হেঁশেল ছেড়ে ‘লেখোয়াড়’ মনোরঞ্জন ব্যাপারী সামলাবেন গ্রন্থাগার, মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ছুটি মিলল রাঁধুনির কাজ থেকে

জীবনের একটা পর্যায়ে নকশাল আন্দোলন করেছেন। জেল খেটেছেন। পরবর্তীতে সেই তিনিই হয়ে উঠেছেন সাহিত্যিক। দীর্ঘ এই পথ পেরোতে পেরোতেই একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান এসে ঢুকেছে ঝুলিতে। কিন্তু অর্থাভাব ঘোচেনি। অর্থের জন্য এখনও পরিশ্রম করে যেতে হয় সত্তরোর্ধ্ব মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে।

রাঁধুনির কাজ করতেন একটি স্কুলে। কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছে না। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে চিঠি লেখে অপেক্ষাকৃত হালকা অন্য কোনও কাজের আবেদন করেছিলেন সাহিত্যিক। খবর পেয়ে ব্যবস্থা নিলেন মমতা। সরকারি লাইব্রেরির কাজে নিযুক্ত করা হল মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে।

জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিদ্যানগর জেলা গ্রন্থাগারে নিয়োগ করা হয়েছে মনোরঞ্জনবাবুকে। জনশিক্ষা দফতরের অধীনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার হেলেন কেলার বধির বিদ্যালয়ে এতদিন রান্নার কাজ করছিলেন ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ এর লেখক। স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন ব্যানার্জি তাঁকে ফোন করে গ্রন্থাগারে নিয়োগের সুখবর জানানোর পর মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা অনন্য এক অভিজ্ঞতা। তার কারণ, বাংলা সাহিত্য সমাজের যে চেনা বৃত্ত, মনোরঞ্জনবাবু তার বাইরের লোক। তিনি মুটে-মজুরি করেছেন, ছাগল চরিয়েছেন, দীর্ঘ সময় যাদবপুর অঞ্চলে রিক্সা চালিয়েছেন। এমনকী চায়ের দোকানে টেবিল বয়ের কাজ করেছেন, মেথরের কাজও করেছেন। ছত্তিসগঢ়ের জঙ্গলে কাঠ কেটে তা সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে ফিরি করেছেন পেট চালাতে।

বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরনোর সুযোগ হয়নি বটে কিন্তু দেশের হেন নামী বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে তিনি বক্তব্য রাখেননি, তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়নি। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়েনি। তাই এতদিন, এই বৃদ্ধ বয়সে, অশক্ত শরীরেও দু’বেলা কয়েকশো জনের রান্না করতে হোত তাঁকে। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে গ্রন্থাগারে কাজ জুটলো সাহিত্যিকের।

জেলখানাতেই অক্ষর পরিচয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীর। সেখানেই এক শিক্ষিত কয়েদি তাঁকে মাটিতে দাগ কেটে অক্ষর পরিচয় করান। আর জেল থেকে বেরিয়ে জন্ম হয় পাঠক মনোরঞ্জনের। তারপর রিক্সাচালক মনোরঞ্জনের সঙ্গে ঘটনাচক্রে পরিচয় হয়ে যায় সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর। জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাঁর উৎসাহেই লেখালেখি শুরু করেন তিনি। গল্প, উপন্যাস তাঁকে বানাতে হয়নি বরং নিজের জীবনের এক একটা অধ্যায় তাঁর এক একটা গল্প হয়ে উঠেছে। পাঠক সমাদরে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় তাঁর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’।

এত স্বীকৃতি সত্ত্বেও জীবন সংগ্রাম চলছিল। তাঁর আবেদনে সাড়া দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীকে সবাই মিলে ধন্যবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। ফেসবুকে লিখেছেন, আমার হয়ে আপনারাও দিদিকে ধন্যবাদ জানান- আপনাদের লেখোয়াড়কে নব জীবন প্রদানের জন্য।

Comments are closed.