নন্দীগ্রাম নিয়ে সমস্ত তথ্যই গোয়েন্দাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও, রাজ্যের সংস্কৃতিমনস্ক পুলিশ কর্তব্য পালনে বিরত থেকেছিল

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের বাতাবরণেই ২০০৬ এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়। ২০০১ এর বিধানসভা, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত এবং ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনের সাফল্যের রেশ ধরেই ২০০৬ এর বিধানসভা নির্বাচনের সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের দল ও বামপন্থীরা। যদিও ২০০৫ সালেই পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে শুরু করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় মাওবাদীদের তৎপরতা বাড়তে থাকে। সিপিএম দলের নেতা ও কর্মীরাই তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। নৃশংসভাবে খুন, যা গোটা এলাকার মানুষকে আতঙ্কিত করে দিতে পারে, সেই ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক সুধীর সিংহ সর্দার থেকে বাঁকুড়ার গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতা রামপদ মান্ডিকে খুন করা হয়। একজনকে রাস্তা থেকে, অপরজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হল। এই সময় শক্তিশালী ল্যান্ড মাইনেরও ব্যবহার শুরু করে দুষ্কৃতীরা। ২০০৫ সালের একেবারে শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর পুরুলিয়া জেলা পরিষদের তৎকালীন সভাধিপতি কমরেড রবীন্দ্রনাথ কর ও তাঁর স্ত্রী আনন্দময়ী করকে ঘুমন্ত অবস্থায় বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে গোটা বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ও বর্বরোচিত ঘটনাও মাওবাদীরা সংগঠিত করে। দু’জনেই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় শিউরে ওঠেন গোটা রাজ্যের মানুষ।
এই অবস্থার মধ্যেই ২০০৬ এর গোড়া থেকে সপ্তম বাম সরকার গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে সিপিএম কর্মীরা রাস্তায় নামেন। ওই বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্রিগেড সমাবেশ হয়। ওই প্রকাশ্য সভায় সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক হিসাবে কমরেড অনিল বিশ্বাস শেষবারের জন্য ভাষণ দেন। রাজ্যের মানুষের প্রতি অনিল বিশ্বাসের সেই আহ্বান, নির্বাচনের সুর বেঁধে দেয়, ‘আমরা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়বই, এটাই আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।’ এর অল্প কিছুদিন পরেই সিপিএম পার্টি সংগঠনে ইন্দ্রপতন ঘটে। চলে যান অনিলদা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সারাদিন সভা করার পর সন্ধ্যার ট্রেনে তাঁর উত্তরবঙ্গ যাওয়ার কথা ছিল। ট্রেন ধরতে যাওয়ার প্রাক মুহূর্তে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেসরকারি এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। চরম উত্তেজনার সেই মুহূর্তগুলো। আর সুস্থ হয়ে ফেরা হল না অনিলদা’র। দল তার যোগ্যতম নেতাকে হারাল। গোটা পার্টির প্রভূত ক্ষতি হয়ে গেল। যিনি নিজের হাতে নির্বাচনী রণকৌশল থেকে প্রার্থী তালিকা তৈরি করেছিলেন, সমস্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন, তাঁর সেই পরিকল্পনাকে সামনে রেখে দল নির্বাচনে লড়ল, অথচ তিনি চলে গেলেন।
তাঁর সংগঠন পরিচালনার দক্ষতা, পার্টির বক্তব্যকে মানুষের বক্তব্যে উন্নীত করার জন্য তাঁর করা সাংবাদিক সম্মেলনগুলো রাজনীতি বিযুক্ত সাধারণ মানুষের মধ্যেও পার্টির একটা জায়গা করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সাংবাদিক সম্মেলনের সময়ে তাঁর শান্ত, সংযত ও বলিষ্ঠ বক্তব্য দৃঢ়ভাবে উপস্থাপনা, একই কথা কোনও দিন তাঁকে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে দেখিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কোনও দিন অসংযত, ব্যাঙ্গাত্মক ভাষা কেউ তাঁকে কখনও ব্যবহার করতে শোনেননি। কঠিন শব্দকে কঠিনভাবে প্রয়োগ করলেও তাঁর কোনও কথা বা উক্তি ব্যাঙ্গাত্মক হোত না। সহজ করে বললে, প্রয়াত কমরেড অনিল বিশ্বাস তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্যে দিয়েই রাজ্যের আপামর সর্বস্তরের মানুষের কাছে পাকাপাকি এক জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে হঠাৎ করে তাঁর মৃত্যু সংগঠনের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি বললেই সব বলা হবে না। সে ক্ষতি সংগঠনের প্রতিটি পদে পদে আজও আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রয়াত অনিল বিশ্বাসের পরিকল্পনা মাফিক গোটা পার্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচন, ২০০৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোট এবং ২০০৫ এর পুর-নির্বাচনে পরপর সাফল্য ও বামেদের সমর্থনে প্রথম ইউপিএ সরকারের কর্মসূচি, সব মিলিয়ে ২০০৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধীরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। একদিকে বামফ্রন্ট, অন্যদিকে কংগ্রেস এবং আর একদিকে তৃণমূল ও বিজেপি একসঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে হাজির হয়। নির্বাচনী ফলাফলে আসন সংখ্যার বিচারে বামফ্রন্টের সাফল্য হয় ঐতিহাসিক। আসন সংখ্যার বিচারে ঐতিহাসিক সাফল্য হলেও প্রাপ্ত ভোটের শতকরা অঙ্কে অবশ্য তা প্রতিফলিত হয়নি। নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করে। মন্ত্রিসভার শপথের অনুষ্ঠান থেকে মহাকরণে পৌঁছে সেদিনই সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্পের চুক্তি সাক্ষরের কথা রাজ্য সরকারের পক্ষে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পায়নের পক্ষে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। একটি রাজ্যের অর্থনীতি, শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে সে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে পারি। নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে বেশি চাহিদা কর্মসংস্থানের, এক কথায় বেকারত্ব দূর করার। কৃষিতেও যেহেতু নতুন-নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, তাই সেখানেও সুযোগ কমছে কর্মসংস্থানের। রাজ্যে ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করার অবস্থা তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগের ব্যাপক চাহিদা তখন। তার জন্য শিল্পায়ন একান্তভাবেই জরুরি। তাই রাজ্যে কৃষির সাফল্যের অগ্রগতির উপর ভিত্তি করেই নতুন স্লোগান বাংলার মানুষের কাছে সমাদৃত হয়, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’ শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে এই স্লোগান।
শুরু হয় নতুন মন্ত্রিসভার পথ চলা। এবারেও মন্ত্রিসভায় আমায় জায়গা দেওয়া হয়। এবার আর রাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, ক্যাবিনেট মন্ত্রী। কিন্তু এমন দফতরের ক্যাবিনেট মন্ত্রী, যে দফতরটি তৈরিই হয়নি। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ নামের একটি পর্ষদকে, দফতরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়িত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। রাজ্যের পশ্চিমাংশের পাঁচটি জেলার ৭৪ টি ব্লক (পঞ্চায়েত সমিতি) নিয়ে ছিল পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের এলাকা। আমার কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ হয় এই ৭৪ টি ব্লকের মধ্যে। নতুন দফতর তৈরির ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অনেক পর্যায় অতিক্রম করে মোটামুটি দফতর হিসাবে তৈরি করতে দু’বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এই ৭৪ টি ব্লকের প্রায় ৮০ ভাগই জঙ্গল এলাকা। ইতিমধ্যেই সেখানে, তথাকথিত মাওবাদীদের তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই কীভাবে উন্নয়নের রূপরেখা, রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কীভাবে কাজ শুরু করব তা নিয়ে নানা স্তরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে এলাকা উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এবং এবিষয়ে খড়গপুর আইআইটি’র মতো একটি উচ্চমানের পেশাদার প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হয়। সেই সময় বর্ধমান ডিভিশনের কমিশনার এই পর্ষদের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক ছিলেন। তাঁকে সাথে নিয়ে খড়গপুর আইআইটি’র উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিভাগ, সেগুলির প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। আমরা লিখিতভাবে, দফতর থেকে তাঁদের কাছে আবেদন জানাই। আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে নিজেদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন বলে তাঁরা কয়েকটা দিন সময় চান।
এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা আমাদের আবেদনে সাড়া দেন। খড়গপুর আইআইটি’র সিনিয়র প্রফেসর চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই প্রকল্প তৈরি করার। এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। প্রফেসর চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় পৃথক পৃথক সভা করা হয়। এই সভায় যেমন সরকারি আধিকারিকদের ডাকা হয়, তেমনই পঞ্চায়েত স্তর থেকে সাংসদ পর্যন্ত সকলকে ডাকা হয় মত বিনিময়ের জন্য। সমস্ত পর্যায়ের আলোচনা শেষে ঠিক হয়, রাজ্যের মধ্যে এই জেলাগুলিতেই অব্যবহৃত জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই জমি কীভাবে ব্যবহার করা যায় এবং এখানকার জমির উর্বরতা, এখানকার গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সব কিছুকে পরিমাপের মধ্যে রেখে কোন কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমরা জোর দেব, সেই সব বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে বলে আলোচনায় ঠিক হয়। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তাকে কীভাবে কৃষিকাজের জন্য ও মাটির নীচে জলের সমতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকাতে মানুষের জীবন-জীবিকার কাজে কীভাবে ব্যবহার করতে পারবো, এখানকার মানুষের পারিবারিক গড় আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কীভাবে বাড়াতে পারবো, এই ক্ষেত্রগুলিকেই গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প তৈরির জন্য আইআইটিকে অনুরোধ করা হয়।
এরপর প্রকল্প চূড়ান্ত করতে কিছুটা সময় নেয় খড়গপুর আইআইটি। একটি স্বল্প মেয়াদি ও একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প তৈরি হয়। একাধারে প্রকল্প তৈরি, অন্যদিকে পর্ষদকে দফতরে রূপান্তরিত করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। ঠিক তখনই পাঁচটি জেলার মধ্যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় মাওবাদী আক্রমণ বাড়তে থাকে। তার ফলেও ব্যাহত হয় কাজের অগ্রগতি। থমকে যায় কাজের পরিবেশ। অন্যদিকে, নন্দীগ্রামের আন্দোলন, সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সব মিলে এসময় রাজ্যের পরিবেশও উত্তপ্ত হতে থাকে। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ সরকারের এই স্লোগান মানুষকে আলোড়িত করলেও, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই স্লোগানকে ব্যর্থ করার জন্য এই প্রকল্প গ্রহণে যে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল তাকে কাজে লাগিয়ে বাম বিরোধী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামগ্রিক পরিকল্পনাকে ব্যাহত করতে উঠে পড়ে লাগে। এক্ষেত্রে কোনও কোনও জায়গায় আমলাতন্ত্রের অতি তৎপরতা, বিরোধীদের পরোক্ষভাবে কিছুটা মদত দেয়। নন্দীগ্রাম নিয়ে অনেক লেখাই অনেক লেখকের কলমে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সব কথার পুনরাবৃত্তি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
আমার দেখা নানা ঘটনা ও নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ভুল থাকতে পারে। এই লেখা কোনও গবেষকের বা প্রতিষ্ঠিত লেখকের বা সমাজ-বিশ্লেষকের লেখা নয়। এজন্য যে সমালোচনাই আসুক, তা আমার প্রাপ্য। সেই সমালোচনা আমি অবশ্যই মাথা পেতে গ্রহণ করব।
নন্দীগ্রামে শিল্পায়নের প্রাথমিক ভাবনা, চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হল না। তার আগেই পরিকল্পনা মাফিক অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির যে অপচেষ্টা বিরোধীরা করল তা অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এই কাজে প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীদের রাস্তায় নামানো আর এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির জন্য মাওবাদী নামক শক্তিকে ব্যবহারের ঘটনা আমরা বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করলাম। এই নিয়ে বহু মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। আমার লেখার মধ্যে দিয়ে কোনও আইনি জটিলতা তৈরি হোক তা আমি চাই না। যেহেতু অনেক মামলা এখনও বিচারাধীন, খুন-খারাবির যে সব কথা মামলাতে অন্তর্ভূক্ত তার বাইরে গিয়ে সাধারণভাবে কিছু কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। নন্দীগ্রামের ঘটনা যখন চলছে, সেই সময় সংবাদপত্রের হাড় হিম করা সে সব খবর এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এসব খবরের সত্যতা কতখানি, কুৎসা-অপপ্রচার কতখানি, জনমানসে বামফ্রন্টকে-বাম সরকারকে জল্লাদ প্রতিপন্ন করানোর কৌশল কতখানি তা মানুষের বিচার্য বিষয়। সংবাদে প্রকাশ হল, শত-শত নারীকে ধর্ষণ করে খুন করে খেজুরির তালপাটির খালে রাতের অন্ধকারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুরাও নাকি রেহাই পায়নি। তাদেরও নাকি নৃশংস, বর্বরোচিতভাবে খুন করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই ‘শত-শত’ কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর, রাজ্য থেকে সিবিআই পর্যন্ত অনেক তদন্ত। কতজন মহিলা নিখোঁজ বলে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েছে, কতজন শিশুকে খুন করে নিখোঁজ করে দেওয়া হয়েছে, তার সংখ্যাই বা কী, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আজও বাংলার মানুষের অজানা।
অরাজকতা সৃষ্টির জন্য গড়বেতা-কেশপুরের কায়দায় এলাকা দখলের যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তার জন্য পিচ রাস্তা কেটে, ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে, মাওবাদীদের পরিকল্পনা মাফিক খেজুরি-নন্দীগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় একটা আলাদা মুক্তাঞ্চল তৈরি করা হল। না, সেখানে সাধারণ পুলিশ-প্রশাসন প্রবেশ করতে পারবে না। তথাকথিত কমিটি, তাঁরাই সেখানে শেষ কথা বলার অধিকারী। প্রশাসন সেখানে ব্রাত্য। পঞ্চায়েতের উন্নয়ন থেকে শুরু করে সব কাজকর্ম একেবারে স্তব্ধ। সাধারণ প্রশাসনেরও সেখানে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই। এক কথায় ওই এলাকা একেবারে মুক্তাঞ্চল। এ জিনিস কখনও চলতে পারে? চলতে দেওয়া যায়? স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা অবশ্যই রাজ্য প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই সেই দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা যথাযথ ছিল, একথা বললে সবটা সত্য বলা হয় না। একজন পুলিশ আধিকারিক সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়কে নৃশংসভাবে খুন করে মাওবাদীরা তাঁর দেহ চটের বস্তায় ভরে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। ক’দিন পর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয় নদী থেকে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসনের যে ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল, তা পালন করা হয়নি। এই ধরনের খুনের কাজ যে জনরোষের ঘটনা নয়, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে একাজ করা হয়েছিল, তা বুঝতে রাজ্য প্রশাসনের কোনও অসুবিধা হয়নি। কীভাবে মাওবাদীদের সঙ্গে সে সময়কার বিরোধীদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সে সমস্ত তথ্যই রাজ্য গোয়েন্দাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও, হয়তো সংস্কৃতিমনস্ক পুলিশ তাঁদের মূল কর্তব্য পালন থেকে বিরত থেকেছিল।
এসব জটিলতার পর, ‘পূর্ব-মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম-খেজুরির মানুষ না চাইলে আমরা শিল্প করব না’, সরকারের পক্ষ থেকে বিধানসভায় এই বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। শিল্প পরিকল্পনা বাতিল হল। তারপরেও বিভিন্ন রক্ষা কমিটির নাম দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কারণ বা প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। আসলে এটা ছিল, ২০০১ এ ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ পরিকল্পনার পর, সফলতার জায়গায় পৌঁছানোর আরও একটি পরিকল্পনা। ২০০১ এ সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় গণ প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজের এলাকা সন্ত্রাসমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। নন্দীগ্রামে সেই গণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও ঘাটতি থেকে গিয়েছিল। এরও একটা অন্তর্নিহিত কারণ আছে। দুই মেদিনীপুরের বিভাজনের পর, এই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পার্টি সংগঠন আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যত না গড়ে উঠেছিল, তার থেকেও সরকারে থাকা, পঞ্চায়েতে থাকাসহ নানা সুযোগের মাধ্যমে বেশি বিকাশ ঘটেছিল সংগঠনের। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অন্য জেলার তুলনায় কিছুটা দুর্বল ছিল। এটা ঠিকই, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সব নির্বাচনেই আমরা সাফল্য পেয়েছি। কিন্তু সর্বদা নির্বাচন দিয়ে সংগঠনের গুণগত মান বিচার করা সম্ভব নয়। সংগঠনের পরিচালনার ক্ষেত্রে নন্দীগ্রামে রাজ্য পার্টির যথাযথ ভূমিকা পালনের ঘাটতি ও জেলা বিভাজনের ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা থেকে যায়।
নন্দীগ্রামের শিল্পায়নের ঘটনা নিয়ে ওই জেলার পরিস্থিতি তখন জটিল হচ্ছে। ২০০৭ সালের ৩ রা জানুয়ারি প্রথম যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে তা নিয়েও অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার দুই-তিন মাসের মধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুর পার্টিতে বিস্তারিত আলোচনা করে জেলা পার্টির পক্ষ থেকে একটি নোট পার্টির রাজ্য সম্পাদকের নিকট পাঠানো হয়। তাতে জেলার পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়, রাজ্য পার্টিতে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেই সিদ্ধান্ত রাজ্য প্রশাসনকেও যেন নির্দিষ্টভাবে জানানো হয়। অথচ এই নোট নিয়ে রাজ্য পার্টি কী সিদ্ধান্ত নিল তা জেলা পার্টি জানতে পারল না। পরবর্তীকালে পুনরায় এই নোট রাজ্য নেতৃত্বদের পৃথক পৃথকভাবেও দেওয়া হয় বলে জেনেছিলাম। পরে পূর্ব মেদিনীপুরের নতুন জেলা সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন কমরেড কানু সাহু (ওনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অবিভক্ত জেলার সময় থেকেই ভালো ছিল)। জেলা সম্পাদকের পদাধিকারে রাজ্য কমিটির সদস্য হওয়ার পর একদিন তিনি আমাকে বলেন, ‘ভাই, কলকাতায় পার্টির মিটিংয়ে গেলে, আমার থাকার জন্য তোমার বাসায় একটু জায়গা হবে তো?’ কানুদাকে আমি বলেছিলাম, বাসাটা আমার নয়, এটা পার্টিরই। কেননা পার্টিই আমাকে মন্ত্রী করেছে, সে জন্যই মন্ত্রী হিসাবে আমি থাকার জায়গা পেয়েছি। এটা পার্টির, আপনি পার্টির নেতা, তাই নিজের ভেবেই থাকবেন। এরপর যতদিন উনি পার্টিতে ছিলেন কলকাতায় রাত্রে থাকার প্রয়োজন হলে আমার বাসাতেই থাকতেন। তখন সব বিষয় নিয়েই উনি মন খুলে কথা বলতেন। একদিন বলেছিলেন, ‘জেলা পার্টির নোটটা রাজ্যস্তরে আলোচনা করে যদি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত যথাসময়ে নেওয়া হোত, তাহলে আমরা হয়তো এই জটিলতার অনেকখানিই সামলে দিতে পারতাম। আমাদের জেলার যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতে তা হয়তো হোত না।’ উনি প্রয়াত হয়েছেন। সে জন্য তাঁকে নিয়ে এর চেয়ে বেশি লিখব না। কিন্তু নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য পার্টির গভীর আত্ম অনুসন্ধান কি সত্যিই হয়েছিল?

(চলবে, পরের পর্বে বিস্তারিতভাবে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর ইস্যু)

Comments are closed.