উত্তর প্রদেশে ভরাডুবি হতে চলেছে বিজেপির, মহাজোট ৪০-৫৫, বিজেপি ১৫-২৫, কংগ্রেস ৫-৯ আসন পেতে পারেঃ রিপোর্ট সিঙ্গাপুরের সংস্থার

রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে, রাজনীতির সেরা পরীক্ষাগারের নাম উত্তর প্রদেশ। ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশে মোদী ঝড়ের প্রভাবে ৮০ টি আসনের মধ্যে ৭৩ টি আসন জিতে নয়া ইতিহাস লিখেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। এবার জোট বেঁধেছেন অখিলেশ যাদব, মায়াবতী এবং অজিত সিংহ। ২০১৯ সালে ছয় দফা ভোটের পর একটা জিনিস পরিষ্কার, ১৪ সালের মোদী ঝড় এখন অনেকটাই ফিকে। সিঙ্গাপুরের Anthro.ai সংস্থা সম্প্রতি একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্ট তৈরি করেছে। উত্তর প্রদেশকে ধরে তৈরি করা সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে বিজেপির পক্ষে আশঙ্কার কতগুলি জায়গা। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, উত্তর প্রদেশে বিজেপি বিরোধী চোরাস্রোত আসলে ভূমিকম্পে পরিণত হয়েছে।
Anthro.ai এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, উত্তর প্রদেশে সপা-বসপা-আরএলডি জোট জিততে পারে ৪০ থেকে ৫৫ টি আসন। বিজেপির জেতার সম্ভাবনা রয়েছে ১৫ থেকে সর্বাধিক ২৫ টি আসন। কংগ্রেস জিততে পারে ৫ থেকে সর্বাধিক ৯ টি আসন। কীসের ভিত্তিতে Anthro.ai এর এই দাবি?

সোশ্যাল অ্যালায়েন্স

২০১৪ সালে অমিত শাহের মাস্টারস্ট্রোক ছিল নন-যাদব ওবিসি এবং নন-জাট দলিতদের এক ছাতার তলায় আনা। এই গোষ্ঠীর মানুষদের পার্টির পদে এবং প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে, এই অংশের মানুষের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। সপা-বসপা কিংবা কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তাই এই অংশের মানুষ সামাজিক সম্মান এবং আর্থিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য সরাসরি বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন। উচ্চবর্ণের একচেটিয়া ভোটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এই অংশের বিপুল সমর্থন, যা বিজেপিকে পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্যের এভারেস্টে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সরকারের ক্ষমতার ব্যাপক কেন্দ্রীভবনের প্রভাব এসে পড়ে নতুন বিজেপি সমর্থক এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর করার সিদ্ধান্তেও এই অংশের ভোটাররা রুষ্ট হন। কারণ, নিম্নবর্গের মানুষরা, যোগীর রাজনীতিতে মোটেও আস্থাশীল ছিলেন না। ফলে একটা সময়ের পর এই অংশের মানুষের বিজেপির প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি, উচ্চ বর্ণের মধ্যেও ঠাকুর সম্প্রদায়কে বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, এই অভিযোগ উঠতে থাকে। বিজেপি এই প্রশ্নেরও কোনও মীমাংসা করতে ব্যর্থ। ফলে বিজেপির ২০১৪ সালের সুপার হিট কৌশল ব্যাক ফায়ার করতে থাকে। এবার প্রার্থী বদলেও যার সুরাহা করতে পারেননি মোদী-অমিত শাহরা।

জাতপাতে ভোট-ভাগ

Anthro.ai এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, কুর্মি এবং কুশবাহা সম্প্রদায় এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজেপির পাশে নেই। কিন্তু তারা কি ভোটদানে বিরত থাকছেন? উত্তরটা হল, না। বিশাল সংখ্যায় ভোট দিচ্ছেন তারা, যে ভোট সরাসরি যাচ্ছে মহাগটবন্ধনের ঝুলিতে। এর প্রধান কারণ, এতদিন যে যাদব এবং দলিত পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মগ্ন থাকত, অখিলেশ-মায়াবতী জোট তৈরির পর তাঁরাই এবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন উত্তর প্রদেশের মাটিতে। নিশাদ সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিজেপি বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সব কিছুই হচ্ছে বুয়া-বাবুয়ার জোট ঘোষণার পর থেকে। যা রাতারাতি বদলে দিয়েছে উত্তর প্রদেশের জাতপাতের চিরাচরিত সমীকরণ।

অযোধ্যায় মন্দির কোথায়?

কেন্দ্রে ৫ বছর ধরে নিজেদের সরকার। রাজ্যেও ২ বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছে যোগী সরকার। কিন্তু মন্দির কোথায়? বিজেপি যতই আদালতের ধুয়ো দিক, মানুষের প্রশ্ন তোলা ঠেকানো যাচ্ছে না।

মহিলা

Anthro.ai এর রিপোর্টে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহিলারা। ৫ বছর আগে নরেন্দ্র মোদী আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির মহিলাদের কাছে ভোট চেয়েছিলেন। জাতপাতের ভেদাভেদ উড়িয়ে, মহিলারা ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন মোদীকে। রিপোর্ট বলছে, আচ্ছে দিনের কথা ভেবে মহিলারা মোদীকে ভোট দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নোটবন্দির পর তা ব্যুমেরাং হয়ে যায়। সংসারের টুকটাক খরচ চালানোর জন্য জমিয়ে রাখা টাকা রাতারাতি তামাদি হয়ে যাওয়ার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ইভিএমে, এমনটাই মত সংস্থাটির। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপার, বাড়ির মহিলাদের তহবিল থেকেই বাড়ির বয়স্ক গরু কিংবা বাতিল গবাদি পশুর দেখভাল হোত। একদিকে বাড়ির মহিলাদের তহবিল লুঠ, অন্যদিকে গরু নিয়ে বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতি, মহিলাদের বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করেছে বলে মনে করছেন Anthro.ai এর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মহিলারা নিজেরা কম খেয়ে, নিজেদের জন্য নামমাত্র খরচ করে এই তহবিল তৈরি করতেন সংসারের প্রয়োজনের কথা ভেবে। যা ছিনিয়ে নেওয়ার দায় এবার বর্তাবে সরাসরি বিজেপির উপর। এই প্রবল ক্ষোভ প্রশমনের একমাত্র উপায় ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু বিজেপি তাতেও চরম ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করেন উত্তর প্রদেশের মহিলা সমাজ। তাঁরা বলছেন, আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখানো মোদী সরকার আজও বিজলি-পানি-সড়কের সমস্যারই সমাধান করতে পারেনি। বরং বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়েছে। বিজেপির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মনোভাব কাজ করছে উত্তর প্রদেশ জুড়ে।
Anthro.ai এর রিপোর্ট বলছে, সরাসরি তাঁদের তহবিলে হাত পড়া কিংবা জীবন ধারণ করা ক্রমশ কঠিন হওয়া, কোনও ক্ষেত্রেই একটি টু শব্দও করেননি মহিলারা। তাহলে কি তাঁরা সব কিছু মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন? পাঁচ দফা ভোটের পর প্রকাশিত এই রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহিলারা দল বেঁধে জবাব নথিভুক্ত করছেন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে। যা বিজেপির পক্ষে আদৌ ভালো লক্ষণ নয়।

(প্রচ্ছদে উত্তর প্রদেশের ম্যাপের ছবি Anthro.ai এর থেকে নেওয়া)

(পড়ুন Anthro.ai এ প্রকাশিত রিপোর্টঃ The Undercurrent Is An Earthquake)

Comments are closed.