নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৭: আগুনে পুড়ছে পরপর বাড়ি, মাথার ওপর দিয়ে গুলি উড়ে যাচ্ছে

কী ঘটেছিল আগের পর্বে: টানটান উত্তেজনায় ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট হল নন্দীগ্রামে। কোনও বুথে একজনও এজেন্ট দিতে না পেরেও ১৭ টা গ্রাম পঞ্চায়েতেই জিতল তৃণমূল……

 

নন্দীগ্রামের শিক্ষা এবং রাজ্যে পালাবদল

একটা ছোট্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করে পঞ্চায়েত ভোটের এই চ্যাপ্টার শেষ করব।

তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে টাটা মোটর্সের গাড়ি কারখানার বাইরে অবস্থান করছেন। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে পাওয়া অক্সিজেন এবং হয় এসপার, নয় ওসপার জেদকে সম্বল করে জমি ফেরানোর দাবি তুলে সেই বছর ২৪ অগাস্ট দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মঞ্চ বেঁধে বসেছেন তিনি। এই আন্দোলন কর্মসূচিটা মুখ থুবড়ে পড়লে কয়েক মাসের মধ্যে টাটা মোটর্সের ন্যানো গাড়ি বেরিয়ে যাবে। তাহলেই জমি আন্দোলনের যাবতীয় লড়াই, ক্রেডিবিলিটি কার্যত শেষ।

আর এই কর্মসূচি থেকে নিজের দাবি আদায় করে সসম্মানে বেরিয়ে যাওয়া মানে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার এবং সিপিআইএমের সমস্ত ঘোষণা এবং শিল্পায়নের স্লোগানের মোটামুটি পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। কারণ, ততদিনে পরিষ্কার, নন্দীগ্রামে ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে জমি অধিগ্রহণ। কিন্তু সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট। সেখানে জমি অধিগ্রহণ শেষ এবং গাড়ি বেরিয়ে যাওয়া মানে আন্দোলনেও ইতি পড়ে যাওয়া। ফলে জমি অধিগ্রহণ ইস্যুতে তখন সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ম্যাচটা ১-১ রেজাল্টে অমীমাংসিত থেকে যাবে। সিঙ্গুরে সিপিআইএমের জয়, নন্দীগ্রামে বিরোধীদের। যা বিধানসভা ভোটের আগে বিরোধীদের কাছে মোটেও ভালো বিজ্ঞাপন নয়। ২-০ রেজাল্টই তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র লক্ষ্য। তাছাড়া ন্যানো কারখানা একবার  চালু হয়ে গেলে অনিচ্ছুক কৃষকের জমি ফেরত দেওয়ার দাবিরও কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না। তাই অনিচ্ছুক কৃষকের জমি ফেরানোর দাবি পূরণ না হলে কারখানা নয়, মূলত এই অ্যাজেন্ডা সামনে রেখেই সিঙ্গুরে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২৪ আগস্ট থেকে আমি রোজই যেতাম সিঙ্গুর। সকাল-সকাল যেতাম, সারাদিন থেকে রাতে  ফিরতাম। মূল মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার আশেপাশে আরও সব ছোট ছোট মঞ্চ বাধা। সেগুলোতে নানা নেতা থাকতেন। সকাল ৮ টা-৯ টা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চের সামনে ভিড় জমতে শুরু করত। দুপুর সাড়ে ১২ টা- ১ টার পর ভিড়টা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যেত। স্থানীয় লোকজন বাড়ি যেতেন খাওয়া-দাওয়া করতে। আবার ভিড় বাড়তে শুরু করত বিকেল ৩ টে-৪ টের পর থেকে। কোনওদিন সময় এমনও হয়েছে, দুপুরে ২০-২৫ জন লোক মঞ্চের কাছে বসে আছেন, পুরো এলাকা ফাঁকা। সেই সময়টা দুপুরে কখনও মাইকে গান বাজিয়ে দেওয়া হোত। বেশিরভাগ সময়েই কেউ-না-কেউ বক্তৃতা করতেন। একজন ছিলেন রোজকার বাঁধা বক্তা, প্রাক্তন সিপিআইএম নেতা সমীর পুততুণ্ড। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সিপিআইএমের সম্পাদক ছিলেন, হাতের তালুর মতো চেনেন তাঁর পুরনো পার্টিকে। ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে দল ছাড়েন সমীর পুততুণ্ড, সঙ্গে সইফুদ্দিন চৌধুরী। সিপিআইএমকে একটা জোরদার আদর্শগত ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন এই পিডিএস নেতা। অনশন মঞ্চে বসেছেন, বারবার সিঙ্গুর গিয়েছেন। একাধিকবার গিয়েছেন নন্দীগ্রামে। তাঁর বামপন্থী মতামত, চিন্তাধারা এবং তীক্ষ্ণ ভাষায় সিপিআইএমকে আক্রমণ করার দক্ষতার প্রশংসা প্রকাশ্যেই করতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুর্নিশ করতেন তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাকে।

সমীর পুততুণ্ডকে দিনে  দু-তিনবার বক্তৃতা করতে হোত সিঙ্গুরের মঞ্চে। নানা পুরনো ঘটনা এবং সিপিআইএমের বহু কীর্তি দীর্ঘ সময় ধরে বলার এবং লোক বসিয়ে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। জানতেন তৃণমূল কর্মী, সমর্থকরা কেমন সিপিআইএম বিরোধী কথা পছন্দ করেন। সহজ-সরল ভাষায় গলা উঠিয়ে, নামিয়ে কঠিন তত্ত্ব বলতেন মঞ্চ থেকে। সিঙ্গুরের মঞ্চে এমনই একদিন দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টির পর অল্প অল্প লোক জমতে শুরু করেছে, মূল মঞ্চে বক্তৃতা শুরু করলেন সমীর পুততুন্ড। সব মিলিয়ে ৫০-৬০ জন শ্রোতা, বেশিরভাগ চেয়ার ফাঁকা কিছু লোক এদিক- ওদিক ঘুরছে, কয়েকজন ভেজা চেয়ারেই বসে। আমি অন্যান্য দিনের মতো মঞ্চের ডান দিকে দাঁড়ানো অফিসের গাড়িতে বসে আছি। দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে, কিছু করার নেই। দুপুর আড়াইটে -তিনটে বাজে। একথা-ওকথা দিয়ে বক্তৃতা শুরু করে নিয়মমাফিক সিপিআইএমের বিরুদ্ধে  সুর চড়াতে শুরু করলেন সেই দলেরই প্রাক্তন নেতা। সমীর পুততুন্ডর বলার কায়দাটা এমনই, শুরুতে লোকজন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে, ঘোরাঘুরি করে। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছটফটে, চঞ্চল ভিড়টা মতো চুপ করে যায়। লোক বাড়তে শুরু করে নিঃশব্দে। সবাই মন দিয়ে শোনে প্রাক্তন সিপিআইএম নেতার বক্তব্য। মিলিয়ে নেয় নিজের অভিজ্ঞতা সঙ্গে একসময় সিপিআইএম করা এই নেতার বক্তব্য।

‘সিপিআইএমও আপনাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আমি বহু বছর ওই দল করেছি। জানি ওদের। যারা সিপিআইএম করে তাদেরও আপনাদের মতোই দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, দুটো কান, সিপিআইএমকে অযথা ভয় পাবেন না, ওদের ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। কিন্তু আপনারা অনেকেই সিপিআইএমকে ভয় করেন, আর ভয় করেন বলেই সিপিআইএম দিনের পর দিন ভোটে জেতে। যেদিন সিপিআইএম দেখবে, আপনারা আর সিপিআইএমকে দেখে ভয় পাচ্ছেন না, সেদিন সিপিআইএম আপনাদের ভয় পাবে। মনে রাখবেন, যেদিন সিপিআইএম বুঝবে, সাধারণ মানুষ তাদের দেখে আর ভয় পাচ্ছে না, সেদিন ওরা মানুষকে ভয় পাবে। পালাবার পথ পাবে না। সেদিন কিন্তু সিপিআইএম আর ভোটে জিতবে না। এই ভয় কাটাতে হবে আপনাদের। রুখে দাঁড়াতে হবে চোখে চোখ রেখে, তবেই দেখবেন সিপিআইএমও আপনাদের ভয় পাচ্ছে। ঠিকমতো রুখে দাঁড়ালে সিপিআইএমও আপনাদের দেখে দৌড়ে পালাবে। সিপিআইএমের পিঠ দেখতে পাবেন তখন……।’

কখনও গলা চড়িয়ে, কখনও নামিয়ে বলে চলেছেন সমীর পুততুণ্ড। সম্মোহিতের মত শুনছে শ’খানেক মানুষ। আর আমি ভাবছি, সত্যিই তো, এই বিষয়টা তো এত সহজভাবে আগে তো শুনিনি কারওর মুখে। একের পর এক নির্বাচনের রেজাল্ট নিয়ে হাজারবার চুলচেরা আলোচনা করেছি, বিশ্লেষণ করেছি কত রাজনৈতিক নেতা, কত সহকর্মীর সঙ্গে। এমন তত্ত্ব তো উঠে আসেনি আমাদের আলোচনায়। সত্যিই তো, সিপিআইএম নেতাদের নিদান মেনে নেওয়া, বছরের পর বছর রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের কাছে এক অনিবার্য ঘটনা ছিল। প্রত্যন্ত গ্রামে কেউ ভাবতেও পারত না, সিপিআইএমের অনুরোধ বা আদেশ অমান্য করা যায়। এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ চোখে চোখ রেখে রুখে দাঁড়াতে পারছে না, এটাই তো গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক একাধিপত্য। যাকে সিপিআইএম নেতারা বলতেন সাংগঠনিক শক্তি।

বহুদিন আগে এক প্রবীণ সিপিআইএম নেতা আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যে বছরের পর ভোটে জিতি, এটা শুধু উন্নয়নের জন্য বা সমস্ত মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে বলে নয়, সংগঠনের জোরে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধরো গোটা রাজ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে কলকাতায়, আমরা তো জিতি না। মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে মেদিনীপুর শহরে বা খড়গপুরে। সেখানে আমরা তো জিতি না। জিতি সবচেয়ে কম কাজ হওয়া শালবনি, জামবনি বা কেশিয়াড়িতে। বর্ধমানের সবচেয়ে উন্নয়ন হয়েছে আসানসোলে, সেখানেও আমরা হেরেছি, জিতেছি কোনও কাজ না হওয়া মঙ্গলকোটে।’ এমন আরও বহু উদাহরণ দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, সংগঠনই আসল, উন্নয়ন করে জেতা যায় না।

সমীর পুততুণ্ডর বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল তাঁর কথা। ঠিকই তো, সংগঠন আসল। আর সাংগঠনিক শক্তি মানেই আধিপত্যবাদ। বিরোধী মত থাকবে, হীরক রাজার দেশের যন্তরমন্তর ঘরও থাকবে। গ্রামেগঞ্জের চায়ের দোকানের আড্ডায়, আলোচনায় সিপিআইএম বিরোধী দীর্ঘশ্বাস পড়বে সারা বছর, কিন্তু ভোটের আগে জারি হয়ে যাবে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। শুরু হয়ে যাবে লাল পতাকায় মোড়া শক্তি প্রদর্শন, যা দেখে লোকে বুঝে যাবে, এ পার্টি তো হারবে না, আমার আর ব্যক্তিগত বিপ্লব করে লাভ কী? তার চেয়ে বরং জেতা দলের সঙ্গে থাকাই ভাল। সুবিধে চাই না, কিন্তু ক্ষতি তো হবে না কিছু! এরপরেও যে বছরের পর বছর নির্বাচনে রাজ্যের ৪৯ থেকে ৫২-৫৩ শতাংশ মানুষ সিপিআইএমের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, এটা একই সঙ্গে রহস্যজনক এবং বিস্ময়কর ব্যাপার।

কিন্তু ২০০৮ সালে অগাস্টের এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে সিঙ্গুরে সমীর পুততুণ্ডর কথা শুনে মনে হচ্ছিল, সত্যিই, এভাবে তো ভাবিনি কোনওদিন। দিনের-পর-দিন সিপিআইএমের ভোটে জেতার অন্যতম রহস্য, সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ ভাবতেই পারত না, সিপিআইএম হারতে পারে। তাই, থাকতে তো হবে এই সিপিআইএমের অধীনেই, ভোটের পর আমাদের কী হাল হবে, এই আশঙ্কায় জবুথবু হয়ে থাকতেন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সিপিআইএম বিরোধী মানুষ। এই কঠিন এবং বাস্তব সত্যটা এত সহজ ভাষায় সমীর পুততণ্ডের মুখে শুনে ভাবছিলাম, না জেনে, না বুঝে, কোনও প্রথামাফিক রাজনৈতিক তত্ত্বের অনুশীলন ছাড়াই তো শুধুমাত্র বাঁচার স্বার্থে সিপিআইএমকে হারানোর এই অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছিলেন নন্দীগ্রামের মানুষ। সেই ২০০৬ সালের ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের জানুয়ারি। অভিজ্ঞতায় কালীচরণপুর, গড়চক্রবেড়িয়া, সোনাচূড়া, কেন্দ্রেমারির মানুষ বুঝেছিলেন, সিপিআইএমকে ভয় পেলে চলবে না, ভয় পেলে বাস্তু এবং চাষের জমিটা  চলে যাবে। পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে হবে আস্তানার খোঁজে। তাই নিজের বাঁচার স্বার্থে, পরিবারকে রক্ষার স্বার্থেই সিপিআইএমের চোখে চোখ রেখে লড়তে হবে। এই লড়াইয়ে গিয়ে মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু লড়াই থামানো যাবে না। চোখের পলক পড়লে পরাজয় নিশ্চিত। তাই সিপিআইএম ভয় দেখাতে এলে দরকারে মারতে হবে, হাতে অস্ত্র নিতে হবে। গড়তে হবে প্রতিরোধ। সমীর পুততুণ্ড যে ভয়ের কথা বলেছিলেন, তাই তো সিপিআইএম নন্দীগ্রামের মানুষকে দেখাতে চেয়েছিল। ২০০৭ সালের ৫ জানুয়ারি, ৬ জানুয়ারি খেজুরির দিক থেকে বোমা, গুলি ছুড়ে। এই লড়াই যদি স্রেফ ভোটের হোত, হয়তো সেদিনই আত্মসমর্পণ করত নন্দীগ্রাম। কিন্তু এ লড়াই ছিল, জমি, পরিবার আর জীবন-জীবিকা রক্ষার। তাই জীবনের মায়া ছেড়ে সিপিআইএমকে ভয় না পেয়ে রুখে দাঁড়ানোর একরোখা দীক্ষা নন্দীগ্রাম নিয়েছিল। শপথ করেছিল, ময়দান ছেড়ে না পালানোর, পালটা মারের। আর সেটাই তো সুদে-আসলে ডিভিডেন্ড দিল পঞ্চায়েত ভোটে। সমীর পুততুণ্ডর  তত্বই ঠিক। প্রমাণ করে দিয়েছে নন্দীগ্রাম। ‘সিপিআইএম যেদিন দেখবে, আপনারা সিপিআইএমকে ভয় পাচ্ছেন না, সেদিন সিপিআইএম আপনাদের ভয় পাবে। সাধারণ মানুষ যেদিন সিপিআইএমকে দেখে ভয়ে পালাবে না, সেদিন সিপিআইএম সাধারণ মানুষকে দেখে ভয়ে পালাবে।’

সেদিন দুপুরে সিঙ্গুরে বসে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মায়, রাজ্যের ক্ষমতা থেকে সিপিআইএমের চলে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কারণ, নন্দীগ্রামের এই প্রতিরোধের শিক্ষা গুরুতরভাবে সংক্রামক আকার নিচ্ছে সর্বত্র। যা অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যের সিপিআইএম বিরোধী সাধারণ মানুষ আর ভয় পাবে না দীর্ঘদিনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক দলকে। রাজ্যের আপামর সিপিআইএম বিরোধী মানুষের কাছে এটাই নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলনের শিক্ষা। মার খেলে সিপিআইএমও ভয়ে পালিয়ে যায় এবং সিপিআইএম হারতেও পারে, এই দুই ধারণা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের বিশ্বাসে পরিণত হলে ভোট যুদ্ধে জেতা যে মুজফফর আহমেদ ভবনের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে, এনিয়ে আর কোনও সংশয় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পর আমার ছিল না।

 

২৩ নভেম্বর, ২০১০ এবং এক মন্ত্রীর পদত্যাগ

২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রাম এপিসোড। সংঘর্ষ, এলাকা দখল, পুর্নদখল, খুন, ধর্ষণ কোনও কিছুই বাকি ছিল না পূর্ব মেদিনীপুরের এই দুই ব্লকে। এরই মধ্যে হয়েছে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত এবং ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পর খেজুরি দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর শেষবারের মতো একবার খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের প্ল্যান করেছিল সিপিআইএম, যা নিয়ে তুলকালাম হয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। যে ঘটনার জেরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন গড়বেতার প্রভাবশালী নেতা তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের এক মন্ত্রী। পদত্যাগ পত্র লিখে তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে যাবেন, তখন ওই মন্ত্রীকে মহাকরণে ফোন করে ইস্তফা না দিতে অনুরোধ করেছিলেন খোদ দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। বিমান বসুকে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নামে ব্যাপক গালিগালাজ করে ফোন কেটে দিয়েছিলেন ওই মন্ত্রী। গোটা ঘটনাটা জানতেন রাজ্যের আরও একজন মন্ত্রী, তিনিও নানা ইস্যুতে মন্ত্রিসভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরোধী ছিলেন। তিনি  রেজ্জাক মোল্লা। রেজ্জাক মোল্লা এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএমের এক শীর্ষ নেতা ওই মন্ত্রীকে ২৪ নভেম্বর ২০১০, সকালে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করেছিলেন পদত্যাগ পত্র দেওয়ার থেকে। কিন্তু ২০০৭ সালে ‘অপারেশন সূর্যোদয়’ মাত্র ছ’মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটে মুখ থুবড়ে পড়ার পরও কেন এবং কী পরিস্থিতিতে সিপিআইএম আরও একবার নন্দীগ্রামে সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল, তা জানার জন্য ২০০৯ লোকসভা ভোটের আগে এবং পরের কিছু ঘটনা উল্লেখ জরুরি। নয়তো সিপিআইএমের এই অত্যন্ত গোপন পরিকল্পনার কারণ বোঝা কঠিন।

২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের রেজাল্টের সঙ্গে সঙ্গে নন্দীগ্রাম আবার পুরোপুরি চলে গেল তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে, ঠিক এক বছর আগের জায়গায়।

সিপিআইএমের কিছু নেতা, কর্মী ফের এলাকাছাড়া হলেন। যা যথেষ্ট চিন্তায় ফেলল লক্ষ্মণ শেঠকে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে ‘অপারেশন সূর্যোদয়ে’র পর লক্ষ্মণ শেঠ এবং সিপিআইএমের  তাবড় নেতারা নিশ্চিন্ত ছিলেন, নন্দীগ্রাম বশ্যতা মেনেছে। মাত্র সাত বছরের পুরনো গড়বেতা, কেশপুরের ওষুধ সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে, ফলে চিন্তার আর কিছু নেই। এখন থেকে নন্দীগ্রামে পরপর সব নির্বাচনে জয়, হলদি নদীতে জোয়ার ভাটার মতোই নিশ্চিত। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের রেজাল্ট তাঁদের সব অঙ্ক গুলিয়ে  দিল। লোকসভা ভোটের নিশ্চিত বিপর্যয় আঁচ করতে বেশি সময় লাগল না তাঁদের। আর সেই কারণেই পঞ্চায়েত ভোট থেকে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট পর্যন্ত সিপিআইএম খেজুরির দিক থেকে বেশ কয়েকবার নন্দীগ্রাম আক্রমণের চেষ্টা করে। বহুবার দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। খুনোখুনি হয়, জখম হয় বহু লোক। কিন্তু কখনই পুরোপুরি সাফল্য পাচ্ছিল না সিপিআইএম বাহিনীর এই উদ্যোগ। নন্দীগ্রামের ভিতরে খুব একটা এগোতে পারছিল না সিপিআইএম। তার প্রধান কারণ সিআরপিএফ এবং রাজ্য পুলিশের ভূমিকা। এবং পঞ্চায়েত ভোটের পর তৃণমূল কংগ্রেসের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া মনোবল এবং আত্মবিশ্বাস। তৃণমূল নেতারা বুঝে যান, মানুষ তাঁদের সঙ্গে রয়েছে এবং আর কয়েকটা মাস সিপিআইএমকে ঠেকিয়ে দিতে পারলেই লোকসভা ভোটে জেতা নিশ্চিত। এই ভাবনাই আরও সংহত করেছিল তাদের শক্তি। সব মিলিয়ে পুলিশ, সিআরপিএফের দৃঢ় ভূমিকা এবং নন্দীগ্রামের মানুষের অনমনীয় সিপিআইএম বিরোধী অবস্থানের নিট ফল, ২০০৯ সালে তমলুক লোকসভা ভোটে শাসক দলের চূড়ান্ত বিপর্যস্ত। পর্যুদস্ত লক্ষ্মণ শেঠ, সাংসদ হলেন শুভেন্দু অধিকারী। লোকসভা ভোটের পর তৃণমূল কংগ্রেস পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের শেষ দূর্গ খেজুরিও দখল করে নেয়। কীভাবে তিন দিন ধরে চলেছিল এই দখলদারি অভিযান উদ্যোগ এবং কী ঘটেছিল সেই ঘটনায় আসব পরে।

পঞ্চায়েত ভোটের পর নন্দীগ্রাম সহ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএমের এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে, পুলিশ অধিকাংশ সময় তাদের কথা পর্যন্ত শুনছিল না। তা বুঝতেও শুরু করেছিলেন শাসক দলের নেতারা। কিন্তু তাঁদের কিছু করার ছিল না। ২০০৯ লোকসভা ভোটের দিন সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামে এক সিপিআইএম কর্মী খুন হলেন। সেই সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিতে মৃত্যু হল একটি বাচ্চা মেয়েরও। পাঁচ বছরের নিরীহ মেয়েটা গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সেই সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছিল ভোট শেষ হওয়ার ঠিক আগে, কিন্তু আধা সামরিক বাহিনীর টহলদারির জন্য কোনও পক্ষই বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল না। ভোট-পর্ব মিটতেই দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। রাতে এমন সময় দু’জনের মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন আর সেখানে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। পরদিন একদম ভোরে খেজুরি দিকে থেকে সিপিআইএম আক্রমণ করে নন্দীগ্রাম। দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।

পঞ্চায়েতের মতোই ২০০৯ লোকসভা ভোটেও আমার নন্দীগ্রামে ডিউটি পড়ে। ভোটের  দু’দিন আগে গেলাম পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়, এবার আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান সুবীর রায়। ভোটের প্রায় সারাটা দিন মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কাটলো, খুন দুটো হল ঠিক সন্ধ্যায়। পরদিন একদম সকাল সকাল নন্দীগ্রাম থানায় গিয়ে পৌঁছই। সকাল সাড়ে সাতটা- আটটা হবে, থানার সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শেখ সুফিয়ান। প্রচণ্ড উত্তেজিত। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে থানায় এসেছেন সিপিআইএমের আক্রমণের খবর পুলিশকে জানাতে। আমাকে দেখেই বললেন, ‘সিপিআইএম খেজুরি দিক থেকে আক্রমণ করেছে, আমাদের ১৫-১৬ জন গুরুতর জখম। গিয়ে দেখুন কী অবস্থা। অনেক বাড়ি, ঘর ভেঙে দিয়েছে।’ সুফিয়ানের খবরের সত্যতা যাচাই করতে থানায় ঢুকতেই দেখি হন্তদন্ত হয়ে বেরোচ্ছেন নন্দীগ্রাম থানার ওসি প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি। আমার অনেক দিনের পরিচিত। মুখোমুখি হতেই বললেন, ‘আর পারা যাবে না, কাল সারা রাত জাগা। আজ আবার ভোর থেকে শুরু হয়েছে।’ ওড়িশা পুলিশের একটা বাহিনী গিয়েছিল নন্দীগ্রামে ভোটের ডিউটিতে। তাদেরই ১০-১২ জনকে সঙ্গে নিয়ে প্রসেনজিৎ যাচ্ছেন বেরোচ্ছেন ঘটনাস্থলের দিকে। বললেন, ‘ইভিএম স্ট্রং রুমে পাঠাতে পাঠাতে কাল রাত ১ টা বেজে গিয়েছে। তারপর পুরো ফোর্স ৩ টের সময় শুতে গেছে। একটা লোকও নেই থানায়।’

 

সামনে ওসির গাড়ি, তারপর দুটো গাড়িতে ওড়িশা পুলিশ। আমিও গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম এই তিন গাড়ির কনভয়ের পেছনে। ভূতার মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার মোড়ে জটলা। নন্দীগ্রাম থানার ওসির সঙ্গে ৪-৫ জন পুলিশ কর্মী এবং ওড়িশা পুলিশের ১০-১২ জন। সঙ্গে আমি এবং সুবীর। একটু এগোতেই সদ্য ভাঙচুর হওয়া পর পর বেশ কয়েকটা বাড়ি। মহিলারা কান্নাকাটি করছেন। সেখান থেকেই গুলির শব্দ পেলাম। গুলির শব্দ শুনে একটু থমকে মাঠের মধ্যে দিয়েই এগোতে শুরু করলেন প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি। পেছনে আমি এবং সুবীর। আমার হাতে মাইক, সুবীরের হাতে ক্যামেরা। যত এগোচ্ছি ততই গুলির শব্দ বাড়ছে। একটু এগোনোর পর ওড়িশা পুলিশের অফিসার জানিয়ে দিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আনতে হবে তখনই, নয়তো তাঁরা আর যাবেন না। এর কারণ, কোনও পরিস্থিতিতে পুলিশ নিজে থেকে গুলি চালালে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তাই পুলিশ সাধারণত চায়, খুব দরকার পড়লে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে গুলি চালাতে। আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা হলে আগে থেকেই সঙ্গে করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে যায় পুলিশ। ওড়িশা পুলিশ আশঙ্কা করেছিল, সেদিন গুলি চালাতে হতে পারে, তাই তারা ম্যাজিস্ট্রেট ডাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু ওই সকালে, ভোটের পরদিন কোথায় পাওয়া যাবে ম্যাজিস্ট্রেট। তাছাড়া তখন ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য অপেক্ষা করলে আরও কয়েক জনের মৃত্যু হতে পারে। নন্দীগ্রামের ওসি এই সমস্যার কথা ওড়িশা পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, তাঁরা কিছুতেই রাজি হলেন না। বাধ্য হয়েই ৪-৫ জন থানার অফিসারকে নিয়েই মাঠ এবং আলপথ ধরে গুলির শব্দ শুনে এগোতে থাকেলেন ওসি। সঙ্গে আমরা দু’জন। অনেকটা হাঁটার পর পৌছালাম হলদি নদীর কাছাকাছি। একটা বড়ো মাঠ। দক্ষিণ দিকে খেজুরি, সেই দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছে মাঝেমধ্যেই। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত নন্দীগ্রামের দিক থেকে তৃণমূলের লোকেরাও গুলি চালিয়ে জবাব দিচ্ছিল। আমরা গিয়ে পড়লাম দু’পক্ষের একদম মাঝখানে। কিন্তু পুলিশ পৌঁছে যাওয়ায় তৃণমূলের লোকেরা গুলি চালানো বন্ধ করে দেয়। কয়েকজন পুলিশ এবং আমরা তখন মাটিতে শুয়ে পড়েছি। যেভাবে গুলি চলছে কখন কী হয়ে যায় বোঝা মুশকিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটল ওইভাবে। তাতেও খেজুরির দিক থেকে গুলি চালানো বন্ধ হচ্ছে না। ৫-১০ মিনিট পরপরই গুলির শব্দ পাচ্ছি। বেশ বোঝা যাচ্ছে, তারা যে তখনও আছে, ভয়ে পালায়নি এই বার্তা দিতেই মাঝেমাঝে গুলি চালাচ্ছে সিপিআইএম বাহিনী।

নন্দীগ্রাম থানার এক সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। পদবী মনে নেই, নাম আনন্দ। সিপিআইএমের নিচুতলার নেতাদের এবং বন্দুক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আনন্দবাবু শুয়ে শুয়েই সিপিআইএমের বিভিন্ন লোককে ফোন করতে শুরু করলেন। গুলি চালানো বন্ধ করতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মাথার উপর দিয়ে গুলি উড়ে যাচ্ছে অনবরত। ওসি ফোন করছেন এসপি’কে, অ্যডিশনাল এসপি’কে আরও ফোর্স পাঠানোর জন্য। মনে হচ্ছে, আজ একটা কিছু যা তা কাণ্ড ঘটে যাবে। সিপিআইএম-পুলিশে মুখোমুখি লড়াই বেধে যাওয়ার পরিস্থিতি। নন্দীগ্রামের বহু গণ্ডগোল, সংঘর্ষ দেখেছি, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। মাথার উপরে মে মাসের রোদ চড়া হচ্ছে। মাঠে শুয়ে আছি, আর অপেক্ষা করছি, কখন পুলিশের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। কখন তারা সিপিআইএম বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়, তার জন্য সঙ্গী সুবীরও ক্যামেরা তাক করে রয়েছে। হঠাৎই আনন্দ মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে হ্যান্ড মাইক নিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘তোরা যদি না থামিস আমরা কিন্তু গুলি চালাবো। ভালো কথা বলছি ফিরে যা।’ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। আমাদের পেছনে তৃণমূল বাহিনী, সামনে সিপিআইএম। কোনওদিক থেকে  সাড়া শব্দ নেই। পুলিশ এসে গিয়েছে, আর এগোনো যাবে না বুঝে আরও কিছুক্ষণ পর গুলি চালানো বন্ধ করে পিছু হঠল সিপিআইএমের লোকজন। তারপরেও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে বুঝলাম  আর কিছু হবে না। দুপুর নাগাদ ফেরার জন্য আমরা রওনা দিলাম। ওসির নেতৃত্বে পুলিশের লোকজন ওখানেই থেকে গেলেন। যাওয়ার সময় উত্তেজনায় বুঝতেই পারিনি, কতটা হেঁটে চলে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় দেখলাম অন্তত আড়াই- তিন কিলোমিটার দূরে মেন রোড, যেখানে গাড়ি রাখা আছে।

গাড়িতে উঠে থানার দিকে ফিরছি, ওখানে ওবি ভ্যান রাখা আছে। ভিস্যুয়াল পাঠাবো। ফেরার সময় রাস্তার পাশে কিছু দূরে দেখি কয়েকটা বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে চারিদিক। কয়েক ঘণ্টা আগেও এই রাস্তা দিয়ে গেছি, তখন তো কোনও গণ্ডগোল ছিল না। বোঝাই যাচ্ছে, আগুনটা ধরানো হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। গাড়ি থেকে নেমে আবার পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। দাউ দাউ আগুনে পরপর ৪-৫ টি খড়ের বাড়ি পুড়ছে। পোড়া কাঠের গন্ধ। অ্যলুমিনিয়ামের বাসন উঠোনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বেশিক্ষণ সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আগুনের তাপে, পোড়া গন্ধে। তারই মধ্যে ছবি তুলছে সুবীর। এর সঙ্গে, ওর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সকালে খেজুরির দিক থেকে আক্রমণের বদলা এটা। এলাকায় কয়েকটা ঘর সিপিআইএম কর্মী, সমর্থক থাকতেন। আক্রোশে তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা। ওই বাড়িগুলোর বাসিন্দারা আবার ঘরছাড়া হলেন। খেজুরির দিক থেকে সিপিআইএমের কয়েক রাউন্ড গুলির মাশুল, কয়েক’শ পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা বাস্তুচ্যুত আবার। কী আজব রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার পরীক্ষাগার এই নন্দীগ্রাম! সমস্ত ছবি তুলে রওনা দিলাম থানার দিকে। গোটা রাস্তা থমথমে। শ’য়ে শ’য়ে পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভোট মিটে যাওয়ার পর, আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছিল নানা জায়গায় গণ্ডগোল। মৃত দুই, জখম বহু। দু’দলের কর্মী-সমর্থকদেরই বাড়ির পর বাড়ি জ্বলছে। মানুষের মুখ চোখ ভীত-সন্ত্রস্ত। বোঝাই যাচ্ছে ভোটের রেজাল্ট বেরনো পর্যন্ত এই হিংসা, পালটা হিংসা চলবে। যার যে এলাকায় শক্তি বেশি সে সেখানেই বিরোধী দলের কর্মী, সমর্থকদের আক্রমণ করছে। যে ভোটে জিতবে তার দিকেই আবার পেন্ডুলামের মতো ঢলে পড়বে নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের সমর্থন। রেজাল্টের আগের এই কয়েকটা দিন নন্দীগ্রাম ফের যুদ্ধক্ষেত্র। এখানকার মানুষ জানে রেজাল্টের অনিবার্য পরিণতি, পরাজিত পক্ষের কর্মী, সমর্থকরা হয় জয়ী দলের পূর্ণাঙ্গ বশ্যতা মানবে, নয় এলাকাছাড়া হবে।

পড়ুন আগে পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৬: সিআরপিএফের সঙ্গে পুলিশের মারপিট! ফের উত্তপ্ত হল নন্দীগ্রাম

ফিরে দেখি নন্দীগ্রাম থানায় বসে আছেন জেলার পুলিশ সুপার পল্লবকান্তি ঘোষ। সেদিনই বিকেলে সিপিআইএমের ৫ জনকে অস্ত্র সহ গ্রেফতার করে পুলিশ। টানা তল্লাশি চালিয়ে তাদের ধরে থানায় নিয়ে আসেন ওসি প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ছেড়ে দিতে হবে বলে পুলিশের ওপর চাপ দিতে শুরু করেন জেলার সিপিআইএম নেতারা। ধৃতদের নন্দীগ্রাম থানায় রাখলে সমস্যা হবে বুঝে পুলিশ সুপার ওই পাঁচজনকে কিছুক্ষণের মধ্যে পাঠিয়ে দেন হলদিয়ার দুর্গাচক থানায়। জেলা নেতাদের কথায় পুলিশ ওই পাঁচজনকে ছাড়বে না বুঝে ওই অনুরোধ নিয়ে পল্লব কান্তি ঘোষকে কলকাতা থেকে ফোন করেন সিপিআইএমের এক প্রভাবশালী রাজ্য কমিটির সদস্য, যিনি তখন একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ওই পাঁচজনকে ছাড়া যাবে না বলে শাসক দলের প্রভাবশালী ওই রাজ্য কমিটির সদস্যকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওই নেতা দুম করে টেলিফোন রেখে দেন। আমি তখন নন্দীগ্রাম থানায় পল্লব কান্তি ঘোষের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে।

এই ঘটনার ঠিক একদিন পরে সন্ধেবেলা, তখনও লোকসভা ভোটের রেজাল্ট বেরোয়নি, লক্ষ্মণ শেঠ তাঁর অনুগামী বিধায়ক অমিয় সাহুকে নিয়ে তমলুকে পুলিশ সুপারের অফিসে যান। লক্ষণ শেঠ সরাসরি পল্লব কান্তি ঘোষকে বলেন, ‘আমাদের কিছু ছেলে নন্দীগ্রামে ঢুকবে, আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনারা কয়েকদিন একটু চোখ বন্ধ করে থাকুন।’ সরাসরি এমন প্রস্তাব শাসক দলের সাংসদ দিতে পারেন ভাবতেই পারেননি পুলিশ সুপার। উত্তেজিত হয়ে তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন পল্লবকান্তি ঘোষ। কয়েক মাস পরে পল্লব কান্তি ঘোষের এমন পোস্টিং হয়েছিল যেখানে তাঁর কোনও অফিসই ছিল না। কিন্তু পল্লবকান্তি ঘোষকে  সরিয়ে যাঁকে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার করা হল, তিনিও জেলার সিপিআইএম নেতৃত্বের অপ্রিয় হয়ে উঠতে বেশি সময় নেননি। তিনি বাস্তব বৈদ্য।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.