নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২০: নন্দীগ্রামের সমস্ত মানুষের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের কয়েকদিন আগে হাওড়ায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, সন্ত্রাস বেশিদিন চলবে না। কিন্তু কেন……

 

২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর হাওড়ার ডুমুরজলা মাঠে দলীয় সমাবেশে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কীভাবে বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে তৃণমূলের সন্ত্রাস বেশি দিন চলবে না?আসলে মুখ্যমন্ত্রী জানতেন, তাঁর দল কী করছে নন্দীগ্রামে। কীভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে রয়েছে তাঁর ‘নিরপেক্ষ’ পুলিশ বাহিনী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে সিপিআইএমের নেতা হিসেবে জানতেন, তাঁর দল কী পরিকল্পনা করছে সেখানে। জানতেন, আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। যে প্রস্তুতি তাঁর দল নিয়েছিল তার মোকাবিলা বেশি দিন করতে পারবে না নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ বা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। সরকারের প্রধান হিসাবে তিনিই নন্দীগ্রামে শান্তি ফেরাতে মহাকরণ থেকে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী ডাকছেন, আবার দলের নেতা হিসাবে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে সশস্ত্র অভিযানের অনুমোদন দিচ্ছেন! কিন্তু প্রকাশ্য সমাবেশে সেদিন পুরোটা বলতে পারেননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, আবার সবটা চেপেও রাখেননি। সেই কারণেই তো সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে হাওড়ার ডুমুরজলার মাঠে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চেহারার ভাষায় ফুটে উঠছিল সেই প্রতিশোধস্পৃহা, অহংকার এবং বিরোধী মতকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মনভাব। চেহারায় দেখা দিয়েছিল আধিপত্যের রাজনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মনোভাব, যা যথার্থই পড়ে নিয়ে দলীয় মুখপত্র ব্যবহার করেছিল  ‘হুঁশিয়ারি’ শব্দটা। যা মুখ্যমন্ত্রীকে উচ্চারণ করতে হয়নি। কিন্তু সামাঝদারকে লিয়ে ইশারই কাফি। গণশক্তি যথার্থই লিখেছিল, মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন…….। যার মানে পরদিন ৬ তারিখ সকালে হলদিয়ায় বসে লক্ষ্মণ শেঠ, রেয়াপাড়ায় বসে মাস্টারদা বা খেজুরিতে বিজন রায়রা গণশক্তি পত্রিকা পড়ে বুঝে নিয়েছিলেন। বুঝে নিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক দ্রুত নন্দীগ্রাম দখলেলর অনুমোদন তো দলের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আছেই, এবার তাতে প্রশাসনিক শিলমোহর পড়ল মাত্র। ৫ নভেম্বরে হাওড়ায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওই বক্তৃতার পর সিপিআইএম সশস্ত্র বাহিনীর দিন পাঁচেক মাত্র লেগেছিল  ‘হাতছাড়া’ নন্দীগ্রাম দখল করতে এবং সেখানকার মানুষকে সবক শেখাতে।

শুধু এখানেই থামেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এই খববেরই চতুর্থ প্যারাগ্রাফে গণশক্তি লিখছে, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বিরোধীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এভাবে বেশি দিন চলে না। এই ভয়ঙ্কর রাজনীতি তো কেশপুরে করা হয়েছিল, ভয় দেখিয়ে এলাকা দখল করে রেখেছিল। কিন্তু সেটাও বেশি দিন চলেনি। বাহাত্তর সালে কংগ্রেসও পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থবাবুর নেতৃত্বে ভয় দেখিয়ে চলতে চেয়েছিল। আমাদের পার্টির কর্মীদের ঘরছাড়া, পাড়াছাড়া করা হয়েছিল সর্বত্র। খুন করা হয়েছিল অনেককে। পার্টি অফিস দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু তারপর? থাকতে পেরেছেন সিদ্ধার্থবাবুরা? ওঁরা আজ কোথায়, আর আমরা এখন কোথায়!’

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আমরা বিরোধীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি…..।’  মুখ্যমন্ত্রীর এই কথায় ‘আমরা’ বলতে কী ধরে নেওয়া উচিত? সরকার না পার্টি? কী বোঝানোর চেষ্টা করছিল রাজ্য সরকার কিংবা সিপিআইএম, সেটাই তো সেই ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে জানতে চাইছিলেন নন্দীগ্রামের মানুষ। সেদিনই নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে অধিকাংশ বাইরের লোক নিয়ে জনসভায় তমলুকের সাংসদ নিদান দিয়েছিলেন, সেখানকার মানুষ শিল্প চাইছে। কিন্তু সেদিন সিপিআইএমকে দলীয় সমাবেশের আয়োজন কেন করতে হয়েছিল হঠাৎ করে? এই সমাবেশের আগে নন্দীগ্রাম নিয়ে কী ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের ভূমিকা? এই প্রশ্নের জবাবও তো মেলা জরুরি।

 

পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুকের প্রেক্ষাপট এবং ‘বিরোধীদের বোঝানো’

 

২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশে চার-পাঁচটা  মেগা ক্যামিক্যাল হাব গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মেগা ক্যামিক্যাল হাবের মুল শিল্পই হচ্ছে তেল শোধনাগার। তেল শোধনাগারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার কথা ছিল মেগা ক্যামিক্যাল হাবের। অন্যান্য কয়েকটা রাজ্য সরকারের পাশাপাশি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে একটা মেগা কেমিক্যাল হাব গড়ে তুলতে। কেন্দীয় সরকারের শর্ত ছিল বন্দরের কাছাকাছি এই হাব গড়তে হবে। রাজ্য সরকার হলদিয়া বন্দরের কথা ভেবে তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এই প্রস্তুতিতে সেই সময় সিপিআইএম পরিচালিত সরকারের সামনে কোনও রাজনৈতিক বাধা ছিল না। লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিপুল আসন পেয়ে বামেরা তখন কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকারের সহযোগী। রাজ্য বিধানসভায় ১৯৯ আসন নিয়ে পূর্ণ ক্ষমতায়, তার সঙ্গে দিল্লি সরকারের ওপর আধা নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস তখন মাত্র এক সাংসদের পার্টি।

২০০৫  সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের তৎকালীন শিল্প এবং বাণিজ্য সচিব সব্যসাচী সেন হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিককে একটা চিঠি দিলেন। হলদিয়া মেগা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের জন্য তিন হাজার হেক্টর জমি চিহ্নিত করা সম্ভব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন সব্যসাচী সেন। ২০০৫ এর ১৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের শিল্প বাণিজ্য দফতর এই প্রকল্পের জন্য কয়েকজন আমলাকে নোডাল অফিসার নিয়োগ করে একটা কমিটি তৈরি করে। নোডাল অফিসাররা ছিলেন হলদিয়া ডাক কমপ্লেক্সের ডেপুটি চেয়ারম্যান এল মিনা, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়ন নিগমের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা নবীন প্রকাশ, হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির  মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক সুরেন্দ্র গুপ্ত এবং আইএলএফএস শৈবাল দে।

এরই মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যাপারে কথাবার্তা আরও এগোতে থাকে। তার গতি খানিকটা কমে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পায় বামেরা। তার পরেই ফের দ্রুততার সঙ্গে এই প্রকল্পে অগ্রসর হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার। ২০০৬ সালের ১৭ জুলাই রাজ্যের শিল্প-বাণিজ্য দফতরের সচিব সব্যসাচী সেন হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে চিঠি দিয়ে জানান, কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রস্তাবিত প্রকল্পের নাম দিয়েছে মেগা কেমিক্যাল হাব এবং তার জন্য ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পেট্রোকেমিক্যালস অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন (পি সি পি আই আর) গড়ে তোলা হবে। তিনি হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে বলেন, এই ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত রাজ্য সরকারকে জানাতে। মহাকরণের এই চিঠির পরই হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি আর দেরি করেনি। তারা দ্রুত জমি চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে দেয়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬, পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শাসক তমলুকে তাঁর অফিসে এই মেগা কেমিক্যাল হাবের জমি অধিগ্রহণের জন্য মিটিং করেন। তার আগেই প্রশাসনিক এবং দলীয় স্তরে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নন্দীগ্রামেই হবে মেগা কেমিক্যাল হাব। ১৩ সেপ্টেম্বরের এই মিটিংয়ের খবর নন্দীগ্রামের মানুষের জানতে বেশি সময় লাগেনি। ২০০৬ বিধানসভা ভোটের পর থেকেই নন্দীগ্রামে জল্পনা শুরু হয়েছিল সেখানে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। তার বিরোধিতায় একেবারেই স্থানীয় স্তরে আলোচনা এবং জোট বাঁধাও শুরু হয়েছিল, কিন্তু ১৩ সেপ্টেম্বরের এই মিটিংয়ের পর নন্দীগ্রামের মানুষের আর কোনও সংশয় ছিল না জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। নন্দীগ্রামের কোন মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে, বোঝানোর চেষ্টা করে তমলুকের জেলা শাসকের অফিসে ওই  মিটিং হয়েছিল তা বলতে পারবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য?

ঠিক যখন সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল রাজ্য সরকার অনেকটা সেই সময়ে একই বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয় নন্দীগ্রামেও। কিন্তু সিঙ্গুরের মতো নন্দীগ্রাম তখনও তেমনভাবে আলোচনায় উঠে আসেনি। সিঙ্গুরের টাটা মোটরসের গাড়ি কারখানা ছিল দেশে ওই ধরনের ছোট গাড়ির প্রথম প্রজেক্ট। স্বাভাবিকভাবেই তাকে ঘিরে প্রচার ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া সিঙ্গুর নিয়ে প্রচারের একটা ভৌগোলিক সুবিধাও ছিল। অথচ জমির পরিমাণ থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষের জেদ এবং লড়াইয়ের আপোসহীন প্রতিজ্ঞা নন্দীগ্রামে কম ছিল না সিঙ্গুরের তুলনায়। কিন্তু কলকাতা থেকে সংবাদমাধ্যম কবে যাবে বা কবে যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার দিকে তাকিয়ে হাতে হাত রেখে বসে ছিল না নন্দীগ্রাম।

সিঙ্গুরে ঢাকঢোল পিটিয়ে টাটা গোষ্ঠীর ছোট গাড়ি কারখানার জন্য জমি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে রাজ্য সরকার। একই সঙ্গে এর বিরোধিতা শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নন্দীগ্রামেও একই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবে তা ছিল খানিকটা লো প্রোফাইলে। রতন টাটার ব্যক্তিত্ব এবং টাটা মোটর্সের প্রভাব সিঙ্গুর আন্দোলনের মর্যাদা এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেকটা সে কারণেই নন্দীগ্রামে আন্দোলনের সলতে পাকানো শুরু হলেও তা কলকাতার মানুষের ততটা নজরে পড়েনি। কিন্তু নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের কট্টর বিরোধিতার স্বর মহাকরণে আস্তে আস্তে পৌঁছতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। যদিও বিষয়টাকে তত গুরুত্বই দেওয়া হয়নি, যতটা তার প্রাপ্য ছিল। সিপিআইএম সরকার বা দল নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে যতই মাওবাদী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের তকমা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, প্রাথমিকভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে তা একেবারেই ছিল না।

হুগলির সিঙ্গুরে ৯৯৭ একর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ও খেজুরিতে প্রায় ১২,৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায় একই সঙ্গে শুরু হয়। ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রামের জমি চিহ্নিত করা নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শাসকের অফিসে যখন মিটিং হচ্ছে, তার ঠিক ১১ দিন বাদে ২৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুর ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকে জমি অধিগ্রহণের জন্য চেক বিলি শুরু করে রাজ্য সরকার। ২৫ তারিখ বিকেলেই তৃণমূল নেত্রী রওনা দেন সিঙ্গুরে, ধরনা দেন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসে। বাধা দেন চেক বিলিতে। সেদিন রাত ১২ টার পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিঙ্গুর ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকেন টেনে হিঁচড়ে বের করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। পরদিন ২৬ তারিখ একদম ভোরে কলকাতায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থানে বসে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা রাজ্যের সার্চ লাইটের আলো স্বাভাবিকভাবেই গিয়ে পড়ে সিঙ্গুরের ওপর,  সিঙ্গুরের মতোই নন্দীগ্রামের মানুষেরও একই আবেগ এবং জমি না দেওয়ার মরণপণ জেদের কথা সেভাবে জানতে পারেনি রাজ্যের মানুষ।

২০০৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকেই নন্দীগ্রামে আন্দোলনের প্রস্তুতি কথা আসতে শুরু করেছিল মহাকরণে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছর ৬ ডিসেম্বর রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী নিরুপম সেন এবং পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র কলকাতায় ডেকে পাঠান তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ এবং পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিআইএম পরিচালিত জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিরঞ্জন সিহিকে। বিধানসভায় নিরুপম সেনের ঘরে রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা এই মিটিং করেছিলেন। সেই মিটিংয়ে নিরুপম সেন এবং সূর্যকান্ত মিশ্র পূর্ব মেদিনীপুরের দুই দলীয় নেতাকে সতর্ক করেছিলেন, নন্দীগ্রাম নিয়ে তাড়াহুড়া না করে মেগা কেমিক্যাল হাবের গুরুত্ব মানুষকে বোঝাতে। পাশাপাশি বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম থেকে কয়েকটা মৌজা বাদ দিয়ে খেজুরির ২-৩ টে মৌজার জমি  মেগা কেমিক্যাল হাবে অন্তর্ভুক্ত করতে। বলেছিলেন, মেগা কেমিক্যাল হাব কী এবং তা গড়ে উঠলে এলাকার কী উন্নতি হবে তা নন্দীগ্রাম এবং খেজুরির সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে। এরপর লক্ষ্মণ শেঠ আর সময় নষ্ট করেননি। ২৬ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরে সিপিআইএমের জেলা সম্পাদকমন্ডলীর মিটিং হয়। সেখানেই দলীয়স্তরে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের কথা। এর দু’দিন বাদেই নন্দীগ্রামে জনসভার ডাক দেয় সিপিআইএম। নন্দীগ্রামে শিল্পায়নের গুরুত্ব সেখানকার সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীদের বদলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার বুঝিয়েছিল লক্ষ্মণ শেঠকে। আর লক্ষ্মণ শেঠ এর গুরুত্বের কথা নন্দীগ্রামের মানুষকে নয়, বুঝিয়েছিলেন তাঁর দলের ক্যাডারদের। তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন, সাধারণ মানুষকে বোঝানো মানে, জনসভা। আর জনসভা মানে শক্তি প্রদর্শন। সেই জনসভায় কারা এলেন, কারা এলেন না বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত জমির বাসিন্দাদের সিপিআইএমের তাকত বুঝিয়ে দেওয়া। ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে দলীয় মিটিং করে যেমন লক্ষ্মণ শেঠ শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানকার মানুষকে জমির বিনিময়ে শিল্পায়ন মেনে নিতে হবে। তাছাড়া মানুষকে পাড়া বৈঠক করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝানো একটা সেকেল এবং অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ অনুশীলন। মাত্র ছ’মাস আগে ২৩৫ আসন পাওয়া পার্টির কাছে অত সময় ব্যয় করা মানে বিলাসিতা। মুজফফর আহমেদ ভবনের সর্বস্তরের নেতৃত্বের তখন এক সুর, নির্বাচনী রাজনীতির পরীক্ষায় এত আসন যখন মিলেছে, জনমতও আছে স্বাভাবিকভাবেই।

জমি অধিগ্রহণ নিয়ে নন্দীগ্রামে গণ্ডগোল পুরোদমে শুরু হওয়ার মাসখানেক বাদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, খেজুরির হেঁড়িয়া মোড়ে জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ হবে না। সেখানকার মানুষ না চাইলে পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক হবে না নন্দীগ্রামে। মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রামের মানুষের কাছে যাওয়ার দরকার বোধ করেননি। দূর থেকে মিটিং করে নানা ঘোষণা করেছেন, আর নন্দীগ্রামের মানুষকে শিক্ষা দিতে, মানে পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক এবং তার গুরুত্ব বোঝাতে তাঁর পার্টি পাঠিয়েছে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী!

৫ নভেম্বর হাওড়ায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা বিরোধীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি….।’ সেই ‘বোঝানোর’ নমুনা তো নন্দীগ্রামের মানুষ সেই বছর ৫ জানুয়ারি রাতে প্রথম দেখেছিলেন, যখন কথা নেই, বার্তা নেই, আন্দোলন ভাঙতে খেজুরি থেকে লাগাতার বোমা ছোড়া হয়েছিল। তাতেও যখন আন্দোলনকারীরা দমে যাননি, রাস্তা কাটা বহাল রেখেছিলেন, তখন পরদিন ৬ জানুয়ারি রাত থেকে শুরু হয়েছিল গুলি বর্ষণ। ৭ তারিখ ভোরে তিন তিনটে নিরীহ ছেলে সিপিআইএম বাহিনীকে ঠেকাতে গিয়ে বেঘোরে মারা গেল। সেদিনই তার কয়েক ঘণ্টা বাদে ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআইয়ের সমাবেশ। শিল্প এবং চাকরির দাবিতে সিপিআইএমের যুব সংগঠনের ডাকা এই সমাবেশে মূল বক্তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলে দিলেন, ‘ওদের বাধা ভেঙে দিন। আপনারাই তা করতে পারেন।’ আর পূর্ব মেদিনীপুরের নেতা লক্ষ্মণ শেঠ তখন ব্যস্ত হলদিয়া উৎসব নিয়ে। তখন হলদিয়া উৎসব মানে লক্ষণ শেঠের প্রভাব এবং প্রতিপত্তির মেগা প্রদর্শনী। মেলা, নাচ, গান আলোচনাসভা, সব মিলে সিপিআইএমের ছত্রছায়ায় এবং শাসক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের স্পনসরশিপে চোখ ধাঁধানো জলসা।

নন্দীগ্রামে কোন তাগিদে সেই ৫-৬ জানুয়ারি থেকেই অসংগঠিত একটা আন্দোলনকে ভাঙতে সিপিআইএম খেজুরি দিয়ে আক্রমণ শানাচ্ছিল, দলীয় স্তরে তার কোনও মূল্যায়ন কি সেদিন করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য? নিশ্চয়ই করেননি। পুলিশ মারফত তাঁর কাছে তো সব খবরই ছিল। নন্দীগ্রামে রাস্তা কারা কাটছে সেই খবরটুকুই শুধু তিনি মহাকরণে বসে পেলেন, আর খেজুরি থেকে আক্রমণের খবর জানতে পারলেন না? কিন্তু এই আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ বন্ধ করতে চাইলে তো প্রথম দিনই করা বিবৃতি দিয়ে ৭ জানুয়ারির ঘটনার নিন্দা করতেন তিনি বা তাঁর দল। সেদিন দুপুরে ব্রিগেডে বক্তৃতা শুরুর আগে তো সব জেনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রশাসকের ভূমিকা পালন না করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বরং আন্দোলনকে মাওবাদী তকমা দিয়ে সিপিআইএমের আক্রমণকেই বৈধতা দিয়েছিলেন।

২০০৭ সালের জানুয়ারিজুড়ে গণ্ডগোল, সংঘর্ষ, খুনোখুনি, এলাকা দখল, বহু মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব মেদিনীপুরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। জনসভায় বলতে গিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামের মানুষ না চাইলে সেখানে মেগা কেমিক্যাল হাব হবে না, সরকার জোর করে নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ করবে না। হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির জারি করা নোটিস ছিঁড়ে ফেলতে বলেছিলেন প্রকাশ্য সমাবেশে। কিন্তু এই জনসভার জন্য পূর্ব মেদিনীপুরে কোন জায়গাকে বাছলেন মুখ্যমন্ত্রী? জীবন বাজি রাখা আন্দোলনকারীদের বার্তা দিতে কিন্তু নন্দীগ্রামে গেলেন না তিনি। গেলেন না জেলা সদর তমলুকেও। তিনি জনসভা করলেন হেঁড়িয়ার মোড়ে। হেঁড়িয়া মানে, খেজুরির গেটওয়ে। পূর্ব মেদিনীপুরের কেশপুর। যে খেজুরি থেকে মাত্র এক মাস আগেই নন্দীগ্রামে লাগাতার গুলি চালিয়েছে তাঁর দলের ক্যাডাররা। নন্দীগ্রামের মানুষ তখন ক্ষোভে ফুটছে যতটা না সরকারের বিরুদ্ধে, তার থেকে অনেক বেশি খেজুরির বিরুদ্ধে। সেই খেজুরির প্রবেশ পথ হেঁড়িয়ায় একদল সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকের সামনে বক্তৃতা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, নন্দীগ্রাম তাঁর রাজ্যের অংশ নয়। কারণ, সেখানে অধিকাংশ মানুষ শিল্প চাইছে না, আন্দোলন করছে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নন্দীগ্রাম বিরোধী এমন অনেক নিদর্শন এর পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেশ কয়েকবার রেখেছেন।

নন্দীগ্রামের আন্দোলন পুরোদস্তুর অহিংস ছিল এমন দাবি কেউই কোনওদিন করেনি, কিন্তু সিপিআইএম সেখানকার পুরো এলাকা দখল করার পর ২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেভাবে মহাকরণে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন,’ তা কি আদৌ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানসুলভ হয়েছিল? কোনও সিপিআইএম নেতাই নিশ্চই তা মনে করবেন না। ঘটনার শেষ এখানেও নয়। সেই বছর নভেম্বর মাসেই প্রথমবার নন্দীগ্রাম গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আন্দোলনমুক্ত নন্দীগ্রাম, মানে সিপিআইএমের দখলে থাকা নন্দীগ্রামে। গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে দীর্ঘ দশ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মৃত সিপিআইএম কর্মী এবং সমর্থকদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতে। নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে বিরাট বড়ো সমাবেশ হয়েছিল। সেই সমাবেশে নন্দীগ্রামের বহু মানুষকে হাজির করেছিলেন জেলার এবং স্থানীয় সিপিআইএম নেতারা। মুখ্যমন্ত্রীর সমাবেশের সম্মান রক্ষা করা তো মামুলি কোনও বিষয় নয়। তাই বহু জনসমাগম দরকার। তা না হলে মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন কীভাবে, নন্দীগ্রাম তাদের দখলে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন কীভাবে, দীর্ঘ দশ মাস আন্দোলন করে এলাকার মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে শাসকদলের শরণাপন্ন হয়েছে। আগের বছরই ২৯ ডিসেম্বর, ওই জায়গা থেকে মেরেকেটে পাঁচশো মিটার দূরে সমাবেশ করে নন্দীগ্রামে শিল্পায়নের নিদান দিয়েছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। সেখানেও জনসমাগম হয়েছিল প্রচুর। আর এবার তার ১১ মাস বাদে সেই শিল্পায়নের মাশুল হিসেবে নিজের দলে মৃত নেতা, কর্মীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের চেক দিতে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এবারও তিনি সিপিআইএমেরই মুখ্যমন্ত্রী। ৭ জানুয়ারি ভোরে তিন জনের মৃত্যু দিয়ে যে খুনোখুনির মিছিল শুরু হয়েছিল, ১৪ মার্চ যে ১৪ জন মারা গিয়েছিলেন পুলিশ অভিযানে কিংবা তার আগে, পরে যে বহু আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে, সেই পরিবারগুলো কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে ক্ষতিপূরণ পেল না।

মঞ্চ আর নন্দীগ্রামের মানুষের মাঝে শক্তপোক্ত উচুঁ বেড়া। মাওবাদী নাশকতা ঠেকাতে চারিদিকে অতি সক্রিয় পুলিশের গতিবিধি। বাসে করে লোক এসেছে পূর্ব মেদিনীপুরের নানা মুলুক থেকে। তাদেরই সঙ্গে মিলেমিশে বসে আছে নন্দীগ্রামেরও কিছু মানুষ। আন্দোলন উত্তর নন্দীগ্রামে সিপিএমের প্রভাব প্রতিপত্তির নমুনা হিসেবে। বুকের যন্ত্রণা, ক্ষোভ লুকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে তাঁরা শুনলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা দেখলেন, বাইরে থেকে আসা লোক তাঁর পাশে বসেই কী সুন্দর হাততালি দিচ্ছে। আর বেড়ার ওপারে মঞ্চ এবং তার আশপাশে তখন স্থানীয় সিপিআইএম নেতাদের গর্বিত রাজহাঁসের মতো পদচারণা। এই সব কিছুই অবশ্য নন্দীগ্রামের মানুষ তার কয়েক মাসের মধ্যেই সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্চায়েত ভোটে। কারণ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কখনই নন্দীগ্রামের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি!

আসল কথা হল, সরকার বা সিপিআইএম কখনও বিরোধীদের বোঝানোর চেষ্টা করেননি, বরং ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। যখন দেখেছে ভয় দেখিয়েও কিছু হচ্ছে না, তখন কেশপুর, গড়বেতা থেকে সশস্ত্র ক্যাডার আনিয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানতেন তাঁর দলের গড়বেতা, কেশপুর বাহিনীর দক্ষতা।

কিন্তু শুধু একা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নন, তাঁর দলের আর কে কে নভেম্বরের গোড়াতেই আগাম জানতেন নন্দীগ্রামে ১০ তারিখে ‘সূর্যোদয়ে’র কথা? আবার আমাদের ফিরতে হবে গণশক্তি পত্রিকায়।

৬ নভেম্বর নন্দীগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয় দু’দলের। পরদিন ৭ নভেম্বর গণশক্তি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো করে খবর প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, ‘মাওবাদী মাইনে নন্দীগ্রামে নিহত ২। দিনভর গুলি, ইএফআর জওয়ানসহ জখম ১০।’

সেই খবরের প্রথম প্যারাগ্রাফ,  ‘তিনটি মাইন ফাটিয়ে মাওবাদীরা প্রমাণ করল অধিকৃত নন্দীগ্রামে তারা ছিল, আছে। তৃণমূলই তাদের নিয়ে এসেছিল। মঙ্গলবার নন্দীগ্রাম তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তাদের পোঁতা একটি মাইন ফাটেনি। দুটি মাইন পেতেও কোনও ক্ষতি করতে পারেনি।’

দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ, ‘প্রায় আড়াই হাজার রাউন্ড গুলি আর অসংখ্য বোমা ছুঁড়ে, ঘর জ্বালিয়ে, ভেঙে, গ্রামের পর গ্রাম তছনছ করে মঙ্গলবার তৃণমূল-মাওবাদী যৌথবাহিনী আর একবার প্রমাণ করেছে নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে তারা শান্তি ফিরতে দেবে না। তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সোমবারের দুর্বিনীত মন্তব্যই এদিন আওড়েছেন তৃণমূলের অপর পাণ্ডা আবু তাহের, ‘নন্দীগ্রামে থাকতে গেলে তৃণমূল হয়েই থাকতে হবে। তৃণমূলের পিছনে পিছনে ঘুরে এখনও লাভের আশা ছাড়েনি কংগ্রেস। এদিন তাদের নেতা সবুজ প্রধান বলেন, যে পথেই হোক লড়াই চলবে।’

৭ তারিখের গণশক্তির প্রথম পৃষ্ঠার এই খবরের প্রথম দুটো প্যারাগ্রাফ পড়ে যে কোনও পাঠকেরই সংশয় থাকার কথা নয় যে, নন্দীগ্রামে আগের দিন কী মারাত্মক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। ল্যান্ড মাইন, আড়াই হাজার রাউন্ড গুলি, অসংখ্য বোমা। হাড় হিম করা ভয়াবহ সব ব্যাপার। কিন্তু আগের দিনই তো মুখ্যমন্ত্রী বললেন, নন্দীগ্রামে এই সন্ত্রাস বেশি দিন চলবে না। তো এই সব মারাত্মক বোমা-গুলির আক্রমণের মুখে পড়ে, সিপিআইএমের সেদিন কী ভূমিকা ছিল তা বোঝা মুশকিল ওই খবর পড়ে। কারণ, এই ‘ভয়াবহ আক্রমণে’র মুখে সিপিআইএমের কী ভূমিকা ছিল তার উল্লেখ ওই প্রথম পৃষ্ঠার খবরে নেই। তবে মুখ্যমন্ত্রী আগের দিন কীসের ভিত্তিতে বলেছিলেন, এই সন্ত্রাস বেশি দিন চলবে না। তার কিছুটা বোঝা যাবে সেদিনেরই গণশক্তির পঞ্চম পৃষ্ঠা দেখলে। প্রথম পৃষ্ঠায় যেখানে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের সশস্ত্র হামলার ভয়ঙ্কর বিবরণ, কী প্রকাশিত হয়েছিল সেদিন পার্টি মুখপত্রের পঞ্চম পৃষ্ঠায়?

৭ নভেম্বর গণশক্তি পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায় ৩১৭ শব্দের একটা খবর প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, ‘পিংলা, বিনপুর, বেলদার সমাবেশে  নেতৃবৃন্দ, প্রতিরোধ গড়ছেন অত্যাচারে জর্জরিত নন্দীগ্রামের মানুষ।’ সেই খবর শুরু হচ্ছে এভাবে, ‘জেগে উঠেছেন তৃণমূল-মাওবাদীদের অত্যাচারের পীঠস্থান নন্দীগ্রামের মানুষ। জনগণের প্রতিরোধের সামনে পিছু হটে পালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।

১১ মাসের অন্ধকার দূর করে অচিরে মুক্ত হবে নন্দীগ্রাম। পিংলার ১৫ সহস্রাধিক মানুষের এক সমাবেশে একথা বলেন সিপিআইএম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকার।’

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৯: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: নন্দীগ্রামে যে ভয়ঙ্কর রাজনীতি চলছে তা বেশি দিন চলতে পারে না    

 

পিংলার সমাবেশে আরও অনেক কথাই বলেছিলেন দীপক সরকার, যদিও তার সবটা নন্দীগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথম পৃষ্ঠার সঙ্গে পঞ্চম পৃষ্ঠার খবরে এমন চরম পরস্পর বিরোধিতা কেন সিপিআইমের মুখপত্রে? এ কি সচেতনভাবে করা, নাকি অজান্তেই হয়ে গিয়েছে, তা জানা নেই আমার। জানার চেষ্টাও করিনি তখন কিংবা পরবর্তী সময়ে।

৭ নভেম্বর গণশক্তির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হচ্ছে, ল্যান্ড মাইন ফাটিয়ে, আড়াই হাজার রাউন্ড গুলি চালিয়ে, অসংখ্য বোমা ছুঁড়ে নন্দীগ্রামে সন্ত্রাস করছে তৃণমূল ও মাওবাদী জোট। আর সেদিনই পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএম সম্পাদক দীপক সরকারের বক্তব্য পার্টির মুখপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, ‘নন্দীগ্রামের মানুষ জেগে উঠেছেন। পিছু হটছে দুষ্কৃতী। অচিরেই মুক্ত হবে নন্দীগ্রাম’। ভাল করে দেখুন শব্দ দুটো। জেগে উঠেছেন, জেগে উঠছেন নয় কিন্তু। কোন খবরটা ঠিক? দুটো খবর তো এক সুতায় বাঁধা নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৫ নভেম্বর হাওড়ার জনসভায় যে কথা বলেছিলেন, প্রায় একই সুরে পরের দিন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় তাই বলেছিলেন দীপক সরকার। এবং দীপক সরকারের কথা নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে কোনও অংশেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হেলাফেলা করার মতো নেতাও নন দীপক সরকার। তিনি অবিভক্ত মেদিনীপুরের দীর্ঘদিনের জেলা সম্পাদক। নন্দীগ্রাম, খেজুরি খুব ভালো করেই চেনেন, জানেন। আন্দোলন শুরুর সময় থেকে নন্দীগ্রামের প্রায় সব তথ্যই তাঁর জানা। তার একটা বড়ো কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর জেলার গড়বেতা, কেশপুরের লোকজন রয়েছে নন্দীগ্রামে। তাদের কাছ থেকে নন্দীগ্রামের সব খবরই পেতেন তিনি। আর কতদিন লাগবে নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে সে ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে ঠিক খবরই ছিল। তাই তিনি জানতেন মানুষ জেগে উঠেছেন। যথার্থই বলেছিলেন, ‘১১ মাসের অন্ধকার দূর করে অচিরে মুক্ত হবে নন্দীগ্রাম।’

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.