শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, রোজ কাক ভরে উঠে তোড়জোড় শুরু করে দেন সঞ্জয় দুবে। ভোর চারটে থেকে ফুড স্টলের কাজ শুরু করেন, বেলা বাড়লেই শুরু হয় বিক্রি-বাট্টা। চলে সেই মাঝরাত পর্যন্ত। পরের দিন ফের ভোর ৪টে। আর এই পুরো সময়টা সঞ্জয় দুবে কাজ করেন এক পায়ে ভর দিয়ে। দিল্লির ভগবান নগর এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে সঞ্জয় এবং তাঁর ছোট্ট পিৎজা-পাস্তার স্টল।
দীর্ঘ ৬ বছর ধরে ইন্দো-ইতালিয়ান স্ট্রিট ফুড স্টল চালাচ্ছেন সঞ্জয় দুবে। তাঁর তৈরি পিৎজা-পাস্তা যেমন জনপ্ৰিয়, একই ভাবে তাঁর জীবন-সংগ্রামও অনুপ্রাণিত করে অনেককে। সম্প্রতি নেট পাড়ায় সঞ্জয়ের ‘গল্প’ ছড়িয়ে পড়েছে। যা পড়ে দিল্লির এই খাওয়ার বিক্রিতাকে কুর্ণিশ জানাচ্ছেন অনেকে।
ভারতবর্ষের আর পাঁচটা প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলের মতোই ছিল সঞ্জয়ের জীবনও যা শুরু হয়েছিল বড় শহরে কাজের সন্ধানে এসে। উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড় নামে একটি গ্রামে সঞ্জয়ের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এরপর ১৯৯৮ সালে রোজগারের খোঁজে দিল্লি আসেন তিনি। একটি কন্টেনার কর্পোরেশনে ক্লিয়ারিং এজেন্ট-এর কাজও জুটিয়ে ফেলেন। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রথম চাকরি পাওয়ার পর ভেবেছিলেন জীবনটা এবার হয়তো কিছুটা সহজ হবে। মাসে ৮ হাজার টাকা বেতনে ‘হেসে-খেলে’ চলেও যাচ্চিল তাঁর।
কিন্তু ২০১৪ সালের একটা রোড এক্সিডেন্ট সবকিছু ওলটপালট করে দিল। তাঁর কথায়, জীবন এমন একটা বাঁকে এসে থামল যে, আমি হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। এক কথায় আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন?
দিল্লি থেকে বাইকে করে গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন সঞ্জয়। সে সময় এমন একটি রাস্তা দিয়ে সঞ্জয় বাইক চালাচ্ছিলেন যেখানে কার্যত কোনও স্ট্রিট লাইট ছিল না। উল্টো দিকে থেকে একটি ট্রাক আসছিল, যার হেডলাইট বন্ধ ছিল। সঞ্জয় জানান, সে সময় আমি ওটাকে ছোটো কোনও গাড়ি ভেবেছিলাম। যথারীতি মুখোমুখি ধাক্কা এবং তারপর আর কিছু মনে নেই । বললেন, চণ্ডীগড় পিজিআই হাসপাতালে আমায় ভর্তি করা হয়। প্রায় ১ বছর সেখানে থেকে প্রাণে বাঁচলেও একটা পা হারাতে হল।
পা’য়ের সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জয়কে পুরোনো চাকরিটাও হারাতে হয়। তাঁর কথায়, আমি কী করব, কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না। প্রায় সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছিল, পরিবারকে এবং নিজেকে বাঁচাতে হলে আমার একটা কাজের দরকার। হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে আরও একবার ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। একটি খাওয়ারের দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা করেই পিৎজা, পাস্তা, স্যান্ডউইচ তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কোর্স ভর্তি হন সঞ্জয়। সেখানে প্রায় ৬ মাস ট্রেনিং নেন। তাঁর কথায়, ওখানে পুরো কাজটাই ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। প্রথম প্রথম এক পা নিয়ে খুব কষ্ট হত। কিন্তু আমার যে আর অন্য কোনও উপায়ও ছিল না।
২০১৬ সালে নিজের জমানো ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি পিৎজা, পাস্তার স্টল দেন সঞ্জয়। খুব অল্প দিনের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে থাকেন। তাঁর কথায়, আস্তে আস্তে যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম, তিল তিল করে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছি, তখনই দেশজুড়ে শুরু হল লোকডাউন। মাথায় যেন আবার আকাশ ভেঙে পড়ল। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফের সেই গ্রামে ফিরে যেতে হল।
কিন্তু এত কিছুর পরও সঞ্জয় থেমে থাকেননি। লোকডাউন মিটতেই নিজের পুঁজি এবং পরিচিতদের কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়ে ৫০ টাকা পুঁজি সম্বল করে ফের ব্যবসায় ঝাঁপ দেন। বর্তমান দিল্লির ভগবান নগর এলাকায় সঞ্জয়ের মতোই বিখ্যাত তাঁর ফুড স্টলও। রোজই সকাল থেকে অসংখ্য মানুষ তাঁর স্টলের সামনে ভিড় জমান। ইন্দো-ইতালিয়ান খাওয়ারের সাথে সঞ্জয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও শক্তি যোগায় তাঁর ক্রেতাদের।
Comments are closed.