলা মন্ডল শুরু করি আমার স্বামী প্রতি মাসে মাইনে পেতেন ২৫০ টাকা। ওই টাকার বেশির ভাগটাই আমি সংসারের বদলে গোষ্ঠীর কাজে ব্যয় করতাম। ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ মহিলা মন্ডল এত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া।
Comments are closed.