সিপিএমের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক পুলিন বিহারী বাস্কের বিরুদ্ধে আলিমুদ্দিনে জমা পড়ল একগুচ্ছ অভিযোগ।

একদা মাওবাদী অধ্যুষিত, সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী মানুষের জেলা ঝাড়গ্রামের সিপিএম সম্পাদকের নামে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে জমা পড়ল একগুচ্ছ অভিযোগ। বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনি, গোপীবল্লভপুরসহ একাধিক এলাকার সিপিএমের নেতা জেলা সম্পাদক পুলিন বিহারী বাস্কের নামে সরাসরি অভিযোগ জানিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কাছে।
ঝাড়গ্রাম জেলায় কেন সিপিএমের চূড়ান্ত নির্বাচনী বিপর্যয় হয়েছে, কেন গরিব আদিবাসী মানুষ পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমকে বাদ দিয়ে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন তা নিয়ে সিরিয়াস পর্যালোচনা শুরু করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ১১ জুন সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিমান বসু উপস্থিতও ছিলেন ঝাড়গ্রাম সিপিএমের জেলা কমিটির মিটিংয়ে। সেখানে তাঁদের সামনেই একাধিক জেলা কমিটির সদস্য সরাসরি জেলা সম্পাদকের নামে যে অভিযোগ করেছেন তাতে হতচকিত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারাও।
পুলিন বিহারী বাস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ একাধিক। প্রথম এবং গুরুতর অভিযোগ, তিনি ঝাড়গ্রাম জেলায় বিন্দুমাত্র সময় দেন না। জেলায় থাকেনও না। মেদিনীপুর শহরে থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা চালাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত নিজে তফশিলী উপজাতি সম্প্রদায়ের হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসী মানুষের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই পুলিন বিহারী বাস্কের। আদিবাসী মানুষ বা সমাজ তাঁকে নিজেদের লোক বলেও মনে করেন না।
তৃতীয়ত, জীবনে কোনও দিন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না থাকা বাস্কে কীভাবে জেলার প্রায় ভেঙে পড়া সংগঠনকে দাঁড় করাবেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

ঝাড়গ্রামে সিপিএম পার্টি অফিস

যে জঙ্গলমহলে একদা সিপিএম ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ কিংবা কখনও তারও বেশি ভোট পেয়েছে, সেখানে এবার পঞ্চায়েতে সিপিএম পেয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ ভোট। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনেও যেখানে ২০ শতাংশের বেশি ভোট ছিল সেখানে কেন তাঁরা অস্তিস্বহীন হওয়ার পথে সেই প্রশ্ন খুঁজতেই দলের রাজ্য সম্পাদক এবং বিমান বসু সম্প্রতি গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামে।
কিন্তু সেখানে খোদ জেলা সম্পাদকের সামনেই তাঁর বিরুদ্ধে যেভাবে লাগাতার অভিযোগ করা হয়েছে, তাতে রীতিমতো অস্বস্তিতে সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিমান বসু। এর পরে পুলিন বিহারী বাস্কে কীভাবে কর্তৃত্ব নিয়ে এই জেলা চালাবেন সেই প্রশ্নও চিন্তায় ফেলেছে তাঁদের। পুরো বিষয়টি তাঁরা দেখবেন বলে জেলা কমিটির মিটিংয়েই আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক। কিন্তু ঝাড়গ্রামের নেতারা যেভাবে দলের জেলা সম্পাদকের ওপরেই আস্থা রাখতে পারছেন না, তাতে তিনি কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করবেন তা ভেবে দুশ্চিন্তায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
গত বছর জুন মাসে ঝাড়গ্রাম জেলা তৈরি হয়। ৮ টি ব্লক নিয়ে গঠিত এই জেলায় সিপিএমের প্রথম সম্পাদক হয়েছিলেন ডহরেশ্বর সেন। তারপর ডিসেম্বর মাসে পুলিন বিহারী বাস্কেকে জেলা সম্পাদক করা হয়। মে মাসের পঞ্চায়েত ভোটে গোটা রাজ্যেই শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রচুর সন্ত্রাসের অভিযোগ করে সিপিএম। কিন্তু সেই অভিযোগ তুলনামূলকভাবে জঙ্গলমহলে অনেক কম ছিল। এটা শুধু এবারই নয়, ২০১১ সালের পর যত ভোট হয়েছে, ঝাড়গ্রামে অন্তত পরাজয়ের জন্য কখনই সন্ত্রাসকে প্রধান কারণ হিসেবে খাঁড়া করেনি আলিমুদ্দিন। বরং সিপিএমের ব্যাখ্যা ছিল, ২০১১ সালের পর এলাকায় খুন-জখম বন্ধ হওয়া মানুষের মধ্যে তৃণমূল সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কিন্তু সেই জঙ্গলমহলে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে সম্প্রতি। আলিমুদ্দিনের নেতারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, এবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে জঙ্গলমহলে বিভিন্ন এলাকায় মানুষজন এবং আদিবাসী সমাজ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেখানে সিপিএমকে তাঁরা কোনওভাবেই জায়গা ছাড়তে রাজি হননি। কেন আদিবাসী মানুষ সিপিএমকে ভরসা করছেন না তাও জানতে চাইছিলেন আলিমুদ্দিনের নেতারা।
সূত্রের খবর, ঝাড়গ্রামে জেলা কমিটির মিটিংয়ে গোপীবল্লভপুরের নোটন মল্লিক, বিনপুরের ঐক্য নামাতা, বেলপাহাড়ির ধর্মদাস সর্দার, জামবনির মানিক শতপথীসহ জেলার বিভিন্ন ব্লকের একাধিক সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিমান বসুর সামনেই অভিযোগ করেন পুলিন বিহারী বাস্কের বিরুদ্ধে। তাঁদের মূল অভিযোগ, ঝাড়গ্রাম জেলায় থাকেনই না পুলিনবিহারী বাস্কে। থাকেন মেদিনীপুর শহরে। সপ্তাহে এক দিন আসেন। কোনও দিন রাতে থাকেন, কোনও দিন আবার ফিরে যান মেদিনীপুরে। সম্পাদক নিজে জেলায় না থাকলে সেখানকার সাধারণ কাজকর্ম কীভাবে চালাবেন? তাছাড়া জঙ্গলমহলের আদিবাসী এলাকায়ও জেলা সম্পাদক খুব একটা যান না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগই নেই। আদিবাসী সমাজ থেকেও তিনি কিছু ব্যক্তিগত কারণে একেবারেই বিচ্ছিন্ন বলে জোরালো আলোচনা আছে ঝাড়গ্রামে। যার ফলে তাঁর পক্ষে আদিবাসীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা করাও সহজ নয়। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও বাস্কে নিজে মিটিংয়ে কিছুই বলেননি বিশেষ। তাঁর বিরুদ্ধে জেলার নেতাদেরই করা অভিযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য পুলিনবিহারী বাস্কেকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘পুরো ব্যাপারটাই পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়, সাংগঠনিক বিষয়। এ নিয়ে আমি কিছু বলব না’।
সুত্রের খবর, বিভিন্ন কারণে গত কয়েক মাস ধরে রীতিমতো আর্থিক সমস্যায় ভুগছে ঝাড়গ্রাম জেলা পার্টি। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে জেলা সম্পাদককে নিয়ে পার্টি নেতৃত্বের একটা বড় অংশের অনাস্থা। সব মিলে লোকসভা ভোটের আগে জঙ্গলমহলের জেলা নিয়ে জর্জরিত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।

Leave A Reply

Your email address will not be published.