রাজীব কুমার সম্পর্কে সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্ব কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলা সমর্থকরা কতটা কী জানেন বলতে পারব না, তবে অভিজ্ঞতায় জানি, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সততা এবং দক্ষতা নিয়ে একশো শতাংশ ওয়াকিবহাল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু দীর্ঘ বছর স্বরাষ্ট্র দফতর চালানো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন রাজীব কুমারকে পছন্দ করতেন, তা এই লেখার বিষয় নয়।
এই লেখার বিষয় কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্য নজিরবিহীন সংঘাতের আবহে কেন্দ্রীয় সংস্থা (সিবিআই) নিয়ে সিপিএমের সামগ্রিক মূল্যায়নের পরিবর্তন। সেই ১৯৭৭ বা তারও আগে থেকে যে পার্টি কেন্দ্রের বিভিন্ন এজেন্সি বা বিশেষ করে সিবিআই-এর অতি তৎপরতা নিয়ে ধারাবাহিক একটা অবস্থান রক্ষা করেছে, সেই সিপিএম হঠাৎ করে সাম্প্রতিক এক ঘটনায় কি সত্যিই নিজেদের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত অবস্থান বদল করতে চলেছে?
এই আলোচনায় বিস্তারিত যাওয়ার আগে ১০ বছরের পুরনো একটি ঘটনার উল্লেখ করব। কেরলের কংগ্রেস সরকার সেই রাজ্যের প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী সিপিএম শীর্ষ নেতা পিনারাই বিজয়নের বিরুদ্ধে এসএসসি লাভলিন মামলায় দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। শেষমেশ এই ঘটনার তদন্তভার নেয় সিবিআই। নির্দিষ্ট কেস শুরু করে বিজয়নের বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালের ২২ শে জানুয়ারি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর পলিটব্যুরো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ‘CBI Move: Politically Motivated — Lavlin Case’ শীর্ষক এই বিজ্ঞপ্তিতে সিপিএম লিখেছিল, ‘কেরলের সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিজয়নের বিরুদ্ধে সিবিআই-এর মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা। এখন লোকসভার আগে ফের এই মামলায় তৎপরতা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করা গুরুতর চিন্তার বিষয়, এই রাজনৈতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে সিপিএম মানুষের কাছে যাবে (The use of Central investigating agencies by the ruling party for political purposes should be a matter of serious public concern. The CPI(M) will take this issue to the people and expose the political gameplan behind this move.)।’
পড়ুনঃ সিপিএম পলিটব্যুরোর বিজ্ঞপ্তি, CBI Move: Politically Motivated — Lavlin Case
পিনারাই বিজয়নের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত যখন চালু হয়, তখনও প্রমাণ হয়নি কেরলের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নির্দোষ। আবার বাংলায় গত পাঁচ বছর ধরে চিট ফান্ড তদন্তেও এখনও প্রমাণ হয়নি গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের একাধিক নেতা থেকে শুরু করে রাজীব কুমার বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দোষী। প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতির মামলায় কে দোষী, কে নন, কার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ঠিক কী কারণে কখন তদন্তে তৎপরতা দেখায় বা কখন ‘ঘুমিয়ে’ পড়ে, তা নিয়ে সিপিএমের আগাগোড়াই একটা ধারাবাহিক অবস্থান ছিল।
যে সিপিএম মনে করত, ২০০১ সালে গড়বেতায় ছোট আঙারিয়া কাণ্ড বা কেরলে বিজয়নের বিরুদ্ধে মামলায় সিবিআই রাজনৈতিক কারণে অতি তৎপর, সেই সিপিএমই কিছুদিন আগেও জয়ললিতা বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অফিসে কেন্দ্রীয় সংস্থার হানা নিয়ে সরব হোত। সেই সিপিএমই আজও মায়াবতী বা অখিলেশ বা লালু প্রসাদের বিরুদ্ধে সিবিআই বা ইডির অভিযান নিয়ে বিবৃতি দেয়। এই সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুই বারবার বলতেন, আমরা যে কোনও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এই সিপিএম সরকারই তো নন্দীগ্রাম কাণ্ড এবং নেতাই গণহত্যার ঘটনায় সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে দিনের পর দিন হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট করেছে এই সেদিনও।
আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন, ছোট আঙারিয়া থেকে লাভলিন দুর্নীতি মামলায় যে সিবিআইকে কেন্দ্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার বলে দিস্তা-দিস্তা খসড়া লিখেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বা এ কে গোপালন ভবন, তারাই আজ বাংলায় সেই কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা দাবি করে এত মিটিং-মিছিলে কেন?
আসলে, ভোট আসছে। সেই ২০০৭-০৮ সাল থেকেই একদিকে সাচার কমিশনের সুপারিশ, অন্যদিকে জমি ইস্যু, মুসলিম ভোট সিপিএমের থেকে মুখ ফিরিয়েছে। তার মধ্যে ২০১৪ সালে গোটা দেশে বিজেপির উত্থানের পর রাজ্যে যে মেরুকরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে মুসলিম ভোট এখন পুরোপুরি তৃণমূলের দিকে। এই অবস্থায় মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ককে ফেরাতে তৃণমূল-বিজেপি গটআপের তত্ত্ব হাজির করেছিল রাজ্য সিপিএম। কারণ, আলিমুদ্দিন জানতো, একমাত্র এই স্লোগান মানুষকে কিছুটা বিশ্বাস করাতে পারলে মুসলিম ভোট খানিক ফিরলেও ফিরতে পারে। কিন্তু এই প্রচার যে এখনও মানুষ বিশ্বাস করছেন না এটা বড় কথা নয় (কারণ, তা সত্যি হলে একদিন না একদিন মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় ঠিক বুঝবেনই), বড় কথা হল, এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আজ কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত, অতি তৎপরতা নিয়েও ধারাবাহিক, সর্বভারতীয় অবস্থান বদল করতে হচ্ছে সিপিএমের মতো একটি জাতীয় দলকে।
বিষয়টি দিন-দিন এমন জায়গায় গিয়েছে, এই রাজনৈতিক গোলক ধাঁধা থেকে বেরনোর রাস্তা কী তা ভেবেই নাজেহাল এখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। একদিকে পাঁচ বছর ধরে বলা বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে ‘সেটিং’এর তত্ত্ব, অন্যদিকে এখনও প্রাণে আশা আছে, সিবিআই যদি সত্যিই কিছু করে! তাতে যদি সত্যিই বেকায়দায় পড়ে রাজ্যের শাসক দল, তবে আবার মহাকরণের দখল নেওয়া যাবে। দলের কিছু নেতা এটাও বুঝে উঠতে পারছেন না, যদি সবটা ‘সেটিং’ই হয়ে থাকবে, তবে সিবিআই কিছু করবে কেন? কিন্তু কলকাতার সাম্প্রতিক ঘটনা পর্বে আপনি যদি সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পড়েন, আপনিও বুঝবেন সিবিআই তদন্ত নিয়ে তৃণমূল যত না চিন্তায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ঝামেলায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
গত ৫ ই ফেব্রুয়ারি ‘গণশক্তি’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘রাজীব কুমারেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী’ শীর্ষক খবরের প্রথম লাইন ‘রবিবার সারা রাত নিজাম প্যালেসে জরুরি বৈঠক করল সিবিআই’।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা নিশ্চই জবাব দিতে পারবেন এক সামান্য প্রশ্নের, সবই যদি ‘মোদি ভাই-দিদি ভাই সেটিং’ তবে সিবিআই ইন্সপেক্টর থেকে জয়েন্ট ডিরেক্টর নিজাম প্যালেসে বেকার রাত জাগছেন কেন? আর রাত জাগবেনই যদি, সিনেমা না দেখে জরুরি মিটিং করছেন কেন? ‘সাজানো স্ত্রিপ্টে’ অভিনয় করতে সারা রাত জরুরি মিটিংও করতে হয়? এখানেই ধরা পড়ে যাচ্ছে ‘সেটিং’এর তত্ত্ব। দলের রাজ্য সম্পাদক বলছেন, ‘সেটিং’, আর পার্টির মুখপত্র লিখছে, রাজীব কুমার বেকায়দায়, সারা রাত জরুরি মিটিং করছে সিবিআই।
লেখা শেষ করব সেই কেরলের কথা উল্লেখ করে। ১৯৫৯ সালে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের সরকার ফেলে দিয়েছিল কংগ্রেস। তারপর থেকে বিরোধীদের ওপর কেন্দ্রের অযাচিত হস্তক্ষেপের হাজারো ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে। কখনও সিবিআই, তো কখনও রাজ্যপালকে ব্যবহার করেছে কেন্দ্র। সেই অভিজ্ঞতা সিপিএমেরও আছে। মোদীর আমলে কাশ্মীর থেকে শুরু করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, জয়ললিতা, লালু, মায়াবতী, অখিলেশ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ওপর বা হালফিলে রবার্ট বঢ়রাকে জেরা, যেভাবে একের পর এক বিরোধীর ওপর কেন্দ্রীয় এজেন্সির যে অতি তৎপরতা শুরু হয়েছে, চাইব তা কেরলেও যেন না হয়। কারণ, সত্যিই যদি সাবরীমালা ইস্যু বা অন্য কোনও ঘটনায় কাল পিনারাই বিজয়ন সরকারের ওপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে, তখন পাশে দাঁড়ানোর মতো লোক পাবে তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদী?
Comments are closed.