কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #ছয়

প্রথম সাক্ষী: আইপিএস অফিসার প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

২০১৫ সালের শেষদিকে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে তাঁর অফিসে। জানতে গেলাম জঙ্গলমহলে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কথা। জঙ্গলমহলে ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের সশস্ত্র লড়াই, মাওবাদের বিস্তার, ২০০৯ সালে প্রায় লিবারেটেড জোন হয়ে ওঠা লালগড়ের ইতিহাস সন্ধান। যে ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজির এ’রাজ্যে পা রাখা। শেষ পর্যন্ত যার পরিণাম, ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর জামবনিতে মাত্র কয়েক মিনিটের এনকাউন্টার। কিষেণজি মৃত্যু রহস্যে আমার প্রথম সাক্ষী আইপিএস অফিসার প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।
‘সেটা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। আমার পোস্টিং হল মেদিনীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপারেশন পদে। সবে পোস্টটা তৈরি করা হয়েছে। অফিস মেদিনীপুর শহরে। মাওবাদী সমস্যা তখনও সেভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু জয়েন করে দেখলাম, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের রোজ মারপিট আর সংঘর্ষ। লড়াইটা হোত মূলত জামবনি, বিনপুর, বেলপাহাড়ি এবং কেশপুরে। প্রায় রোজই দুপুরে মেদিনীপুর থেকে বেরিয়ে ঝাড়গ্রাম চলে যেতাম, গভীর রাতে ফিরতাম। কয়েকদিন ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, আদিবাসীরা পুলিশকে একদমই পছন্দ করে না। গ্রামেও ঢুকতে দেয় না। কিন্তু কেন এমন হবে? পুলিশ কেন আদিবাসীদের গ্রামে ঢুকতে পারবে না? বসলাম জামবনি থানার ওসি অপূর্ব নাগকে নিয়ে। খোঁজ নিতে গিয়ে কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস জানা গেল।
সিপিআইএম কর্মীদের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির রোজ সংঘর্ষ হোত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থন ছিল তখন কংগ্রেসের দিকে। ফলে একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং কংগ্রেস, অন্যদিকে সিপিআইএম। এক্কেবারে সাপে-বেজিতে সম্পর্ক। জমিতে চাষ থেকে শুরু করে এলাকা দখল, পঞ্চায়েত ভোট থেকে মন্দির কমিটি গঠন, সব কিছু নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনি। কিন্তু পুলিশের ওপর গ্রামবাসীদের এত রাগ কেন? খবর নিয়ে জানলাম, কোনও সংঘর্ষ, মারপিটের পরই এক একটা ঘটনায় সিপিআইএম থেকে একদম ভোটার লিস্ট ধরে ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫, ৩০, ৪০ জনের নামে মামলা করে দেওয়া হোতও থানায়। তারপর শাসক দলের পক্ষ থেকে শুরু হোত পুলিশের ওপর চাপ, গ্রামে তল্লাশি এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে যেত পুলিশ। পুলিশ আসবে জেনে গ্রাম খালি করে পালাত ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। আর পুলিশের তল্লাশির পর পরই গ্রামে ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। সিপিআইএম জানত, ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা-কর্মীরা থাকলে তারা গ্রামে ঢুকতে পারবে না, বাধা পাবে। তাই পুলিশের ভয়ে ঝাড়খন্ডি নেতারা গ্রাম ছাড়ার পর পরই এলাকায় ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। তারপর বেছে বেছে ঝাড়খন্ডিদের বাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, লুঠপাট চালানো হোত। এর পুরোটা যে সব সময় পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে করত তা হয়তো নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটত এমনটাই। বেশ কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং আদিবাসীদের একটা বড় অংশের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়ে যায়, পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে এমন করছে। ফলে পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তখন ঝাড়গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সিপিআইএমের ততটা প্রভাব ছিল না। বরং আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ড পার্টির প্রভাব ছিল অনেক বেশি। আদিবাসীরা জানত, পুলিশের সাহায্য ছাড়া সিপিআইএম ক্যাডাররা গ্রামে ঢুকতে পারবে না। এই জায়গা থেকেই আদিবাসীরা পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দিতে শুরু করেছিল। আমি যখন নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, জামবনি, কাঁকড়াঝোড়ের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় যেতে শুরু করি, তখন তাদের মধ্যে এই পুলিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার নিয়েছে। একবার কাপগাড়ির কাছে দু’জন ঝাড়খন্ডি কর্মী খুন হয়েছিলেন। কিন্তু মৃতদেহ তোলার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি আদিবাসীরা। পুলিশ সুপার নিজে গিয়েছিলেন, তাও ঢুকতে পারেননি গ্রামে। তীর, ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। নিজেদের লোক খুন হয়েছে, তাও মৃতদেহ নিতে কিংবা সিপিআইএমের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি তারা। এতটাই ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে রাগ। তাছাড়া ঝাড়খন্ডিদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, সিপিআইএমের বিরুদ্ধে পুলিশকে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হবে না।
এরকম এক পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রামে ডিউটিতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল, এভাবে কাজ করা যাবে না। আদিবাসীদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে এবং গ্রামে ঢুকতে হবে। নয়তো কাজ করা অসম্ভব। এবং ঠিক করি, শুধুমাত্র কোনও ঘটনা ঘটলে, সংঘর্ষ-খুনোখুনি হলে গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করব, এটা হবে না। কোনও ঘটনা ছাড়া সাধারণ দিনেও গ্রামে যেতে হবে। এবং বিরাট ফোর্স নিয়ে গ্রামে ঢোকা যাবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গাড়ি নিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢোকা যাবে না। গ্রামে ঢুকতে হবে হেঁটে। এই তিনটে কাজ করতে পারলেই একমাত্র আদিবাসীরা আমাদের সম্পর্কে ধারণা কিছুটা পালটাতে পারে। এই পদ্ধতিই চালু করলাম। রোজ বিকেলে একটা করে গ্রামে যেতে শুরু করলাম। সঙ্গে শুধু এসডিপিও এবং ওসি। তিনজনে হেঁটে গ্রামে ঢুকতে শুরু করলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। আদিবাসীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। অধিকাংশ বাড়িতেই উঠোনে থাকত ছোট মন্দির। পুরো উঠোন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখত ওরা। জুতো পরে ওদের বাড়ির উঠোনে হাঁটাচলা করলে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হোত। পুলিশ তা করতও। রেগে গেলেও ওরা কিছু বলতে পারত না। আমরা গ্রামে ঢুকে কোনও বাড়ির উঠোনে ওঠার আগে জুতো খুলে নিতাম। তারপর বাড়ির দাওয়ায় বসে গল্প করতাম। আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে শুরু করল। ওসি অপূর্ব আমাকে জামবনির বুদ্ধেশ্বর টুডু নামে এক আদিবাসী নেতার কথা বলেছিলেন। বুদ্ধেশ্বর ভাল ফুটবল খেলতেন। কলকাতায় দ্বিতীয় ডিভিশন পর্যন্ত খেলেছেন। তারপর গ্রামে ফিরে যান। সিপিআইএমের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। ভালো কথা বলতেন, সহজাত নেতা। ঝাড়খন্ড পার্টির হয়ে পরে পঞ্চায়েত ভোটে লড়েছিলেন। জেতেনও। বুদ্ধেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতাম, ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা, জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আস্তে আস্তে সম্পর্ক গড়ে উঠল।’
‘যে জায়গাগুলোর কথা বলছেন, সবই তো বেলপাহাড়ি, বিনপুর কিংবা জামবনি। লালগড়ের কী অবস্থা ছিল তখন?’ টানা বলছিলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম লালগড়ের কথা। কারণ, ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যে তো বটেই, দেশেও মাওবাদী অ্যাক্টিভিটির শিরোনামে লালগড়।
‘না না, লালগড়ে আমাদের যেতেই হত না। সেই সময় নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সবচেয়ে শান্ত এলাকা ছিল লালগড়। কেউ মাওবাদী নাম তো শোনেইনি, কোনও সংঘর্ষ, মারামারিও ছিল না। মানুষও ছিল খুব শান্ত প্রকৃতির। তখন ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়ি করে লালগড়ে যাওয়া যেত না। কংসাবতী নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি। একদিন দুপুরে ঝাড়গ্রাম গিয়েছি, খবর পেলাম লালগড়ে একটি আদিবাসী মেয়ে খুন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে নয়, কিন্তু খুন তো! তাছাড়া আমার এলাকাতেও পড়ে। ঠিক করলাম লালগড় যাব, দেখে আসব কী হয়েছে। জল কম ছিল, হেঁটে কংসাবতী পেরোলাম। লালগড় থানার ওসি গাড়ি নিয়ে নদীর অন্যপারে অপেক্ষা করছিলেন। ওসির গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শুরু করেছে। দূর থেকে হেড লাইটের আলোয় দেখলাম, রাস্তার ধারে দুটো লোক হাত জোড় করে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহল হল। ড্রাইভারকে বললাম, ওঁদের সামনে গাড়ি থামাতে। ওসি বললেন, ‘‘স্যার মাতাল। দুপুরেই মদ খেয়ে নিয়েছে।’’ গাড়ি থামার পরও দেখি মাথা নীচু করে হাত জোড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
‘‘বাবু, তোরা ভগবান আছিস। তোরা ভগবান আছিস রে।’’
দু’বার বলল একই কথা। দুজনেই। আমি তো প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন বলছে একথা। কিছুক্ষণ পরে গ্রামে ঢুকে বুঝলাম এর মানে। লালগড় ছিল পিছিয়ে পড়া এলাকা। মানুষ প্রচণ্ড গরিব। পুলিশ, সরকারি অফিসাররা কোনও কাজের জন্য সেখানে গেলে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠত ওদের চোখে, মুখে। এত শান্ত এলাকা ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার জন্য সরকারি সহায়তা লালগড়ে পৌঁছাত কম। ওখানকার মানুষ বিশেষ কিছু আশাও করত না সরকারের কাছে। তাই একটি মেয়ের খুনের ঘটনায় এত দূর থেকে পুলিশ গ্রামে এসেছে, এটাই ছিল সেই সময় ওদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এই ঘটনার ১০-১২ বছর পর কলকাতায় বসে দেখলাম, সেই লালগড়ে মানুষ পুলিশকে এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এই শান্ত লালগড় এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। এতটাই শান্ত এলাকা ছিল লালগড়, আমরা এক সময় ভেবেওছিলাম, ওই এলাকাটাকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা থেকে বের করে দেব। সরকারি স্তরে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের শেষে লালগড় আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমি কলকাতায়। বারবারই মনে পড়েছে ১২ বছর আগের এক সন্ধ্যায় লালগড়ে রাস্তার ধারে দুজন স্থানীয় মানুষের হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। যাঁরা পুলিশ দেখে বলেছিল, ‘বাবু তোরা ভগবান আছিস।’ প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে একটা ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ সন্ধ্যায় যাচ্ছে এটাই ওদের কাছে তখন বিরাট প্রাপ্তি ছিল। কী ঘটে গেল ১০-১২ বছরের মধ্যে, এই সাধারণ, সরকারের কাছে কোনও প্রত্যাশাহীন মানুষগুলোই এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল!
তবে, লালগড় ছিল যতটা শান্ত, ততটাই ভয়ঙ্কর এলাকা ছিল মেদিনীপুরের কেশপুর। খড়গপুর থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় ধর্মার মোড় ২০-২২ কিলোমিটার গেলেই কেশপুর। রোজ ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের মধ্যে সংঘর্ষ হোত কেশপুরে। ভোর ৪টে-সাড়ে ৪টের মধ্যে দু’দল তীর ধনুক, বন্দুক নিয়ে রেডি হয়ে যেত। রীতিমতো শাঁখ, কাসর-ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হয়ে যেত সংঘর্ষ। সারাদিন চলত মারামারি, সংঘর্ষ। রোজ নিয়ম করে দু’পক্ষ মিলে ২৫-৩০ জন জখম হোত। কেউ হাসপাতালে যেত, কেউ যেত না। সন্ধেবেলা যুদ্ধ বিরতি। এ ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা।’
‘ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই রোজ রোজ সংঘর্ষ হোত কী নিয়ে? একটা কারণ থাকবে তো!’ জিজ্ঞেস করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে।
‘এক একদিন এক একটা কারণ। ধরাবাঁধা কিছু নেই। একদিন সন্ধ্যায় জামবনিতে ঝাড়খন্ড পার্টির এক কর্মী খুন হলেন। প্রায় মাঝরাতে মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারল পুলিশ। পরদিন সকাল থেকে এই নিয়ে উত্তেজনা পুরো জামবনি, বিনপুরে। সকালে অফিসে কিছু কাজ ছিল। তা শেষ করে দুপুরে মেদিনীপুর শহর থেকে রওনা দিলাম জামবনির উদ্দেশে। রাস্তায় যেতে যেতেই ওয়্যারলেসে খবর পেলাম বুদ্ধ ভকতের গুলি লেগেছে। তাঁকে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল, পরিস্থিতি আজ হাতের বাইরে চলে যাবে। আগের রাতে ঝাড়খন্ডি খুন। আর তার বদলায় আজ বুদ্ধ ভকত গুলিবিদ্ধ! বুদ্ধদেব ভকত তখন ঝাড়গ্রামের সিপিআইএম বিধায়ক। অরিজিনাল বাড়ি জামবনির চুটিয়া গ্রামে। ঝাড়গ্রাম শহরেও বাড়ি আছে। তখন এলাকায় বুদ্ধ ভকতের যত না প্রভাব তার চেয়ে ঢের বেশি দাপট, প্রতিপত্তি তাঁর ভাই বাসুদেব ভকতের। বাসু ভকত নামেই সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির নেতা, আসলে তিনিই জামবনির শেষ কথা। পার্টির মদতে এবং প্রশ্রয়ে ঝাড়গ্রাম মকুমার একছত্র নেতা, ঝাড়খন্ড পার্টির কাছে মূর্তিমান ত্রাসের নাম বাসু ভকত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক আদিবাসীদের ওপর বাসু ভকত এবং তাঁর দলবলের অত্যাচারের কাহিনী তখন জামবনির লোকের মুখে মুখে। তাঁর সামান্যই গিয়ে পৌঁছত কলকাতায়। পেশি শক্তির জোরে এলাকা দখল এবং একাধিপত্য স্থাপনের যে রাজনীতি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএম শুরু করেছিল, ঝাড়গ্রামে তার মুখ ছিলেন বাসু ভকত।
ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকলাম, চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ঠিক কেমন বলে বোঝানো মুশকিল, কিন্তু কোনওদিন ঝাড়গ্রাম না যাওয়া কেউ সেখানে হঠাৎই গিয়ে পড়লে বুঝবে কিছু গুরুতর ঘটেছে। একটা অঘোষিত বনধের চেহারা। অনেক দোকান-পাট বন্ধ। মোড়ে মোড়ে জটলা। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে পৌঁছানোর পর প্রথমেই এসডিপিও বললেন, ‘স্যার, বুদ্ধ ভকতের কিন্তু গুলি লাগেনি। এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার জন্য সিপিআইএম গুলির কথা রটিয়ে দিয়েছে।’
হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে, হাসপাতাল চত্বরে প্রচুর ভিড়। কয়েক’শো-হাজার সিপিআইএম কর্মী, সমর্থক বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছে বিধায়কের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে। আরও লোকজন আসছে বুঝতে পারছি। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে গণ্ডগোল, সংঘর্ষ শুরু করার জন্য একদম অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে বাসু ভকতের বাহিনী। হাসপাতালে ঢুকে খবর নিয়ে জানলাম, বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকত এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে যাচ্ছিলেন জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ কিছু একটা শব্দ হয়। গুলির শব্দ ভেবে মোটরসাইকেলের চালক ভয় পেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে যান। পড়ে গিয়ে পায়ে হাঁটুর কাছে চোট পান বুদ্ধ ভকত। কিছু জায়গায় কেটে-ছড়েও যায়। এরপরই বুদ্ধ ভকতের আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। প্রথমে রটে যায়, বিধায়ক গুলিবিদ্ধ। তারপর সিপিআইএম রটিয়ে দেয়, বুদ্ধ ভকতকে আক্রমণ করেছে ঝাড়খন্ড পার্টি। তাঁকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। হাসপাতালেই শুনতে পেলাম, সিপিআইএম পরের দিন বন্‌ধ ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরের দিনের কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে ঝাড়গ্রামের নেতারা কথা বলছেন জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে আমি এসপিকে জানালাম, ‘বুদ্ধ ভকতের কিচ্ছু হয়নি। মোটরসাইকেল থেকে পড়ে চোট পেয়েছেন। গুলি চলেনি।’
সন্ধে নামছে। হাসপাতাল চত্বরে ভিড় বাড়ছে শাসক দলের কর্মীদের। ঝাড়গ্রাম থানার দিকে রওনা দিলাম। হাসপাতাল ছাড়ার আগে বুদ্ধ ভকত এবং সিপিআইএমের নেতাদের বলে গেলাম, থানায় গিয়ে অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এলাকার পরিবেশ, পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএম এই ইস্যু সহজে ছাড়বে না। আমরা যাই বলি না কেন, সিপিআইএম তা মানবে না। বিধায়ক আক্রান্ত এই প্রচারকে সামনে রেখে নতুন করে অশান্ত করতে চাইবে জামবনি, বিনপুর এবং আশপাশের এলাকা।
অনেক রাতে বুদ্ধদেব ভকতকে নিয়ে সিপিআইএমের বিরাট বাহিনী এল ঝাড়গ্রাম থানায়। তারপর জামবনি, বেলপাহাড়ি এলাকার ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫-৩০ জন গুরত্বপূর্ণ নেতার নামে অভিযোগ লিখে জমা দিল। এলাকায় ঝাড়খন্ড পার্টির যত নেতা ছিল বেছে বেছে সবার নামে অভিযোগ করা হল। এও ওই জেলার সিপিআইএমের এক পুরনো কায়দা। বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দিয়ে তাদের হেনস্থা করার, এলাকাছাড়া করার কৌশল। বুদ্ধ ভকতকে বলে দিলাম, এই মিথ্যে অভিযোগ নিতে পারব না। গুলিই চলেনি, আর এতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ? সিপিআইএম কিছুতেই মানতে রাজি নয়। বেশ কিছুক্ষণ চলল এই নিয়ে টানাপোড়েন। সিপিআইএমের ভিড়টা হাসপাতাল থেকে আস্তে আস্তে থানার বাইরে এসে জড়ো হতে শুরু করেছে তখন।
রাত প্রায় ১১টা নাগাদ একদম গোপনে বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর বয়ান রেকর্ড করলাম থানায়। বুদ্ধ ভকতের পিছনে অন্য একটা মোটরসাইকেলে বসেছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। দেহরক্ষী বয়ানে লিখে দিলেন, একটা শব্দ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা গুলির নয়। রাত প্রায় ১২টা নাগাদ সিপিআইএম নেতাদের সঙ্গে আবার বসলাম। জানিয়ে দিলাম, সত্যি ঘটনা লিখে অভিযোগ জমা দিতে। এভাবে যার তার নামে অভিযোগ জমা দেওয়া যাবে না। এও জানালাম, বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর লিখিত বয়ান আমাদের কাছে রয়েছে। মিথ্যে অভিযোগ করে কোনও লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে আসল ঘটনা আদালতে জানাতে বাধ্য হব। একথা শুনে সিপিআইএমের নেতারা একটু থমকে গেলেন। তারপর যা ঘটেছে তার বিবরণ লিখে বেরোলেন থানা থেকে। সেই রাতের মতো ঝামেলা মেটানো গিয়েছে ভেবে থানা থেকে বেরোলাম। কিন্তু এই জেলার নাম মেদিনীপুর। এবং সেটা নয়ের দশকের মাঝামাঝি।
ভোর ৫টা নাগাদ ফিরলাম মেদিনীপুর শহরের কোয়ার্টারে। ঠিক করলাম, আর শোব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবে। ছেলে স্কুলে চলে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেব। পোশাক বদল করে সবে একটু বসেছি, ল্যান্ডলাইন বাজল। ঝাড়গ্রাম এসডিপিওর ফোন।
‘‘স্যার, সর্বনাশ হয়েছে। সিপিআইএমের ছ’জন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যকে অপহরণ করেছে ঝাড়খন্ডিরা।’’
‘‘মানে? কখন?’’
‘‘স্যার, এখনই খবর পেলাম। কোথায় নিয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কাল মাঝরাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত জামবনি, বেলপাহাড়ির ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্যকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন। কারও কোনও হদিশ নেই। মেরে ফেলেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।’’
‘‘ঠিক আছে। আসছি।’’ ফোন রেখেই পোশাক পরতে গেলাম। এই অশান্তি থামার নয়। দুইয়ে দুইয়ে চার। বুদ্ধ ভকত আক্রান্ত হওয়ার কথা গতকাল রাতে সিপিআইএম রটিয়ে দেওয়ার পর থেকেই আতঙ্কের প্রহর গুণছিলেন ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা। তাঁরা জানতেন, এই ঘটনা নিয়ে সিপিআইএম-পুলিশ তাঁদের গ্রামে হানা দেবে। তা থেকে বাঁচতে নিজেরাই পালটা আক্রমণের রাস্তা নিয়েছেন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের অপহরণ করে। কিন্তু মাঝরাতে পুলিশ যে বুদ্ধ ভকত, বাসু ভকতদের চাপেও মিথ্যে অভিযোগ নেয়নি, তা ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা জানতেন না কিংবা আন্দাজ করতে পারেননি। তখনও মেদিনীপুরের জামবনি, বেলপাহাড়ি, লালগড়কে কলকাতার মানুষ জঙ্গলমহল বলত না। কিন্তু কী বিচিত্র হিংসা, প্রতিহিংসার রাজনীতি ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এই জঙ্গল এলাকায়।
বেরনোর জন্য রেডিও হতে পারিনি। আবার ল্যান্ডলাইন বাজল। এবার ফোন জেলার পুলিশ সুপার দেবকুমার বসুর।
‘‘কী হয়েছে বল তো? এই ভোর রাতে দীপক সরকার ফোন করে চিৎকার করছেন, যা তা বলছেন ফোনে।’’
‘‘স্যার, ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন বেলপাহাড়ি, জামবনি থেকে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্য মিলে ছ’জনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আমি বেরোচ্ছি।’’
‘‘ঠিক আছে, দীপক সরকারের সঙ্গে একবার কথা বলে নাও। আমি ওনাকে বলে দিয়েছি তোমার সঙ্গে কথা বলতে।’’
‘‘আমি কী বলব। স্যার, আপনিই বলে দিন।’’
‘‘না না, তুমি সব কিছু জান। তুমিই কথা বল।’’
দীপক সরকার তখন মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের সম্পাদক। বিরোধী দল তো বটেই, নিজের দলেরও অনেকে তখন তাঁর ভয়ে কাঁপে।
বেরনোর জন্য পুরো রেডি হয়ে ফোন করলাম দীপক সরকারকে। ফোন তুলেই চিৎকার শুরু করলেন সিপিআইএমের জেলা সম্পাদক।
‘‘কী ভেবেছেনটা কী আপনারা? আমাদের ছ’জন পঞ্চায়েত সদস্যকে তুলে নিয়ে গেল। আর আপনি ঝাড়খন্ডিদের দালালি করছেন? কাল রাতে আমাদের অভিযোগ পর্যন্ত নেননি?’’
আমি সাধারণত রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে বেশি কথা বলতাম না। স্থানীয় স্তরে ওসি এবং ওপরতলায় পুলিশ সুপারই এসব করতেন। একে সারারাত জাগা। আবার বেরনোর জন্য রেডি হচ্ছি। এর মধ্যে দীপক সরকারের চিৎকার শুনে আমারও মাথা গরম হয়ে গেল। ‘‘কী বলছেন উলটো পালটা। আপনি কি পার্টির কোনও ক্যাডারের সঙ্গে কথা বলছেন নাকি? জানেন কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়?’’
‘‘আপনি বাসু ভকতের সঙ্গে কথা বলেন না। আমাদের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন না। শুধু ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।’’
‘‘বাসু ভকতের সঙ্গে আমি কেন কথা বলব? ওনাকে বলবেন ওসির সঙ্গে কথা বলতে।’’
‘‘আমাদের ছ’জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ডিরা। আমাদের লোকজন না ফিরলে সব আগুন জ্বালিয়ে দেব।’’
‘‘আমি ঝাড়গ্রাম যাচ্ছি। আপনার লোকদের বাঁচাতে পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করব।’’
এরপর সিপিআইএম জেলা সম্পাদকের ফোন রেখে বেরোলাম কোয়ার্টার থেকে। সকাল ৭টা নাগাদ পৌঁছালাম ঝাড়গ্রাম। সোজা চলে গেলাম জামবনি। কোনও ফোর্স ছাড়া ঝাড়খন্ড পার্টির শক্তিশালী এলাকায় গ্রামের ভেতরে ঢুকলাম পায়ে হেঁটে। গাড়ি রেখে দিলাম অনেক দূরে। যেভাবে এসডিপিও, ওসির সঙ্গে আদিবাসী গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম ঠিক সেভাবে। বুদ্ধেশ্বর টুডু এবং ঝাড়খন্ড পার্টির কয়েকজন নেতাকে খুঁজে বের করলাম ওই সকালে। ওরা সকলেই আমাকে বিশ্বাস করত। জানত, আমরা অন্তত ওদের কোনও ক্ষতি করব না। কিছুক্ষণ কথা বলে মনে হল, ওদের কেউই সিপিআইএমের ছয় পঞ্চায়েত সদস্যকে অপহরণের খবর পুরোপুরি জানে না। কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। ওরাই তারপর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ওদের দলের আরও কিছু নেতাকে খবর দিল। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। সকাল ১০টা নাগাদ ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা সেখানে এলেন। বোঝা গেল তাঁদের মধ্যে দু’একজন জানেন এই অপহরণের খবর। কিন্তু সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা কেউ জানেন না। জানলেও বললেন না তখন। এমনকী মেরে ফেলেছে কিনা তাও কারও জানা নেই। ওঁদের সঙ্গে আরও ভেতরে গ্রামে ঢুকলাম অনেকটা হেঁটে। যেখানে একদম ওদের ঘাঁটি। সেখানে আরও কয়েকজন ছিলেন নেতা টাইপের।
ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের বললাম, যেভাবে হোক সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের উদ্ধার করতেই হবে। বুঝিয়ে বললাম, আগের দিন বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় একজন ঝাড়খন্ডির নামেও কেস হয়নি। কিন্তু তার বদলায় যদি ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যের কিছু হয়ে যায়, তা খুব খারাপ হবে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকবে না। প্রথমে ওঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমার কথা। বিশেষ করে বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে কেস না হওয়ার ব্যাপারটা। দেখছি ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন নিজেদের ভাষায়। কী বলছেন তাও বুঝতে পারছি না সব। এরপর আমাদের বসতে বলে দু’তিনজন কোথাও একটা বেরিয়ে গেলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। দুপুর হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে ওখানেই শুনলাম, সিপিআইএমের ছ’জনকে জামশেদপুরের দিকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা ওখানকার ঝাড়খন্ডি নেতারা কেউ জানেন না। খবর নিতে লোক পাঠিয়েছেন।
একদম সকালে প্রথম যে গ্রামে গিয়েছিলাম সেখানে আবার হেঁটে হেঁটে ফিরলাম। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তখনও বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি, ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যকে ঝাড়খন্ডিরা খুন করে দিলে আগুন জ্বলবে জামবনি, বেলপাহাড়িতে। তা যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে কারও জানা নেই। আরও কতদিন চলবে এর রেশ কেউ জানে না। হঠাৎ ওয়্যারলেসে এসপির গলা পেলাম।
‘‘কোথায় চলে গেছ তুমি? সকাল থেকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অফিসাররাও কেউ বলতে পারছে না তুমি কোথায়।’’
‘‘স্যার আমি ঠিক আছি। গ্রামে ঢুকেছি সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের খোঁজে। দেখা যাক কিছু করা যায় কিনা।’’
‘‘বেশি ঝুঁকি নিও না। সাবধানে।’’
বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে আসছে। ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসে আছি গ্রামের মধ্যে। কোনও খবর নেই। শুধু জানি, অপহৃত পঞ্চায়েত সদস্যদের জামশেদপুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁদের খোঁজে কয়েকজন রওনা দিয়েছে। যারা ফেরানোর জন্য গিয়েছে তারা পৌঁছানোর আগেই যদি সিপিআইএম সদস্যদের মেরে ফেলে থাকে তবে সর্বনাশ। টেনশনে মাঠে পায়চারি করছি, সন্ধে সাতটা নাগাদ কয়েকজন মিলে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে এল। সবাইকে অক্ষত অবস্থায়। আমি তখন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। একদম সকালে শুরু হয়েছিল অপহৃতদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া। প্রায় ১২ ঘন্টা বাদে ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন। সেই সময়ের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরিবেশে তা ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা।

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #পাঁচ

রাত আটটা নাগাদ অপহৃত সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে জামবনি থানায় ফিরলাম। ফোন করলাম দীপক সরকারকে। বললাম, ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে অনেক নেগোশিয়েট করে তাঁদের ফেরত নিয়ে এসেছি। চাই না কারও নামে কোনও মিথ্যে মামলা করা হোক। থানায় বসে ভোটার লিস্ট মিলিয়ে এর নাম দেবেন, ওর নাম দেবেন, এই সব অ্যালাউ করব না।
সিপিআইএম জেলা সম্পাদক বললেন, ‘‘বাসু ভকতকে থানায় পাঠাচ্ছি। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবে।’’
‘‘না। ওনার সঙ্গে আমি দেখা করব না। আমার সঙ্গে কথা বলার কী দরকার?’’
‘‘বুদ্ধ ভকতের ওপর আক্রমণের ঘটনাতেও আপনি আমাদের অভিযোগ নেননি।’’
‘‘আমি জানি কী হয়েছে। বুদ্ধদেব ভকতের নিরাপত্তা রক্ষীর লিখিত বয়ান আছে আমাদের কাছে। গুলি চলেনি।’’
সেদিন রাত ১০টা নাগাদ পুরো ঝামেলা মিটল। তারপর মাঝরাতে মেদিনীপুর শহরে ফিরলাম।’ থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি তখন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি জামবনি, বেলপাহাড়ির জঙ্গল ঘেরা গ্রাম, আদিবাসী ঝাড়খন্ডি যোদ্ধার শক্ত চোয়াল, সিপিআইএম বাহিনী, ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের সামনে শাসক দলের জমায়েত, দীপক সরকারের মুখ-চোখ, সব কিছু।
‘এ তো পুরো সিনেমার মতো। কিন্তু তার মানে, আপনি যখন ঝাড়গ্রামে জয়েন করেন, তারও অনেক আগে থেকেই ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই সংঘর্ষ, গণ্ডগোলের শুরু।’ প্রশ্ন করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে।
‘তা তো বটেই। আমি যখন গিয়েছি তখন তো ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে লড়াই, সংঘর্ষ চরমে। একদম শুরুর ঘটনা জানতে হলে আপনাকে আরও পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে।’
‘কে বলতে পারবে এই ইতিহাস? না বানিয়ে, ঠিকঠাক মতো।’
‘নরেন হাঁসদা পারতেন। কিন্তু তিনি তো বেঁচে নেই। একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ডহরেশ্বর সেনকে চেনেন? বলবেন কিনা জানি না, কিন্তু উনি যদি চান, আপনাকে অনেক কিছু বলতে পারেন। ঝাড়গ্রাম ব্লকের আদিবাসীদের, ঝাড়খন্ডিদের, সিপিআইএমের কথা উনি অনেকের থেকেই বেশি জানেন।’
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য শেষ। উঠে আসছি তাঁর অফিস থেকে। ভাবছি, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের এই লড়াই-সংঘর্ষের শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে হবে। আরও পিছিয়ে যেতে হবে তার জন্য।
‘আর একটা ঘটনা বলি শুনুন, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন কী অবস্থা ছিল সেই সময় অবিভক্ত মেদিনীপুরের।’ ফের বললেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।
আবার বসে গেলাম। এই অজানা ঘটনাগুলো জানতেই তো তাঁর সাক্ষ্য নেওয়া।

চলবে

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

Comments are closed.