জ্যোতিবাবু বারবার বলেছিলেন, পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে আস্থা ভোটে বিজেপির সঙ্গে মিলে ভোটাভুটিতে না যেতে। এতে ভুল বার্তা যাবে

আগের পর্বেই লিখেছি, ২০০৬ সালের পর এক নেতাকে কীভাবে একই সঙ্গে রাজ্য কমিটি এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। আলিমুদ্দিনের পছন্দের ওই নেতাকে কমিটিতে জায়গা করিয়ে দিতে এক বর্ষীয়ান সদস্যকে সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদত্যাগও করানো হয়। এর পরে কলকাতার লাগোয়া একটি জেলার সিপিএম সম্পাদক প্রয়াত হন। তারপর সেই জেলার পার্টি নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই সংখ্যালঘু নেতা এবং রাজ্যের মন্ত্রী পার্টির রাজ্য কমিটির দীর্ঘদিনের সদস্যও ছিলেন। কিন্তু রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দ না হওয়ায়, জেলা সম্পাদকের পদে তাঁর জায়গা হল না। এই নেতার ক্ষেত্রে এরপর একাধিকবার জেলা পার্টির তরফে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, নানা অজুহাতে তা খারিজ করে দেওয়া হয়। আসলে এর একটি অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল। তা হল, কলকাতা বা লাগোয়া জেলার সম্পাদকরা সাধারণভাবে পদাধিকারবলে সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার সযোগ পান। তাই ওই অপছন্দের নেতা যদি জেলা সম্পাদক হয়ে যান, তবে তো আগামী দিনে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে চলে আসবেন! তা যাতে হতে না পারে তার জন্যই অন্য ব্যবস্থা নিয়ে রাখা। এই সবই ২০০৬ সালের পর পার্টিতে ঘটতে থাকে।
অন্যদিকে, রাজ্যে আমলাতন্ত্রের বাড়বাড়ন্তসহ, প্রশাসনের কয়েকটি দফতর নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তখন বাড়ছে। পুলিশ-প্রশাসনের কাজকর্ম মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছে। ২০০৮ সালে দলের রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে বলার সময় বেশিরভাগ জেলার প্রতিনিধি পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে রাজ্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। রাজ্য প্রশাসন নিয়ে এই আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে সম্মেলনে যা বলা হল, তা তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো। বলা হল, রাজ্যে আসলে আমলাতন্ত্রের কোনও বাড়াবাড়িই নাকি নেই! সেই সময়ে দলের রাজ্য সম্পাদকও তাঁর জবাবি ভাষণে, সরকারের এই বক্তব্যকেই মান্যতা দিলেন। জেলা প্রতিনিধিদের সমালোচনা কোনও গুরুত্বই পেল না। অথচ সে সময় পশ্চিম মেদিনীপুরে মাওবাদী তৎপরতা প্রতিদিন বাড়ছে। আর মাওবাদীদের এই তৎপরতাকে পরিকল্পনা করে প্রচারমাধ্যম প্রচার করছে, কেবলমাত্র অনুন্নয়নের জন্যই নাকি মাওবাদীদের এই তৎপরতা। একথা যে সম্পূর্ণ নয় আংশিক সত্য, দলের মধ্যে বলার চেষ্টা হলেও তা গুরুত্ব পায়নি। রাজ্যে বামপন্থী শক্তিকে দুর্বল করা, বামফ্রন্ট সরকারকে হঠানোর জন্য একটি বড় পরিকল্পনারই অংশ ছিল এসব।
জঙ্গল এলাকা তখন বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। একে ভাঙার জন্য তথাকথিত মাওবাদীদের কাজে লাগানো হচ্ছিল। এলাকার দলীয় নেতাদের বক্তব্য তখন রাজ্য পার্টি বা প্রশাসনের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বরং ‘এলাকায় কোনও উন্নয়নই হয়নি’, বিরোধীদের এই প্রচারই যেহেতু সর্বাধিক গুরুত্ব পেল, তাই উন্নয়নের জন্য রাজ্য প্রশাসন অনেক টাকাই বরাদ্দ করল। কিন্তু টাকা সরাসরি জেলা শাসকদের দেওয়া হল। না, নির্বাচিত জেলা পরিষদকে নয়। তাদের নাকি উন্নয়ন করার যথাযথ যোগ্যতার অভাব। নীচের তলায় নাকি ব্যাপক দুর্নীতি, সেই জন্যই এই অনুন্নয়ন। রাজ্যের বিরোধীদের অভিযোগকেই মান্যতা দিয়ে বসল রাজ্য প্রশাসন। এক্ষেত্রে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারলাম না। ২০০৭ সালের পর এই উন্নয়নের প্রশ্ন ঘিরে রাজ্য পার্টির দফতরে পার্টিগতভাবে এক সভা ডাকা হয়েছিল। সেই সভায় পার্টির সব জেলার সম্পাদক, জেলা সভাধিপতি ও রাজ্য প্রশাসনের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত দফতরের মন্ত্রীদের ডাকা হয়েছিল। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সব সদস্য। অথচ যে পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাজ্য পার্টির এই জরুরি সভা, সেই সভায় পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের ভারপ্রাপ্ত দফতরের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ডাকা হল না। আমার অপরাধ, আমি অপছন্দের তালিকায়। তাই এই সভায় আমার থাকার অধিকার নেই। শুধু কী এই! আরও আছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সার্কিট হাউসে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশেষ সভা হবে। সেই সভায় উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত দফতরের মন্ত্রী, তিন জেলা শাসক, পুলিশ সুপার, জেলা সভাধিপতি, এসডিও এমনকী বিডিও’দের পর্যন্ত ডাকা হল। অথচ আমি এই জেলার মন্ত্রী, পশ্চিম মেদিনীপুরের মানুষ, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী, তবুও মুখ্যমন্ত্রীর সেই সভাতে আমার জায়গা হল না। জেলার উন্নয়ন নিয়ে যে মিটিংয়ে এসডিও, বিডিও’কে ডাকা হয়, অথচ পশ্চিমাঞ্চল দফতরের মন্ত্রী হয়েও সেখানে আমায় ডাকা হয় না। এর ব্যাখ্যা কী? এর জবাব দেওয়ার দায়িত্ব বা ক্ষমতা যাঁদের, তাঁরাই এর উত্তর দিতে পারবেন। আমি পারব না। তবে বুঝেছিলাম, আমাকে অনুপস্থিত রেখে প্রশাসনকে পরোক্ষভাবে বার্তা দেওয়া হল, রাজ্য প্রশাসনে, রাজ্য উন্নয়নে সুশান্ত ঘোষ ব্রাত্য। এসব নিয়ে আমি যে জেলার সঙ্গে যুক্ত তার জেলা সম্পাদককে প্রশ্ন করেছিলাম। আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিয়ে তিনি বলেছিলেন, রাজ্যে নেতৃত্বের সঙ্গে এবিষয়ে তিনি কথা বলবেন। কী কথা বলেছিলেন, তা কোনও দিন আমার জানার সুযোগ হয়নি।
আসলে নির্বাচিত পঞ্চায়েতকে বাদ দিয়ে জেলা শাসকদের মারফত উন্নয়নের যে টাকা খরচ করা হচ্ছে তা কি যথাযথ, তা নিয়ে জেলা সংগঠনের একটি সভায় আমি সরকারের তির্যক সমালোচনা করেছিলাম। সেটাই হয়তো আমার অযোগ্যতার কারণ। আমি কী সমালোচনা করেছিলাম তার বিস্তারিত বিবরণ লিখব না। শুধু একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করব, তাতে উন্নয়নের নমুনা বুঝতে সুবিধা হবে। জঙ্গলমহলের অনেক গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছোতে বাকি। তাই উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা পেয়ে জেলাশাসকরা সে সব গ্রামে বিদ্যুতায়নের একটা সহজ উপায় বের করে ফেললেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তড়িঘড়ি বড়বড় জেনারেটর কেনা হয়ে গেল। এর জন্য তেল ও লোকের ব্যবস্থা করা হয়ে গেল। এটা নাকি বিদ্যুতায়ন! ধারাবাহিকভাবে যখন তেলের টাকা, জেনারেটর রক্ষণাবেক্ষনের খরচ, যে এটা চালাচ্ছে, তাকে কর্মচারী হিসাবে রাখার দায়িত্ব এসে পড়বে, তখন কী হবে? এটাই ছিল আমার সমালোচনার বিষয়। আমাদের রাজ্যের যে উন্নয়ন, উন্নয়নে নিবেদিত যে পঞ্চায়েতের ঐতিহাসিক ভূমিকা সারা দেশে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল, যে উন্নয়নের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি পর্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন, সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা কি সঠিক ভূমিকা নিলাম? না এরও কোনও মূল্যায়ন করা হয়নি। একটা মূল্যায়ন অবশ্য হয়েছিল। তৎকালীন পঞ্চায়েতমন্ত্রীর কাছ থেকে (তিনি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন) পঞ্চায়েত দফতর নিয়ে অন্য আর একজনকে পঞ্চায়েত দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ততদিনে অবশ্য রাজ্যের এক আমলাকে পঞ্চায়েত দফতরের ডিফ্যাক্টো মন্ত্রী হিসাবে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন রাজ্যের মানুষ।
সংগঠন ও প্রশাসন দুই ক্ষেত্রেই তখন দ্রুত অবক্ষয় হচ্ছে। এর মধ্যেই রাজনৈতিক প্রশ্ন ঘিরে সংগঠনের মধ্যে সংকট ঘনীভূত হল। পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের মতো চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। পরমাণু চুক্তির মতো এমন একটি বিষয়, যা খায়, না মাথায় দিয়ে ঘুমোয়, তার জন্য এমন সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছিল? সেদিনের সেই নেতারা আজও আছেন, তাঁরা এর কী ব্যাখ্যা দেবেন জানি না। তবে একথা বললে ভুল হবে না যে, আজ আমাদের সংগঠনের কোনও স্তরের কোনও নেতাই এই ‘ভয়ঙ্কর’ পরমাণু চুক্তি নিয়ে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। সাধারণ মানুষের এবিষয়ে কোনও দিন কোনও মাথা ব্যথাই ছিল না। আজও নেই। এই চুক্তির মতো একটি নন ইস্যুকে ইস্যু করে ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারে সংগঠন কতখানি লাভবান হল, তার মূল্যায়ন আজও হয়নি। তাঁরা ইউপিএ সরকার থেকে শুধু সমর্থন প্রত্যাহার নয়, সে সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য বিজেপি’র সঙ্গে ভোট দিতেও দ্বিধা করলেন না। তখনও জ্যোতি বসু জীবিত। তিনি খুব দৃঢ়ভাবে সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে যেতে নিষেধ করেছিলেন দলকে। তিনি খুব পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে, ‘পরমাণু চুক্তির অবশ্যই বিরোধিতা করবে, তবে বিষয়টি জটিল, মানুষের কাছে সাধারণভাবে সবটা বোধগম্য নয়। পার্টিকে মানুষের কাছে এটা নিয়ে যেতে হবে। লোকসভা থেকে ওয়াক আউট করবে। কিন্তু বাম-বিজেপি একই সঙ্গে সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য ভোট দিচ্ছে, এটা আমাদের সংগঠনের জন্য মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। গোটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে। এটা কখনও করতে যেও না।’ না, জ্যোতি বসুর মতো নেতার কথাকেও তাঁরা সেদিন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। তাঁরা কি পার্টি সংগঠনের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করলেন, নাকি পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের ইচ্ছাপূরণেরই ব্যবস্থা করলেন, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
যখন এই প্রশ্ন নিয়ে গোটা দেশেই আলোড়ন চলছে, তার মধ্যে ৮ জুলাই ২০০৮ লোকসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ হয়েছে। ২২ জুলাই সরকার লোকসভায় অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হবে। দিল্লির সরকার থাকবে না পড়বে? তা নিয়ে উত্তেজনা চরমে। দিল্লি থেকে সরকারের বিশেষ দূত হয়ে ইন্দিরা ভবনে যে মানুষটি জ্যোতি বসুর কাছে দৌড়ে এসেছিলেন, তাঁর কাছ থেকেই পরে এবিষয় অনেকটা জানার সুযোগ হয় আমার। এমনকী তিনি এও বলেন, তাঁর উপস্থিতিতেই জ্যোতি বসু তৎকালীন পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোনে বিজেপির সঙ্গে ভোটাভুটিতে না যেতে বলেছিলেন।
এই সময়ই পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ না করে সেদিনের লোকসভার স্পিকার বলেছিলেন, অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ দেওয়া হয়ে গেছে। আমি এসময় অধ্যক্ষ হিসাবে পদত্যাগ করতে পারি না। এতে সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক গরিমা খর্ব হবে। এই ভোটাভুটি পর্ব শেষ হলে আমি অধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করব। জ্যোতি বসুও এই যুক্তির সঙ্গে সহমত ছিলেন। না, এ কথাকেও মান্যতা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি সেদিনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতারা। দলীয় সিদ্ধান্ত না মানার দায়ে লোকসভার স্পিকারের মতো পদাধিকারী, পার্টির অন্যতম বরিষ্ঠ নেতা, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইনজীবীদের একজন, পার্টির প্রতি সারা জীবন অনুগত থাকা এই নেতাকেও বহিস্কার করতে সর্বোচ্চ নেতাদের বাধেনি। অনাস্থা প্রস্তাবের আগের দিন ২১ জুলাই, ২০০৮ সালে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই সব নেতাদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানতে ইচ্ছা করে, ওনার মতো আর একজন মানুষকে দলের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন? আপনারাই তো বলেন যে বহিষ্কার করা খুব সোজা, দু’মিনিটের সিদ্ধান্তে একজনকে বহিষ্কার করা যায়। কিন্তু একজনকে তৈরি করতে বহু বছর সময় লাগে। তাই কমরেড তৈরি করাই আমাদের কাছে অগ্রাধিকার। কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের পর উনি পদত্যাগ করলে? এই সুযোগটুকুও ওনাকে দেওয়া হল না। আসলে এ এক ধরনের জেদ। যোগ্যতার মাপকাঠিতে ওনার তুল্য নেতা আর পার্টিতে ক’জন আছেন? উনি আদর্শের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সারা জীবন পার্টির জন্য কাজ করেছেন। নিজের আইনি পেশাকেও পার্টির স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন। সে আলোচনায় লেখা দীর্ঘায়িত করব না। উনি যদি পার্টিতে না এসে, আইনি পেশায় থাকতেন তাহলে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে ওনার স্থান কোন জায়গায় হত তা আমাদের অনেকের ধারণাই নেই। আইন আদালত নিয়ে আমারও সেরকম ধারণা অতীতে ছিল না। সহজ কথায়, বর্তমানে ঠেকায় পরে যখন নীচ থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দৌড়তে হয়, তাতে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে উনি চাইলে দিনে কত লক্ষ, মাসে কত কোটি টাকা আয় করতে পারতেন, তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।
অথচ সব ছেড়ে উনি বামপন্থার আদর্শকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বহিষ্কার হওয়ার পরেও তিনি বামপন্থীই ছিলেন। সদস্য পদ না থাকলেও পার্টির পক্ষেই ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। শেষদিন পর্যন্ত নানা ঘটনায় সে কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করতে তাঁর কোনও দ্বিধা ছিল না। উদারতাই নাকি কমিউনিস্টদের অন্যতম মহৎ গুণ। অথচ সেই উদারতার এক ভগ্নাংশও ব্যবহার করে মৃত্যুর আগে ওনার সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া গেল না! দিলে কি খুব খারাপ কিছু হয়ে যেত? আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারের পর বামপন্থায় বিশ্বাসী একটা অংশের মানুষের মধ্যে আমাদের পার্টি সম্পর্কে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এই সব ঘটনায় সারা দেশে তো বটেই, রাজ্যের পার্টি সংগঠনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নিলে, এরাজ্যে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস জোট গড়ে উঠত না। ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পৃথকভাবে লড়াই করলে বিরোধীরা এ সাফল্য পেত না। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এরাজ্যে বামেদের যে শক্তি ছিল বিরোধীরা তাতে থাবা বসায়। দু’টি জেলা পরিষদও যায় তাদের দখলে। রাজ্য প্রশাসন নিয়ে মানুষের মধ্যে সে সময় বিরূপতা বাড়ছিল। এই সময় মাওবাদীদের তৎপরতা অনেকটাই বেড়ে যায়। বিশেষ করে ওই সময় মাওবাদীদের অন্যতম নেতা কিষেণজির জঙ্গলমহলে আসা-যাওয়া অনেকটাই বেড়ে যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা পূর্বের অপেক্ষা কিছুটা সাফল্য পাওয়ার পর সম্মিলিত বিরোধী শক্তির তৎপরতাও বাড়ে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাশাপাশি, পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর সব জায়গাতেই মাওবাদী আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। প্রতিদিনই খুনের ঘটনা ঘটতে থাকে। তিন জেলাজুড়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনা যোগ হতে থাকে। প্রশাসনের তরফ থেকে এই ঘটনাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা হলেও তাতে সেরকম উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। আতঙ্ক ছড়ায় ওই সব এলাকার মানুষের মধ্যে। আক্রান্ত এলাকার মানুষের অবস্থা তখন কার্যত দিশেহারা। মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, প্রশাসন এই আক্রমণের মোকাবিলা করতে কি সত্যিই আন্তরিক? প্রশাসনের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে কি কোনও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে?
বিশেষ করে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের ২ তারিখের একটি ঘটনাতে এই প্রশ্ন আরও জোরালোভাবে দেখা দেয়। সেদিন শালবনিতে জিন্দালদের ইস্পাত শিল্পের বহু কোটি টাকার প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা যখন মেদিনীপুর শহরে ফিরে আসছিলেন, সে সময় মেদিনীপুর শহর লাগোয়া বাড়ুয়াতে রাস্তার উপর ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। ওই দিনই রাতে লালগড় থানার পুলিশ তৎকালীন আইসির নেতৃত্বে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাওবাদীদের ডেরায় গিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে। পুলিশের হাত থেকে ধৃত মাওবাদীদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। সে সময় এক আদিবাসী মহিলার চোখে আঘাত লাগে। পরদিনই সংবাদমাধ্যম এই চোখে আঘাত লাগার ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে এমনভাবে মাওবাদী তথা জনসাধারণের কমিটির বক্তব্যকে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির করে, যাতে গাড়ি উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে খুন করার প্রচেষ্টার ঘটনার থেকেও পুলিশের আক্রমণে এক আদিবাসী মহিলার চোখ নষ্ট করে দেওয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহল এলাকার ও সারা রাজ্যের মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা যায়। এই প্রচেষ্টায় চক্রান্তকারীরা সাফল্য পায়। কেন না এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের কমিটি, আদিবাসী সমাজসহ এক কথায় সব বিরোধী মিলিতভাবে ওই পুলিশ অফিসারকে বরখাস্ত এবং জেলার পুলিশ সুপারের শাস্তির দাবি জানাতে থাকে। এর একদিনের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই, যে পুলিশ আধিকারিক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করলেন, যাঁকে পুরস্কৃত করার কথা, সেই অফিসারকে বিরোধীদের দাবি মেনে রাতারাতি ছুটিতে (ফোর্স লিভ) পাঠিয়ে দেওয়া হল। এর কয়েকদিন পর জেলার পুলিশ সুপারকেও বদলি করে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় আমরা গোটা জেলা পার্টি হতবাক। কেন এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? এতে একদিকে যেমন বিরোধীরা উৎসাহিত হল, অন্যদিকে পুলিশের মধ্যে যে বার্তা গেল তাতে তাদের কাজের মনোবলে আঘাত লাগল। এতে আদতে লাভ কার? সরকার না বিরোধীদের সেই প্রশ্ন সামনে এসে গেল।
এই সব কিছুর ফলশ্রুতিতেই পাঁচ বছর আগে লোকসভায় যে সাফল্য বামেদের ছিল, ২০০৯ সালে তা অনেকটাই ধসে যায়। অনেক আসনে বামফ্রন্টের পরাজয় ঘটে। এই ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পুনরায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার গঠিত হয়। এরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক হয়। মন্ত্রিসভার অনেকগুলি মন্ত্রকে তাঁদের সাংসদরা দায়িত্ব নেন। কেন্দ্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ২০০৯ এর পর থেকেই তাঁরা ২০১১ সালের বিধানসভার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন।

(চলবে )

Comments are closed.