কে কাকে টেক্কা দেবে? শহর কলকাতার কয়েকটি প্রাচীন এবং জনপ্রিয় মিষ্টির দোকান |
কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু মিষ্টির সঙ্গে বাঙালি জাতির সম্পর্কও সমান মধুর। শেষপাতে হোক বা প্রাতঃরাশ, রসগোল্লা, সন্দেশ, রাবড়ির সঙ্গে বাঙালি রসনার সম্পর্ক ও আবেগের কথা ব্যাখ্যাতীত। কলকাতার এমনই কিছু মিষ্টির দোকান আছে যাদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহু বছরের। যাঁরা মিষ্টিপ্রিয়, অথচ এই দোকানগুলিতে এখনও ঢুঁ মারেননি, তাঁদের অন্তত একবার এই দোকানগুলি থেকে মিষ্টিমুখ করা উচিত।
বলরাম ও রাধারমণ মল্লিক
এই মিষ্টির দোকানটির পথ চলা শুরু ১৮৮৫ সালে। ওই বছরেই তৎকালীন বোম্বেতে বসেছিল কংগ্রেসের অধিবেশন। সেখানেই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। কংগ্রেস আর এই মিষ্টির দোকান প্রায় একই বয়সি। বছরের পর বছর চিরাচরিত মিষ্টি থেকে নতুন নতুন মিষ্টি পরিবেশন করে বাঙালির রসনা তৃপ্তি করে আসছে বলরাম ও রাধারমণ মল্লিক। এখানকার সব মিষ্টিই ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে ‘ফিউশন’ মিষ্টি, বিশেষ করে চকোলেটের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি, জলভরা সন্দেশ, আম সন্দেশের জন্য প্রবল জনপ্রিয় ২, পদ্মপুকুর রোড, ভবানীপুরের এই দোকানটি। এ ছাড়াও কসবা, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, বালিগঞ্জ, নিউ আলিপুর, পার্ক স্ট্রিটেও রয়েছে বলরাম ও রাধারমণ মল্লিকের শাখা।
কে সি দাস
এই দোকানের নাম নিয়ে নতুন কিছুই বলার নেই। মিষ্টির দুনিয়ায় বিপ্লব এসেছে কে সি দাসের হাত ধরেই। ১৮৬৬ সাল থেকে বিভিন্ন রকম ও স্বাদের রসগোল্লার জন্য বিখ্যাত ১১ এ, এসপ্লানেড ইস্টের এই দোকানটি। রসগোল্লা ছাড়াও নলেন গুড়ের বিশেষ রোল, গুলাব জামুন, ল্যাংচা, রসমালাই, ক্ষীরকদমের জন্য দশকের পর দশক বাঙালির কাছে প্রিয় মিষ্টির দোকান কে সি দাস। সেই সুনামের উপর ভর করেই আজ কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন রাজ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে কে সি দাসের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। তারাই টিনড রসগোল্লার উদ্ভাবক। তাদের দেখাদেখি এখন অনেকেই টিনড রসগোল্লা রাখে।
ভীম চন্দ্র নাগ
উনিশ শতকে কলকাতার মিষ্টিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল বৌবাজারের এই মিষ্টির দোকানটি। ১৮২৬ সালে হুগলির বাসিন্দা পরাণ চন্দ্র নাগ এই দোকানের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পুত্র ভীম নাগের হাত ধরে এই মিষ্টি দোকানটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছয়। প্রসিদ্ধির কারণ ভীমচন্দ্র নাগের মনোহরা ও সন্দেশ। তবে ব্রিটিশ আমলে ভারতের গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংয়ের নামে একটি যুগান্তকারী মিষ্টি তৈরি করে ফেলেন ভীম চন্দ্র নাগ, নাম ‘লেডি কেনি’। কখন ও কোন প্রেক্ষিতে লেডি ক্যানিংয়ের নামে এই মিষ্টির নামকরণ হল তা নিয়ে ইতিহাসে অনেক গল্প আছে। ছানা ও ময়দা দিয়ে তৈরি এবং চিনির তরল রসে ভেজানো লালচে-বাদামী রঙের গোলাকার ‘লেডিকেনি’র আবির্ভাব ঘটে ভীম চন্দ্র নাগের হাত ধরে। বৌবাজার মার্কেটের ঢিল ছোড়া দূরত্বে ৫, নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের ভীম চন্দ্র নাগের আইসক্রিম সন্দেশ, রোজ ক্রিম সন্দেশ , পেস্তা সন্দেশও ব্যাপক জনপ্রিয়। তা ছাড়া ভীম নাগের স্পেশাল ‘আবার খাবো সন্দেশ’ ও আমদই চেখে দেখতেই হবে।
নবকৃষ্ণ গুঁই
বউবাজারের আরও একটি প্রাচীন ও বিখ্যাত মিষ্টির প্রতিষ্ঠানের নাম নবকৃষ্ণ গুঁই। শহর কলকাতার খাবারের দোকানের ইতিহাসের কথা তুললে এই মিষ্টি দোকানটির নাম না করলেই নয়। নানা স্বাদের ট্র্যাডিশনাল বাঙালি মিষ্টি এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফিউশন মিষ্টির দীর্ঘ তালিকা রয়েছে নবকৃষ্ণ গুঁইয়ে। বউবাজার এলাকার ৯ বি, নির্মল চন্দ স্ট্রিটের এই দোকানটির রোজ ক্রিম সন্দেশ এবং চন্দন ক্ষীরের স্বাদ ভোলার নয়। মিষ্টিপ্রিয় হলে আপনার অবশ্যই পরখ করা উচিত নবকৃষ্ণ গুঁই-র বিভিন্ন রকমের সন্দেশ।
গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী
পুরনো কলকাতার প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকানের মধ্যে অন্যতম হল হেদুয়ার কাছে ৫৬, রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে অবস্থিত গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী। মহেশ চন্দ্র দে-র হাত ধরে ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই দোকানটি। পরে মহেশ চন্দ্রের পুত্র গিরিশ চন্দ্র দে এবং তার জামাতা নকুড় চন্দ্র নন্দীর হাত ধরে কলকাতার সেরা মিষ্টি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম ঠিকানা হয়ে ওঠে গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুর চন্দ্র নন্দী। ১৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই দোকানের মিষ্টির সুনাম এতটুকুও পড়েনি। এখানকার মিষ্টির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হল মান ও স্বাদ ধরে রাখা। এখানকার নলেন গুড়ের সন্দেশ, কালাকাঁদ, রসমালাই, মিষ্টি দই, সৌরভ সন্দেশ, চকোলেট সন্দেশের মধ্যে চকো তুফান, চকোলেট মালাই রোলের গুণমুগ্ধের সংখ্যা বিশাল। তা ছাড়া এখানকার ছানার সন্দেশ এবং জলভরা সন্দেশও অবশ্যই চেখে দেখার মতো।
সেন মহাশয়
বাঙালির চিরাচরিত কিছু মিষ্টি যেমন মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ, দরবেশ, সন্দেশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কলকাতার সেরা ঠিকানা শ্যামবাজারের ১/১ শিবদাস ভাদুড়ি স্ট্রিটের সেন মহাশয়। ১৮৬৬ সালে আশুতোষ সেন এই দোকানটি তৈরি করেন। শ্যামবাজার ছাড়াও পরে লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট, সল্টলেক সেক্টর ওয়ান এবং ভবানীপুরেও সেন মহাশয়ের প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে পড়ে। মিহিদানা, সীতাভোগ ছাড়াও সেন মহাশয়ের মালাই চপের কথা উল্লেখ করতেই হয়।
কামধেনু
কলকাতার বহু পুরনো মিষ্টি দোকানগুলির তুলনায় কামধেনু অনেক পরে এসেও মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির কাছে নিজের দর আদায় করে নিয়েছে। কামধেনুর কাঁচা গোল্লা বিখ্যাত। ১৯৯৫ সাল নাগাদ কামধেনু মিষ্টি দোকানটির পথ চলা শুরু। জনপ্রিয়তার সঙ্গে দিনে দিনে কলেবরে বেড়েছে কামধেনু। যাদবপুর স্টেশন রোড ছাড়াও গড়িয়া, নেতাজিনগর এবং ব্রহ্মসমাজ রোডেও রয়েছে কামধেনুর শাখা। এখানকার কাঁচাগোল্লা, আম সন্দেশ এবং কাজু পেস্তা সন্দেশ চেখে দেখা মাস্ট! তাছাড়া rpt-প্রচুর রকমের মিষ্টি রয়েছে কামধেনুর শো-কেসে।
শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
কলকাতার প্রাচীন মিষ্টির দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ১৯১২ সালে তৈরি হওয়া এই মিষ্টি দোকানটির ল্যাংচা ও রাধাবল্লভীর স্বাদ অপূর্ব! অন্যান্য মিষ্টির মধ্যে মিষ্টি দইও চেখে দেখতে পারেন। হলফ করে বলা যায় ভালো লাগবেই। ভবানীপুরের এস পি মুখার্জি রোডের এই মিষ্টি দোকানটির নাম প্রথম দশে না থাকলেই নয়।
বাঞ্ছারাম
বেকড রসগোল্লার নাম বললে বাঙালি তো বটেই অনেক অবাঙালি মিষ্টিভক্তের জিভে জল আসতে বাধ্য। আর সুস্বাদু বেকড রসগোল্লা খাওয়ার সেরা মিষ্টির দোকান হল বাঞ্ছারাম। ১৯৭৬ সালে বালিগঞ্জ গার্ডেনসে তৈরি হওয়া বাঞ্ছারামের নানা মিষ্টির মধ্যে বেকড রসগোল্লা আর মিহিদানা পরখ করে দেখতেই হবে। তাছাড়া মিষ্টি দই-র নাম না নিলে নয়।
চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
১৯০৭ সালে হীরালাল ঘোষের হাত ধরে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পথ চলা শুরু হয়। ৩৪ বি, শোভাবাজার স্ট্রিটের চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার চাহিদা এখনও একইরকম ঊর্ধমুখী। তাছাড়াও এখানকার চকোলেট সন্দেশ, মালাই চমচম, গুলাব জামুন, মিষ্টি দইর নাম রয়েছে। কারও কারও মত, এই মুহূর্তে কলকাতার সেরা রসগোল্লা যেসব দোকানে পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রথমে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
Comments are closed.