কাউকে ব্যক্তিগত সমালোচনা কিংবা কারও কোনও উৎসবে সামিল হওয়ার ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য নয়, আসলে সিপিএম বা বামপন্থীদের যেভাবে দেখতে চাই, সেভাবে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা, দুঃখ থেকে এই লেখা।
এপ্রিল-মে মাসে ভোট হওয়া এরাজ্যে দীর্ঘ বছরের রেওয়াজ। আর ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা মতে প্রতিবারই এই সময় ভোটের আগে নিয়ম করে আসে দোল উৎসব। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম উত্তর ভারত বা হিন্দি বলয়ের রাজনৈতিক নেতাদের দোল খেলার ছবি। সেই ছবি দেখে ভাবতাম, কেন রাজনৈতিক নেতাদের এই ধরনের উৎসবে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হয়? আর গর্ববোধ করতাম এটা ভেবে, আমার রাজ্যে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ভোটে লড়তে, ভোটে জিততে দোল খেলতে হয় না। আবির নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে হয় না অনিল বিশ্বাস, সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুদের। বাংলায় দীর্ঘদিন দাঙ্গানিরপেক্ষ সরকার চালাতে বা নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করতে সিপিএম নেতাদের সমস্ত ধর্মীয় উৎসবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হয় না। কিন্তু আজ হঠাৎ দোল উৎসবে কেন সামিল হতে হচ্ছে সিপিএম নেতা-নেত্রীদের?
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন দেশের সামনে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এটা শুধুমাত্র একটা সরকার গড়া কিংবা একটা সরকার চলে যাওয়ার নির্বাচন নয়। এই নির্বাচন দেশে একটা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই, যে লড়াইয়ে দেশের বর্তমান শাসক দল জয়লাভ করলে, আগামী দিনে অন্য খাতে বইবে দেশের রাজনীতি। এই বিরলতম নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে সমস্ত ডানপন্থী জাতীয় এবং আঞ্চলিক দল যখন বিজেপির মোকাবিলায় নিজের মতো করে নরম হিন্দুত্বের পথ নেওয়ার কৌশল খুঁজছে, সেখানে তো বামপন্থীরাই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। যারা আজ দেশের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজেদের আদর্শবোধে অটল থেকে মোকাবিলা করতে পারতো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ধর্মীয় প্রভাবের। যে সময়ে দাঁড়িয়ে সাবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকারের ইস্যুতে অনড় মনোভাব নিতে পারে কেরলের সিপিএম সরকার, সেখানে লোকসভা ভোটের প্রচারে বাংলার সিপিএম নেতাদের কেন দোল উৎসবের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে, এই প্রশ্নই আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে!
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সিপিএম প্রার্থীদের দোল খেলার ছবি দেখতে দেখতে মাঝে-মধ্যেই ভেবেছি, এটা আমারই সেই বাংলা তো? এটা সেই সিপিএম পার্টিই তো? দক্ষিণ কলকাতা থেকে দমদম, বাঁকুড়া থেকে বারাকপুর একের পর এক কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থীদের দোল খেলার ছবি দেখে ভেবেছি, তাঁরা যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই দলই রেড রোডে দুর্গাপুজোর কার্নিভালের সমালোচনা করে তো?
জানি, প্রার্থীরা বলবেন জনসংযোগ! কিন্তু রাজ্য সিপিএমের ফেসবুক পেজ? সেখানেও তো দু’দিন ধরে দোলের ছবি! রঙের উৎসবের কোনও ছবিতে মন্দির, কোনও ছবিতে দলীয় প্রতীক কাস্তে, হাতুড়ি তারা। যদিও কেরল বা ত্রিপুরা সিপিএমের ফেসবুক পেজে দোলের ছবি বা দোলের শুভেচ্ছার কোনও পোস্ট নেই। তবে এরাজ্যের সিপিএমের ফেসবুক পেজে দোলের ছবির এই আধিক্য কেন?
তখনও রাজ্যে সিপিএম সরকার। যদিও বিদায়ের মুখে দাঁড়িয়ে, তবু বাম সরকার তো! তারাপীঠ মন্দিরে গিয়ে বিতর্ক তৈরি করলেন সুভাষ চক্রবর্তী। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘সুভাষের মাথা খারাপ হয়ে গেছে’। সুভাষ চক্রবর্তীর এই মন্দিরে যাওয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সিপিএম রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে। আজ তো রাজ্যে সিপিএমের নির্বাচনী প্রচারে দেখছি, চারদিকেই সুভাষ চক্রবর্তীর ‘অনুপ্রেরণা’। জানি না, জ্যোতি বসু বেঁচে থাকলে আজ কী বলতেন? জানি না, অসুস্থ হয়ে বাড়িতে বন্দি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কী ভাবছেন আজ। জানি না, পার্টি নেতা-নেত্রীদের এই দোল খেলা কত দূর পর্যন্ত অনুমোদন করে মুজফফর আহমেদ ভবন। শুধু জানি, হাতে শাখা পরে যে তরুণী কাস্তে-হাতুড়ির ছবি আঁকছেন দেওয়ালে বা জেলার যে স্থানীয় সিপিএম নেতা বাড়ির লক্ষ্মী পুজোর তদারকি করেন (কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন করলে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, আমি এর মধ্যে নেই, বাড়ির লোকের স্বাধীনতায় কীভাবে হস্তক্ষেপ করব) বা দলের যে শীর্ষ নেতা দোলের দিন আবির হাতে জনসংযোগে বেরিয়ে পড়েন, তাঁরা রাজ্যে ফের বাম সরকার ফেরাতে উদ্যোগী হতে পারেন ঠিকই, কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই করতে পারেন না। বিশ্বাস করি, নিজের জীবনে ধর্মীয় আচরণগুলোর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারলে আরএসএস পরিচালিত রাজনৈতিক পার্টির মোকাবিলা করার নৈতিকতা থাকে না কোনও।
মনে আছে দু’আড়াই বছর আগে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে এক দলীয় সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
বিষয় ছিল, দুনিয়াজুড়ে অতি ডানপন্থার আগ্রাসন। সেই সেমিনারে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সূর্যকান্ত মিশ্রকে দেওয়া হয়েছিল SOCIALIST REGISTER এর পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘THE POLITICS OF THE RIGHT’ বইটি। বইটি হাতে নিয়ে সূর্যকান্ত মিশ্র খুশি প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়েই অধ্যাপক আইজাজ আহমেদের একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম, INDIA: LIBERAL DEMOCRASY AND THE EXTREME RIGHT। যেখানে এক জায়গায় কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত অধ্যাপক আইজাজ লিখছেন, ‘There is of course the mass work by the RSS and its affiliates which have gained more and more adherents over some eighty years, in what Gramsci called the quotidian, molecular movements in the quality of mass perceptions at the very base of society – the creation of a ‘new common sense’. A majority of the liberals no longer know how much they themselves have moved toward the communal, neoliberal right’.
যথার্থই লিখেছেন আইজাজ আহমেদ। আজ সত্যিই আস্তে আস্তে এমন এক পরিবর্তনে সামিল হচ্ছেন অনেকে, যাঁরা নানান ধর্মীয় আচার-আচরণকেও জনসংযোগের মোড়কে পেশ করার জন্য নানান যুক্তি সাজিয়ে নিচ্ছেন নিজেরাই!
Comments are closed.