বামেদের সঙ্গে জোটবার্তা অধীরের, মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুঁজে বেড়ানো বিজেপি সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টাচ্ছে

দিল্লিতে দোস্তি আর বাংলায় কুস্তি, বিষয়টি এত সস্তা নয়। রাজনীতি সাপলুডো খেলা নয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে জাতীয় কংগ্রেসের তেইশজন শীর্ষ নেতা কংগ্রেসের স্থায়ী সভাপতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন সোনিয়া গান্ধীকে। সেই চিঠি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের কে জানালেন, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বয়ং রাহুল গান্ধী। মনে করা হচ্ছিল যে, জাতীয় কংগ্রেস যেন তার ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন আগেই যদিও রাজস্থানের সমস্যা মিটিয়ে ফেলা হয়েছিল। তাও। মিডিয়া জানতে চেয়েছিল, এই শতাব্দী প্রাচীন দলটি কি তার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে?

আসলে ইংরিজিতে একটি কথা আছে যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, সাফল্যের চেয়ে সফলতা আর কিছুতে নেই। যখন সোনিয়া গান্ধী সফল হচ্ছিলেন তখন প্রশ্ন ওঠেনি। যেই গত লোকসভাতে রাহুল ব্যর্থ হলেন, প্রশ্ন উঠতে শুরু করলো। কিন্তু একথা না বললে নয় যে রাহুল গান্ধী বরাবরই তরুণ নেতাদের তুলে আনতেই চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতি পদে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা বাধা সৃষ্টি করেছেন। রাহুলও সেটা মেনে নিয়েছেন। সুতরাং আজ দেশজুড়ে কংগ্রেসের যে কোণঠাসা পরিস্থিতি তার জন্য শুধুমাত্র নেহরু গান্ধী পরিবার দায়ী, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই।

এই সূত্রেই বলা চলে যে, রাজীব গান্ধীর অকাল প্রয়াণ না হলে সম্ভবত তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিই হতো না। রাজীব কংগ্রেস রাজনীতিতে তাঁর মতো করে নতুন নেতা-নেত্রীদের প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিলেন। এমনকী তাঁর মায়ের অতি প্রিয় কাউকে কাউকে ছেঁটে ফেলতে দ্বিধা করেননি। লক্ষ্য ছিল নতুন নেতা-নেত্রীদের হাত ধরে সামনের দিকে পা ফেলা। পুরনো ভাবনাচিন্তা পরিত্যাগ করা। সোনিয়া কিছুটা কৌশলী হলেও, ভাবনার ক্ষেত্রে খুব বড় বদল আনেননি। পুরনো এবং নতুন নেতৃত্বের একটি ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। একই সঙ্গে প্রতিটি রাজ্যের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কথাটাও মাথায় রেখে চলতে চেষ্টা করেছেন।

সাতকাহন করে এত কথা বলার কারণ হচ্ছে রাজনীতি একটি জটিল ধাঁধা। পদার্থবিদ্যা বা অর্থনীতির সূত্রগুলির একটি সার্বিক মান্যতা রয়েছে। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাধ্যাকর্ষণের যে সূত্র কার্যকর, ভারতেও তাই। কিন্তু রাজনীতির মূল ভিত্তি যে সমাজজীবনের নানাবিধ চাহিদা তাকে যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করা অত সহজ নয়। শুধুমাত্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে চাহিদা এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ধরণ যে আলাদা হয় তাই নয়, সামগ্রিকভাবে সর্বত্রই এর রকমফের আছে। কেরলে বামপন্থীদের জনভিত্তি যেভাবে গড়ে উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গে তা হয়নি। আবার পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছর একাদিক্রমে ক্ষমতায় থাকার পর বামপন্থীরা হেরে যান এবং ক্রমেই তাঁদের জনসমর্থনের ভিত্তিতে একটি ক্ষয় আসছে যা কেরলের ক্ষেত্রে সত্য নয়। কেরলে মুসলিম লিগ যথেষ্ট শক্তিশালী নির্ণায়ক শক্তি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থন বাড়লেও কোন মুসলিম সংখ্যালঘু সংগঠন তেমন ভোট পায় না। শুধুমাত্র দুটি রাজ্যের পরিস্থিতি বিচার করলেই বোঝা যাবে যে কত রকম জটিলতা হতে পারে।

তাই রাজ্য এবং কেন্দ্র অভিন্ন রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত হবে এমন মনে করা ঠিক নয়। বস্তুত উচিতও নয় যদি আমরা একান্তই মূল মতাদর্শগত জায়গায় কোন বিরাট পরিবর্তন না দেখি। যদি দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস আর বিজেপির জোট হয়েছে বা যেমন, গত লোকসভাতে বহু বামপন্থী সমর্থক বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন , সেরকম কিছু হয়েছে তখন বুঝতে হবে, রাজনীতির গোড়ায় কোন গলদ আছে বা এতদিন ধরে যা বলে আসা হচ্ছিল, তা মিথ্যা প্রতারণা মাত্র। সত্য সে কঠিন, হারজিত নিরপেক্ষ।

রাজনীতিতে কৌশলই সব, একথা যাঁরা বলেন তাঁরা ম্যাকিয়াভেলির শিষ্য। সুপারম্যানে যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা নিৎসের। উভয়ের প্রাপ্তি ফ্যাসিবাদ। কার্যত ফ্যাসিবাদী জনতারও একটি রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে। শুধুমাত্র কৌশলী যাঁরা তাঁদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সোনিয়া গান্ধী নিশ্চয়ই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মতামতকে একজোট করা যায় তার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা রাজ্যস্তরে সমস্ত সম্ভাবনা ও মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস আগামী নির্বাচনে দশ বছর পূর্ণ করে জনতার মুখোমুখি হবে। অবশ্যই এতদিনে একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস এবং তৃণমূল শেষ একসাথে লড়েছিল ২০১১ তে, বাম সরকারের পতন ঘটাতে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সুখের লাগি বাঁধা ঘর অনলে জ্বলিয়া গেল। তারপর থেকে শুধু তো পরস্পর বিরোধিতা। সেখানে কীভাবে সম্ভব অতীতের তিক্ততা ভুলে আবার একজোট হওয়া? এটা সম্ভব হয় একই রাজনীতির নানা রূপের মধ্যে। বিশেষত বিরোধী ময়দানে। যেমন বহু বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বামপন্থীরা একে অপরের হাত ধরে আছেন।

২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট হলো কিন্তু উভয়ের নানা ভূমিকা এবং আচরণের জন্য তা জনগণের কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তারপর তাঁরা পরস্পরের হাত ছেড়ে দিলেন। অর্থাৎ, জনসাধারণ বুঝলেন যে ক্ষমতার জন্যই ঐ মেলবন্ধন হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে বাম ও কংগ্রেস নেতারা একজোট হয়েছেন এর পরেও, যদিও নির্বাচনে তাঁরা একসাথে লড়েননি। কেন, তা কেউ জানেন না। সম্ভবত ওনারা নিজেরাও নন। কিন্তু একসাথে লড়াই করলে ধীরে ধীরে অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা যে সম্ভব, ইতিহাসে এমন নজির প্রচুর আছে। হয়তো ২০২১ এ ক্ষমতা অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে যেভাবে বামপন্থীরা নিজেদের বিপন্ন করেও রাস্তায় দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ফুয়াদ হালিম সহ একাধিক বামপন্থী চিকিৎসক কাজ করে যাচ্ছেন, তা মনে রাখবেন এ রাজ্যের মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুঁজে বেড়ানো দলটি সম্পর্কেও মানুষের ধারণা পাল্টাচ্ছে। কিন্তু সব কিছুরই একটি রাজনৈতিক অভিমুখ দরকার। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে যায়, তাকে পাকিয়ে তোলেন যোগ্য নেতা। অধীর চৌধুরী এমনই একজন, যাঁর অন্তত একটি লড়াকু ইমেজ আছে। আছে জনভিত্তিও। পশ্চিমবঙ্গে বাম কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় এসে যাবে এমনটা কেউ বলছেন না। এরাজ্যেই একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে যার প্রসারিত রূপ জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত করবে। অধীরবাবুকে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা এবং এ রাজ্যে প্রদেশ সভাপতি করে সোনিয়া গান্ধী সেই বার্তাই দিতে চাইলেন কিনা, তা সময়ই বলবে।

 

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.